ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

তরুণীদের মনোজগতে পরিবর্তন ॥ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ১৯ এপ্রিল ২০১৬

তরুণীদের মনোজগতে পরিবর্তন ॥ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

বর্তমান প্রযুক্তিগত বিপ্লব তরুণ সমাজের এবং বিশেষ করে তরুণীদের জীবনের ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে সেই প্রসঙ্গ নিয়ে দুটো বই সম্প্রতি আমেরিকায় আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে। একটি বইয়ের নাম ‘আমেরিকান গার্লস : সোস্যাল মিডিয়া এ্যান্ড দি সিক্রেট লাইভস অব টিনেজার্স’। লিখেছেন সাংবাদিক ন্যান্সি জো সেলস। ফেসবুক প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১২ বছর ধরে অভিভাবক মহলে একটা ভীতি চলে আসছে। তা হলো এই সামাজিক মাধ্যমটিকে ব্যবহার করতে গিয়ে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীর দল নিজেদের মস্তিষ্ক পচিয়ে ফেলছে এবং সেই সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষমতাকে ধ্বংস করে ফেলছে। এই অভিভাবকদের আশ্বস্ত করার জন্য আরেকটা মহল বলছে ভয়ের কিছু নেই। এই সামাজিক মাধ্যমটি তরুণদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটানোর একটা উপায় মাত্র। কিন্তু ন্যান্সি জো সেলস এমন আশ্বাসে নিশ্চিত বোধ করেন না। আমেরিকার ১০টি রাজ্যে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে তার ধারণা হয়েছে যে এ ব্যাপারে যথেষ্টই উদ্বিগ্ন বোধ করার কারণ আছে। ফেসবুক, সেলফি, স্মার্টফোন এগুলো একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় এবং অনিষ্টকর। এ যুগের মেয়েরা ফোনের ওপরই বেঁচে থাকে। তবে এই ফোন উদ্বেগ ও ঈর্ষারও উৎস এবং হয়রানি ও পীড়নেরও হাতিয়ার। ছেলেরা অনেক সময় মেয়েদের নগ্ন ছবি নেয়ার জন্য ব্ল্যাকমেইল করে। মেয়েরা যদি ব্ল্যাকমেইলের কাছে নতিস্বীকার করে নগ্ন ছবি পাঠায় তাহলে ছেলেরা সেই ছবি অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে কিংবা এ জাতীয় ছবির জন্য ইপস্টাগ্রামের যে এ্যাকাউন্ট আছে সেখানে পোস্ট করতে পারে। ন্যান্সি তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের প্রযুক্তি, স্মার্টফোন ও সামাজিক মাধ্যমের দ্বারা কিশোর-কিশোরীদের যৌন আচরণও প্রকৃতপক্ষে পাল্টে যাচ্ছে এবং নতুনভাবে নির্ধারিত হচ্ছে। অনলাইন পর্নোর প্রভাবের কথা না হয় নাই বলা হলো। দেখা গেছে, ক্যাজুয়েল পোশাকে কোন মেয়ে ফেসবুকে ছবি দিলে খুব একটা লাইক পাওয়া যায় না। আবার খোলামেলা ও উত্তেজক পোশাকে দিলে জুটে ‘সেক্সি’ ও ‘পর্নোস্টার’ এর মতো মন্তব্য। প্রায় একই সময় মোটামুটি একই ধরনের সমস্যা নিয়ে আরও একটি বই বেরিয়েছে যার নাম ‘গার্লস এ্যান্ড সেক্স : নেভিগেটিং দি কমপ্লিকেটেড নিউ ‘ল্যান্ডস্কেপ’। লিখেছেন পেগি ওরেনস্টেইন। ইনিও একজন সাংবাদিক। বইয়ে তিনি ‘গার্লি গার্ল কালচারের’ অতি নারীবাদী মূল্যবোধ পর্যালোচনা করেছেন এবং আজকের তরুণীদের যৌনজীবন কেমন তা দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে এত দিনে এটা এক পরিচিত জগতের রূপ ধারণ করেছে। অসংখ্য ছায়াছবি, টিভিশো, সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের নিবন্ধের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছেÑ লুকআপস, সেক্সটিং, সেলফি, সøুট শেমিং, ইন্টারনেট পর্নো, ক্যাম্পাস রেপ এমনি কত কি। ওরেনস্টেইন নিজে কট্টর নারীবাদী যিনি বিশ্বাস করেন যে, নারী ও পুরুষের সমান আচরণ হওয়া উচিতÑ এমনকি বেডরুমেও। তিনি প্রশ্ন তোলেন, আমরা সামনে এগোচ্ছি না পিছিয়ে যাচ্ছি? যৌনতার ক্ষেত্রে আজকের মেয়েরা কি তাদের মায়েদের তুলনায় বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে? নিজেদের ওপর তাদের কি অধিকতর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ আছে? কলঙ্কের ছাপ প্রতিহত করতে, প্রকৃত আনন্দের সন্ধান করতে কি তারা অধিকতর সক্ষম? ওরেনস্টেইন দেখিয়েছেন যে যৌন আবেদনময়ী দেখাতে, শুধুমাত্র পার্টনারের সন্তুষ্টির জন্য সেক্স করতে মেয়েদের ওপর চাপ থাকে। তিনি কিশোরী ও তরুণীদের ক্ষেত্রে ক্যাম্পাসে ধর্ষণ, মদ খেয়ে মাতলামি এবং ওরাল ও এনাল সেক্সের ব্যাপকতার আশঙ্কাজনক পরিসংখ্যানও তুলে ধরেন। তিনি দেখিয়েছেন যে অল্পবয়সী মেয়েদের দেহসর্বস্ব সত্তায় পর্নোবসিত করার এবং অন্যদের পরিতৃপ্তির জন্যই এসব দেহের অস্তিত্ব রয়েছে এমনটি উপলব্ধি করতে তাদের ওপর চাপ থাকে। তবে সেই চাপ অতিক্রম করেই অনেক তরুণী আবার যৌন ও যৌনতার নতুন ও জটিল ভূমিতে স্বচ্ছন্দ্যে বিচরণ করে চলেছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, অতীতের নারীবাদীরা তাদের যৌনসম্ভোগের বস্তু হিসেবে গণ্য করার বিরুদ্ধে প্রায়শই প্রতিবাদ জানাত। কিন্তু আজকের তরুণীরা তা করে না। তারা বরং দাবি করে যে এ ধরনের ব্যাপারের মধ্য দিয়ে তাদের ক্ষমতায়ন ঘটছে। যেমন হোলি নামে এক কলেজ ছাত্রী বলে যে, ‘ক্রপটপ পোশাকে যখন আমার স্তন যুগল দেখা যায়, আমার পদযুগল দেখা যায়, তখন নিজের শরীর নিয়ে আমার নিজেকে অধিকতর আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। নিজেকে এত মুক্ত স্বাধীন আর কখনই বোধ করি না।’ দুটো বইয়েই পর্নোর ক্রমপ্রসারমাণ প্রভাবকে এ জন্য দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ইন্টারনেটের বদৌলতে পর্নোগ্রাফি আজ আগের যে কোন সময়ের চেয়ে আরও ব্যাপক পরিসরে সহজলভ্য হয়েছে। খুব কম লোকেই একে বাস্তবভিত্তিক বলে মনে করে। তবে অনেকে একে গাইড হিসেবেও দেখে। এই শেষোক্ত কথাটির কিছু সত্যতা হয়তবা পাওয়া যাবে সেইসব দেশে যেখানে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সেক্স নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা কদাচিৎই বলে থাকে এবং স্কুলগুলোতেও যৌন শিক্ষা দেয়া হয় না। সমস্যাটা হলো এই পর্নোগ্রাফির অধিকাংশই উৎকট কোমর খোলামেলাই শুধু নয়, ওগুলো একই সঙ্গে ভায়োলেন্টও বটে। যা প্রত্যাশাকে প্রভাবিত করে। কানাডার কিশোর-কিশোরীদের ওপর এক সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে পর্নোগ্রাফি উপভোগ করা এবং একটা মেয়েকে আটকে রেখে তার সঙ্গে জোর করে সেক্স করার মধ্যে অন্যায়ের কিছু নেই একথা বিশ্বাস করার মধ্যে যোগসূত্র আছে। তাছাড়া পর্নোগ্রাফিতে নারী এমনভাবে চিত্রিত যেন তারা মূলত পুরুষের ভোগের সামগ্রী হিসাবেই বর্তমান। সূত্র : দি ইকনোমিস্ট
×