ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রিজার্ভ চুরিতে ২০ বিদেশী জড়িত

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৯ এপ্রিল ২০১৬

রিজার্ভ চুরিতে ২০ বিদেশী জড়িত

গাফফার খান চৌধুরী ॥ স্বল্প সময়েই ফেরত আসছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে প্রায় আড়াই শ’ কোটি টাকা। বাকি সাড়ে পাঁচ শ’ কোটি টাকাও পর্যায়ক্রমে ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চুরি যাওয়া পুরো টাকাই এখন ফিলিপিন্সে রয়েছে। টাকা চুরির সঙ্গে ১৪ জন নয়, ২০ জন বিদেশী জড়িত। শনাক্ত হওয়াদের মধ্যে কয়েকজন নারীও রয়েছে। তদন্তে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। শনাক্ত হওয়া বিদেশীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। শনাক্ত হওয়া বিদেশীদের সম্পর্কে তথ্য পেতে তাদের দেশ ছাড়াও ইন্টারপোলের মাধ্যমে যোগাযোগ চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব ও উদাসীনতার কারণে টাকা চুরির ঘটনাটি ঘটে। যাদের অবহেলায় ঘটনাটি ঘটেছে তাদের শনাক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। টাকা চুরির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সোমবার সিআইডি সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক শাহ আলম জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদন্ত করতে সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ বিভাগের দুইটি দল বিদেশী গিয়েছিলেন। এর মধ্যে তিন সদস্যের একটি দল শ্রীলঙ্কায় আর তিন সদস্যের অপর দলটি ফিলিপিন্সে গিয়েছিল। সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে ২০ জন বিদেশীর জড়িত থাকার প্রাথমিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওইসব বিদেশীদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্যও পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তিনি তাদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ওইসব বিদেশীরা যেসব দেশের নাগরিক সেইসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার, পুলিশ প্রশাসন, ইন্টারপোল ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ নানাভাবে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। তাদের দেশের প্রচলিত আইন মোতাবেকই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আনা সম্ভব। সে চেষ্টা অব্যাহত আছে। জনকণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টাকাগুলো মাত্র ৫শ’ ডলার দিয়ে খোলা একটি এ্যাকাউন্টে জমা হয়। মাত্র ৫শ’ ডলার দিয়ে খোলা একটি এ্যাকাউন্টে এত টাকা জমা হওয়ার ব্যাপারটিও একটি দেশ গোপন রাখে। যদিও পরবর্তীতে তা প্রকাশ পেয়ে যায়। মাত্র দুইটি দেশে টাকাগুলো যায়। এর মধ্যে একটি দেশ শ্রীলঙ্কা। অপরটি ফিলিপিন্স। চুরি যাওয়া কোন টাকাই বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় নেই। ফিলিপিন্সের সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাংলাদেশের টাকা ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আন্তরিক। আশা করছি পর্যায়ক্রমে টাকাগুলো ফেরত পাওয়া সম্ভব হবে। টাকা চুরি যাওয়ার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, টাকা চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদাসীনতা, খামখেয়ালিপনা ও দুর্বল মনিটরিংয়ের বিষয়টি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এমন উদাসীনতা, খামখেয়ালিপনা ও মনিটরিং ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পর্যায়ক্রমে শনাক্ত এবং জিজ্ঞাসাবাদ করার কাজ চলছে। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ফিলিপিন্সে যাওয়া সিআইডি দলটি সেদেশের সিনেট, দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্বনর, এন্টি মানিলন্ডরিং স্কোয়াড, জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনবিআই) ও দেশটির প্রধান আর্চ বিপশের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। বৈঠকে চুরির সঙ্গে ২০ বিদেশী জড়িত থাকার বিষয়টি শনাক্ত হয়। এর মধ্যে ৭ জন শ্রীলঙ্কার, একজন জাপানী ও ১২ জন ফিলিপিন্সের নাগরিক। শ্রীলঙ্কার ৭ জনের মধ্যে ৬ জন সেদেশটির শালিকা নামের একটি এনজিওর পরিচালক। অপরজন দালাল। যিনি এনজিওটির সঙ্গে জড়িত। ফিলিপিন্সের ১২ জনের মধ্যে ৩ জন চীনা বংশোদ্ভূত ফিলিপিন্সের নাগরিক। যাদের কাছে চুরি যাওয়া টাকার অধিকাংশই রয়েছে বলে তদন্তকারীরা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে। ওই তিনজন চীনা বংশোদ্ভূত ফিলিপিন্সের নাগরিক হচ্ছে কিম অং, সোয়া হুয়া ও চীনের ম্যাকাওয়ের নাগরিক ডিং জি জি। এ তিনজন সম্পর্কে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। ওই তিনজন চীনের নাগরিক নয় বলে চীনের তরফ থেকে জানিয়েছে। অপর বিদেশীদের সম্পর্কে জানতে ওইসব বিদেশীরা যেসব দেশের নাগরিক সেইসব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। তবে কোন উত্তর মেলেনি। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ফিলিপিন্সের শনাক্ত হওয়া ১২ জনের মধ্যে রয়েছে এনরিকো টিয়োডোরো ভাসকোয়েজ, আলফ্রেড সান্তোস ভার্গারা, মাইকেল ফ্রেন্সিসকো ক্রুইজ ও জেসি ক্রিস্ট্রোফার লাগ্রোসাস। এ চারজন মাত্র ৩ ডলার দিয়ে রিজাল কর্মাসিয়াল ব্যাংকের মাকাতির জুপিটার ব্রাঞ্চে গত বছরের ১৫ মে হিসাব খোলে। তাদের প্রত্যেকের এ্যাকাউন্টে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৫শ’ ডলার করে ছিল। ৪ ফেব্রুয়ারি হ্যাকাররা ৩৫টি ম্যাসেজের মাধ্যমে ফেডারেল ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৯৫১ মিলিয়ন ডলার রিজাল ব্যাংকের জুপিটার শাখায় ট্রান্সফার করতে বলে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক মাত্র ৫টি ম্যাসেজ গ্রহণ করে। সেই ম্যাসেজের প্রেক্ষিতে ৮১ মিলিয়ন ডলার জুপিটার শাখার ওই চারটি এ্যাকাউন্টে আর ২০ মিলিয়ন ডলার শ্রীলঙ্কার শালিকা ফাউন্ডেশনের এ্যাকাউন্টে জমা হয়। শ্রীলঙ্কার টাকা ফেরত পাওয়া গেছে। চুরি যাওয়া পুরো টাকাই বর্তমানে ফিলিপিন্সে রয়েছে। সিআইডির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, তারা ফিলিপিন্সের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেছেন। ফিলিপিন্সের তরফ থেকে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এ টাকাটি স্বল্প সময়ের মধ্যেই ফেরত পাওয়া যাবে। টাকাগুলো আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকের বাংলাদেশ শাখায় জমা হবে। এসব টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ঢাকায় আসবে না। ফিলিপিন্সের ৪ জন সিনেটর বাংলাদেশের চুরি যাওয়া টাকা ফেরত দিতে সবচেয়ে বেশি আন্তরিক। এছাড়া দেশটির প্রধান আর্চ বিশপের সঙ্গেও সিআইডির বৈঠক হয়েছে। তাকে চুরি যাওয়া টাকাগুলো বাংলাদেশের অত্যন্ত দরিদ্র মানুষের বলে বুঝাতে সক্ষম হওয়া গেছে। এরপর তিনি বাংলাদেশের টাকা ফেরত দিতে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে তিনি বলেন, অত্যন্ত শ্রমের টাকা যদি ফিলিপিন্স ফেরত না দেয়, তাহলে গড তাদের ক্ষমা করবে না। অতএব টাকাগুলোর যেন অতি দ্রুত বাংলাদেশকে ফেরত দেয়া হয়। বর্তমানে চুরি যাওয়া টাকার বিষয়ে সিনেটে শুনানি চলছে। দেশটির আইন অনুযায়ী আদালতের উর্ধে সিনেট। এজন্য সিনেটে শুনানি চলমান থাকায় প্রায় সব ধরনের আইনগত প্রক্রিয়া থেমে আছে। সিনেটের শুনানি শেষ হওয়ার পর আইনগত প্রক্রিয়া শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে সব টাকাই ফেরত পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বদা তৎপর থাকতে হবে। তাহলেই স্বল্প সময়ের মধ্যে পুরো টাকাই ফেরত পাওয়া সম্ভব বলেও এই কর্মকর্তা জানান।
×