ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

রহস্যময় মোনালিসার স্রষ্টা লিওনার্দো দা ভিঞ্চি

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ১৯ এপ্রিল ২০১৬

রহস্যময় মোনালিসার স্রষ্টা লিওনার্দো দা ভিঞ্চি

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন একাধারে যন্ত্রবিদ, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিত্রশিল্পী, প্রযুক্তিবিদ, ভাস্কর, স্থপতি ও শরীরবিদ্যাবিদ। প্রতিভার প্রতিটি ক্ষেত্রে যিনি দেখিয়েছেন সমান দক্ষতা। যার পরিচয় উল্লেখ করার সময় পড়তে হয় জটিল সমস্যায়। পুরো নাম লিওনার্দো দি সের পিয়েরো দা ভিঞ্চি। কিন্তু সারা বিশ্বের মানুষ যাকে চিনে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি নামে। লিওনার্দোর নামের ‘দা ভিঞ্চি’ নামের অর্থ হলো যিনি ভিঞ্চি নগর থেকে এসেছেন এবং ‘লিওনার্দো দি সের পিয়েরো দা ভিঞ্চি’ এর অর্থ হলো পিয়েরোর পুত্র লিওনার্দো এবং তার জন্ম ভিঞ্চিতে। মহান এই কিংবদন্তির জন্মদিন চলে গেল কয়েকদিন আগেই অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল, ১৪৫২ সাল। ইতালির ফ্লোরেন্সের অদূরবর্তী ভিঞ্চি নগরের এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা ছিলেন বিত্তশালী একজন আইনজ্ঞ। আর মা ছিলেন কৃষক কন্যা। ভিঞ্চি ছিলেন পিয়েরো দা ভিঞ্চি এবং গ্রাম্য মহিলা ক্যাটরিনার অবৈধ সন্তান। ধারণা করা হয় তার মা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা একজন দাসী। লিওনার্দোর প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে জানা গেছে খুবই অল্প। জীবনের প্রথম ৫ বছর কেটেছে আনসিয়ানোর একটি ছোট্ট গ্রামে। এরপর তিনি চলে যান ফ্রান্সিসকোতে। সেখানে তিনি তান বাবা, দাদা-দাদি ও চাচার সঙ্গে থাকেন। এ সময় তার বাবা এ্যালবিরা নামের ১৬ বছর বয়সী এক তরুণীকে বিয়ে করেন। এ্যালবিরা লিওনার্দোকে অনেক ভালবাসত। কিন্তু অল্প বয়সেই তার মৃত্যু হয়। ১৩ শতকের শেষ থেকে ১৬ শতক পর্যন্ত ছিল ইতালিয়ান রেনেসার যুগ। এ সময়ে সমগ্র ইউরোপ বিশেষ করে ইতালি ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখার উন্নতির চরম শিখরে। ভিঞ্চি ছিলেন সেই সময়ের একজন মেধাবী মানুষ। ভিঞ্চি কোন রকম আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া গ্রহণ করেননি। তাঁর লেখাপড়ার সবকিছুই ঘরোয়াভাবে। তাঁর ছিল প্রকৃতির প্রতি ভীষণ টান। এজন্য তিনি বেশিরভাগ সময় ঘরের বাইরে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। ১৪৬৬ সালে লিওনার্দোর বয়স যখন ১৪ তখন তাকে ডেল ভেরোচ্চির (ঠবৎৎড়পপযরড়) কাছে শিক্ষানবিশ হিসেবে পাঠানো হয়্ এরপর দ্রুতই তার প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। বলা হয়ে থাকে ভিঞ্চির ‘দা ব্যাপ্টিজম অফ ক্রাইস্ট’ এতটাই সুনিপুণ হয় যে তা দেখার পর ভেরোচ্চি জীবনের জন্য আঁকা ছেড়ে দেবার পণ করেন। এর মাঝখানে সমকামিতার অভযোগে গ্রেফতার হয়ে বেকসুর খালাস লাভের পর ভিঞ্চি ফ্লোরেন্স থেকে মিলানে চলে আসেন। এরপর ১৪৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি কি করেছেন, কোথায় ছিলেন তার কিছুই জানা যায় না। ধারণা করা হয় এই সময়ে তিনি ১৪৭৮ থেকে ১৪৮১ পর্যন্ত তার নিজের ওয়ার্কশপে কাজ করেছেন। এরপর ১৪৭৮ সালে চ্যাপেল অব ‘সেন্ট বার্নার্ড’ ও ‘এ্যাডোরেশন অব দি ম্যাগি’ এবং ১৪৮১ সালে ‘মঙ্ক অব সান ডোনাটো’ এ স্কাপিটো এর জন্য ‘দ্য এ্যাডোরেশন অভ দ্য ম্যাগি’ আঁকার কাজ পান। ভাসারির মতে লিওনার্দো সে সময়ের সেরা সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। ১৪৮২ সালে তিনি ঘোড়ার মাথার আকৃতির একটি বীণা তৈরি করেছিলেন। এর নাম ছিল ‘লরেঞ্জো দ্য মেডসি’ যা তিনি মিলানের ডিউক লুদোভিকো এল মোরো এর কাছে শান্তিচুক্তি নিশ্চিত করার জন্য। লিওনার্দো ১৪৮২ থেকে ১৪৯৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মিলানে কাজ করেছেন। এখানে তিনি ‘ভার্জিন অব দ্য রকস’ এবং ‘দ্য লাস্ট সাপার’ ছবি দুটি আঁকার দায়িত্ব পান। ১৪৯৩ থেকে ১৪৯৫ এর মধ্যে তার অধিনস্তদের মাঝে ক্যাটরিনা নামে এক মহিলার নাম পাওয়া যায়। ১৪৯৫ সালে এ মহিলাটি মারা যান। সে সময় তার শেষকৃত্যের খরচ দেখে ধারণা করা হয় তিনি ছিলেন লিওনার্দোর মা। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তার জীবদ্দশায় প্রকৌশলী হিসেবে অনেক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। লুভোডিকো মুরো নামক এক ব্যক্তিকে তিনি এক চিঠি দিয়ে দাবি করেছিলেন যে তিনি একটি শহরের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার জন্য সয়ংক্রিয় কিছু যন্ত্র আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন। লিওনার্দো তাঁর ডায়েরিতে বিভিন্ন বাস্তব এবং অবাস্তব যন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছিলেন। যার মধ্যে রয়েছে নানা রকম বাদ্যযন্ত্র, একটি যান্ত্রিক সৈন্য, হাইড্রোলিক পাম্প, ডানার মর্টার শেল এবং একটি বাষ্প কামান। তিনি তাঁর জীবনের একটি বড় সময় উড়তে সক্ষম যন্ত্র তৈরিতে ব্যয় করেন। তাঁরই প্রদত্ত ডিজাইনে বর্তমানে আধুনিক বিমান এবং হেলিকপ্টার নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। ১৫ শতকের শেষ দিকের বিখ্যাত ব্যক্তি লুদভিকো এস্ফোরজা ছিলেন জ্ঞানচর্চার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। তিনি মিলানে একটি দুর্গ দখল করেন। সেখানে তিনি শহরের বিখ্যাত শিল্পী, সাহিত্যিক, স্থাপতি, বৈজ্ঞানিক, চিত্রশিল্পী, দার্শনিকদের তার দুর্গে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার আমন্ত্রণে লিওনার্দো ১৪৮২ সালে তার দুর্গে আসেন। এখানে তিনি একটানা ১৭ বছর কাজ করেন। এই সময়ে তিনি বিখ্যাত গণিতবিদ লুকা পাচিওলি এর সঙ্গে বিজ্ঞান ও গণিত নিয়ে গবেষণা করেন। বাঁকা চোখের চাহনি, চাপা হাসি আর রহস্যে ভরা মুখশ্রী যে নারী সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ছুয়েছে তার নাম অপরূপা মোনালিসা। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এই ধরাধাম ছেড়ে যাওয়ার ঠিক এক যুগ আগেই আপন হাতের তুলির সুনিপুণ টানে ক্যানভাসে আঁকেন মোনালিসা। দীর্ঘ চার বছরের সাধনা আর অধ্যবসায়ের ফসল হলো এই চিত্র কর্মটি। লিওনার্দো কাজটা শুরু করেছিলেন ১৫০৩ সালে আর ইতি টানেন ১৫০৭ এ এসে। অনেকে বলেন মোনালিসার হাসি নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা হয়েছে তা দিয়ে একটা মহাকাব্য লিখা যাবে অতি সহজেই। শুধু হাসিতে নয় নামের ব্যাপারটাতেও অনেকের ধাঁধা লেগে যায়। কেউ বলে লাজাকান্দো আবার কেউ বলে মোনালিসা। তবে আর যাই হোক মোনালিসা নামেই তার পরিচিতি টা একটু বেশি। ‘মোনালিসা’ তৈরির সময় সাদা ক্যানভাসের উপরে বিভিন্ন স্তর তৈরির জটিল পদ্ধতি ব্যবহার করেন লিওনার্দো। আর এতে তিনি এতটাই দক্ষ আর সফল ছিলেন যে পরবর্তীতে আর কেউই এই পদ্ধতিতে সমানভাবে সফল হয়নি। বিভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণের তৈলাক্ত স্তর ব্যবহার করে কাজটি করেন লিওনার্দো। এতে বিভিন্ন স্তরে আলাদা আলাদাভাবে রং মিশিয়ে তিনি ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন ‘মোনালিসা’-এর। শুধু মোনালিসাই নয় আরও বেশ কয়েকটি চিত্রকর্মে লিওনার্দো এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করে গেছেন। শিল্পজগতে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির এই কাজগুলো আজও সমানভাবে রহস্যময় এবং শ্রেষ্ঠ। ‘দ্য লাস্ট সাপার’ দেয়ালচিত্রটি শোভা পাচ্ছে ইতালির মিলানের সান্তা মারিয়া দেল গ্রেজির ডায়নিং হলের পেছনের দেয়ালে। ছবিটির প্রাথমিক বিষয়বস্তু হলোÑ যীশুখ্রিস্ট ও তাঁর বারোজন শিষ্যের একত্রে নৈশভোজ। নৈশভোজে যীশু ঘোষণা করেন এই শিষ্যদেরই একজন পরদিন তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। আলোচ্য চিত্রে ফুটে ওঠেছে যীশু তার শিষ্যদের এই কথাটি বলছেন আর তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে কে সে বিশ্বাসঘাতক। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এ ছবিতে যীশুর মুখ ফুটিয়ে তোলার জন্য দীর্ঘ সময় নিয়েছিলেন বলে শোনা যায় যাতে যীশুর মুখে অভিব্যক্তিহীন একটা আবহ ফুটিয়ে তোলা যায়। সেপ্টেম্বর ১৫১৩ থেকে ১৫১৬ পর্যন্ত অধিকাংশ সময় তিনি রোমে দশম পোপের অধীনে কাটিয়েছিলেন। অক্টোবর ১৫, ১৫১৫ তে যখন রাজা ফ্রান্সিস-১ম মিলান দখল করলেন তখন লিওনার্দো তার অধীনে কাজ শুরু করেন। তিনি তখন রাজার বাসভবনের পাশেই ‘ক্লস লুইস’ নামক ভবনে বসবাস করতে শুরু“করলেন যেখানে তিনি তার জীবনের পরবর্তী ৩ বছর অতিবাহিত করেন এবং ২ মে ১৫১৯ এ লিওনার্দো এই ‘ক্লস লুইস’ ভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
×