ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দু’বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ১৬ জন;###;ঝুঁকি নিয়েই চলছে আড়াই লক্ষাধিক গাড়ি ;###;সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় দায় নিচ্ছে না কেউ ;###;১৮০ কনভার্সনের বিপরীতে রিটেস্ট সেন্টার মাত্র ১১

ভয়ানক মৃত্যুফাঁদ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৯ এপ্রিল ২০১৬

ভয়ানক মৃত্যুফাঁদ

আজাদ সুলায়মান ॥ শামীম চালাক চতুর ড্রাইভার। বেশ সচেতন। তবুও তিনি গাফিলতি করেই ঝুঁকি নিয়ে চালাতেন গাড়িটা। ফুয়েলিং করার সময় গাড়ির কাছে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও তিনি নিরাপদ দূরত্বে আশ্রয় নেননি। এ ভুলের কারণেই জীবন দিতে হয়েছে তাকে। গত শুক্রবার আশুলিয়ার কাছে একটি ফিলিং স্টেশনে সিএনজি সিলিন্ডারে গ্যাস নেয়ার সময় নিজের গাড়ি বিস্ফোরণে শামীমসহ অপর একজনের করুণ মৃত্যু ঘটে। শামীমের মতো এমন ১৬ জন প্রাণ হায়িছেন গত দু’ বছরে। এ সব ঘটনা তদন্তে যে সব তথ্য উঠে আসে সেগুলো আরও ভয়াবহ। শিউরে ওঠার মতো। বছরের পর বছর ধরে কেউ শিকার হচ্ছেন শামীমের মতো এমন গাফিলতি, উদাসীনতার, কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডারের দরুন। প্রাণ হারানোর এ সংখ্যা ক্রমশই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে নগর থেকে গ্রামÑ সর্বত্র। কিন্তু এ ধরনের বিস্ফোরণের দায় কার? এ সম্পর্কে অনুসন্ধানে দেখা যায়- সরকারের কোন মহলই এর দায় নিতে চাচ্ছে না। আরও অবিশ্বাস্য হচ্ছে-ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার করলেও কোন প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। এ জন্য নেই কোন সুনির্দিষ্ট আইন বা শাস্তির বিধান। সিএনজি চালিত যানবাহন বিস্ফোরণে একের এক দুর্ঘটনা ঘটলেও টনক নড়ছে না কোন মহলেরই। উপযোগী আইন না থাকায় সংবিধিবদ্ধ ব্যবস্থা নেয়াও যাচ্ছে না। বিস্ফোরক অধিদফতর, বিআরটিএ ও সিএনজি কর্তৃপক্ষ দায় চাপাচ্ছে পরস্পরের ওপর। যে কারণে প্রচ- ঝুঁকির মাঝেই চলতে হচ্ছে যাত্রী সাধারণকে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সারাদেশে এ পর্যন্ত সিএনজি চালিত যানবাহনের সংখ্যা হচ্ছে ২ লাখ ৯৮ হাজার। অর্থাৎ এগুলো কনভার্সন করা হয়েছে গ্যাসে। রাজধানীসহ দেশব্যাপী বৈধ ও অনুমোদিত সিএনজি কনভার্সন সেন্টার রয়েছে ১৮০টি। রাজধানীতেই রয়েছে ২৬টি। এ সব যানবাহনের জন্য সারাদেশে ৫৮৭টি সিএনজি ফিলিং স্টেশন রয়েছে। সিএনজি চালিত এসব গাড়ির রিটেস্ট করার জন্য কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ১১টি। এত কমসংখ্যক কেন্দ্রের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয় ২ লাখ ৯৮ হাজার গাড়ির সিলিন্ডার রিটেস্ট করা। ঝুঁকিটা এখানেই্। হাতে গোনা কিছুসংখ্যক গাড়ি ছাড়া লাখ লাখ গাড়ি চলছে রিটেস্ট ছাড়াই। আর অননুমোদিত সিএনজি কনভার্সনের সংখ্যা অসংখ্য। এসব কেন্দ্রে দায়সারাভাবে ত্রুটিয্ক্তু ও সিএনজি সিলিন্ডার প্রতিস্থাপন করা হয়। যার ব্যয়ও অনেক কম। গাড়ির মালিকরা এসব অবৈধ কেন্দ্রেই ঝুঁকছে। গলদটা এখানেই। সবচেয়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হচ্ছে-আন্তর্জাতিক মান ও সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর এ সব গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক হলেও বেশির ভাগ মালিকই তা মানছে না। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার নিয়েই মারণাস্ত্রের মতো ঝুঁকিতে চলছে এসব যানবাহন। এ তো গেল বৈধ সিএনজি গাড়ির চিত্র। তার পাশে অবৈধ সংখ্যার চিত্রটা কী ? এ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৮০টি বৈধ কনভার্সন সেন্টার ছাড়াও আরও শতাধিক অবৈধ সেন্টার রয়েছে। যেগুলো কমদামে কম সময়ে সার্ভিস দিতে পারায় মানুষ ওখানেই গিয়ে ভিড় জমায়। ওই সব সেন্টারের গ্রাহকদের বেশিরভাগই পাবলিক বাসের মালিক। রাজধানীসহ দেশবাপী বেশ কিছু কোম্পানির বাস-মিনিবাস সিএনজিতে কনভার্ট করা হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই অবৈধ সেন্টারে গিয়ে ত্রুটিপূর্ণ অবস্থায় গ্যাস সিলিন্ডার সংযোজন করা হয়েছে। রাজধানীতেই এ সংখ্যা বেশি। আর জনজীবনের ঝুঁকিটা এখানেই বেশি। প্রতিটি গাড়িই ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি রাজধানীসহ সাভার, মানিকগঞ্জ, সিলেট ও চট্টগ্রামে যে কয়টা বাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটেছে- প্রতিটিতেই দেখা গেছে ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডার। এ সব সিলিন্ডারে ছিল না কোন সেফটি সিষ্টেম। সেফটি সিস্টেমটা কী জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী বলেন, একসেস ফ্লো বাল্ব ও শাট অফ বাল্ব। এ দুটো গ্যাসের চাপের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখে। যে কারণে এগুলোতে বিস্ফোরণের আশঙ্কা কম। কিন্তু এলপিজি বা অক্সিজেন সিলিন্ডারে এ ধরনের সেফটি সিস্টেম না থাকায় গ্যাসের চাপ কম বেশি হওয়ায় তা বিস্ফোরণ ঘটে। বর্তমানে গাড়িতে ব্যবহারের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা প্রতিটি সিলিন্ডারেই রয়েছে সেফটি সিস্টেম। এ সম্পর্কে সূত্রগুলো জানায়, চরম ঝুঁকি জেনেও গাড়ির মালিকরা প্রতি পাঁচ বছর পর পর এসব সিলিন্ডার পরীক্ষার করা বাধ্যতামূলক থাকলেও সেটা মানছে না। ঢাকা, গাজিপুর, সিলেট, চট্টগ্রামÑ মোট ১১টি রিটেস্ট সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে ৮টি চালু রয়েছে। বাকি তিনটি লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলেও অপারেশন শুরুই করেনি। প্রয়োজনের তুলনায় এগুলো অনেক অপ্রতুল। তদুপরি গাড়ির মালিকরা যেতে ইচ্ছুক নন। রিটেস্ট করাকে বাড়তি ঝামেলা ও ব্যয়বহুল মনে হওয়ায় পাঁচ বছর উত্তীর্ণ জেনেও মালিকরা গাফিলতি করছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই চলছে আড়াই লাখেরও বেশি ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডারের গাড়ি। প্রতিটি গাড়িকেই মারণাস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করছেন বিস্ফোরক অধিদফতরের পরিচালক শামসুল আলম। বলেছেন- নাশকতায় ব্যবহৃত গ্রেনেড বা মারণাস্ত্রের মতোই বিধ্বংসী বিস্ফোরক এগুলো। এটা হয়ত অনেকেই জানেন না কিন্তু যারা জানেন তারাও গাফিলতি করেই ঝুঁকি নিচ্ছেন, জীবন নিয়ে খেলছেন, মৃত্যুর সঙ্গে তামাশা করছেন। আশুলিয়া ও চট্টগ্রামে বিস্ফোরিত দুটো গাড়ির সিলিন্ডারেই ত্রুটি ধরা পড়েছে। এ সব ত্রুটি দেখভাল করার দায়িত্বে নেই কোন মহল। জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মোঃ নজরুল ইসলাম বলেছেন- “এটা জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও গ্যাস কর্তৃপক্ষ দেখভাল করতে পারে। বিআরটিএ শুধু গাড়ির ফিটনেস নিয়ে কাজ করে। তবে ফিটনেসের বিষয়টা তো সিলিন্ডারের সঙ্গেও সম্পর্কিত সে বিবেচনায় তো বিআরটিএ এটাকে আইনের আওতায় আনতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন, এটা ভাল প্রস্তাব। দেখা যাক। প্রশ্ন উঠছেÑ দায় কার? এ প্রশ্ন করি বিস্ফোরক অধিদফতর, বিআরটিএ ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস লিমিটেড (আরপিজিএল) কাছে। তারা কেউ দায় নিতে রাজি নন। বিস্ফোরক অধিদফতরের পরিচালক শামসুল আলম বলেছেন- যেহেতু সিএনজি কনভার্সন সেন্টারের লাইসেন্সটা আরপিজিএল দিয়ে থাকে, দায়িত্বটা তাদেরই। যিনি লাইসেন্স দেন তিনিই দেখবেন দেশের অন্য কেউ অবৈধভাবে সেই একই জিনিস দিচ্ছে কিনা। বিস্ফোরক দফতর থেকে দেয়া হয় শুধু সিএনজি ফিলিং স্টেশনের অনুমতি। জানতে চাইলে আরপিজিএল মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা লাইসেন্স দেই ঠিকই। কিন্তু দেখভাল করব কিভাবে? রাজধানীসহ দেশব্যাপী ১৮০টি কনভার্সন সেন্টার পরিদর্শন করে খোঁজ নিতে গেলে প্রচুর জনবল দরকার। অথচ ঢাকাতে আরপিজিএল অফিসে মাত্র চার জন পরিদর্শক রয়েছেন। তারা তো রাজধানীরগুলোই পরিদর্শন করতে পারছে না নিয়মিত। তারপরও দুর্ঘটনার পর আমাদেরকেই তদন্ত করতে হচ্ছে। জানা যায়, বর্তমানে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড আরপিজিসিএল রাজধানীসহ সারাদেশে সিএনজি কনভার্সন সেন্টার ও ফিলিং সেন্টারের অনুমোদন দিয়ে থাকে। ১৯৮৬ সালের দিকে ঢাকায় প্রথম যানবাহনে সিএনজি কনভার্সন চালু করা হয়। কিন্তু ২০০১ সাল থেকে রাজধানীসহ দেশব্যাপী সিএনজি ফুয়েলিং সেন্টার চালুর অনুমোদন দেয়া হয় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। তারপর হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সিএনজি কনভার্সন গাড়ি। এ কারণে গত পনেরো বছরে ২ লাখ ৯৮ হাজার যানবাহন (বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও থ্রি হুইলার) সিএনজিতে কনভার্সন করা হয়। এখনও সেটা ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে রাজধানীতে অনুমোদিত কনভার্সন সেন্টারে ভালভাবে একটি প্রাইভেট কারের সিএনজি সিলিন্ডার বসাতে খরচ হয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু এই কাজটিই অননুমোদিত সেন্টারে করা যাচ্ছে মাত্র ৪০ হাজার টাকায়। ফলে মালিকরা সেদিকেই ছুটছেন বেশি। অননুমোদিত কনভার্সন সেন্টার কতটা ভয়াবহ জানতে চাইলে সিএনজি সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানির মালিক জনকণ্ঠকে বলেন, “বৈধ আর অবৈধ ব্যবধানটা শুধু ব্যয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মানের দিক থেকেও পার্থক্য বিস্তর। ৬০ হাজার টাকার কাজ কেউ যদি ৪০ হাজার টাকায় করে সেখানে অবশ্যই গুণগত মানে ছাড় দেয়া হয়। সেখানে ত্রুটিপূর্ণ ও কমদামী সিলিন্ডার লাগানো হয়।” এদিকে গত তিন বছরে ঘটে যাওয়া বি্েস্ফারণ দুর্ঘটনার শিকার যানবাহনের ক্ষতিগ্রস্ত মালিক ও চালকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রতিটিতেই সিলিন্ডারে ত্রুটি ছিল। ঠিকমতো প্রতিস্থাপন করা হয়নি। কয়েকটা ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। অথবা ভাল সিলিন্ডার থাকলেও সেটা দক্ষ হাতে সংযোজিত করা সম্ভব হয়নি। মূলত এগুলোই এখন বিস্ফোরণের কারণ হচ্ছে। গত সপ্তাহে চট্টগ্রামে যে গাড়িতে বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়, সেটারও সিলিন্ডারে ত্রুটি ছিল। ওই গাড়ির সিলিন্ডার কোন্ কনভার্সন সেন্টারে করা হয়েছিল এখন সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিস্ফোরক দ্রব্য অধিদফতর থেকে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান কাজ শুরু হয়েছে। বিস্ফোরক দ্রব্য অধিদফতরের পরিচালক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে যানবাহনে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যÑ দেখার কেউ নেই। আসলে এটা দেখভাল করার দায়িত্ব বিআরটিএ-এর কাছেই দিতে হবে। গাড়ির ফিটনেস দেয়ার মতোই সিএনজি সিলিন্ডারের ফিটনেসও তাদেরই দেখতে হবে। তিনি বলেন, পাঁচ বছর পর পর প্রতিটি গাড়ির মালিকেরই উচিত নিজ উদ্যোগে তার সিলিন্ডার রিটেস্ট করা। সারাদেশে ১১টি রিটেস্ট সেন্টার রয়েছে। সেখানে নিয়ে গেলে অবশ্যই ধরা পড়বে কোন সিলিন্ডারের অবস্থা কেমন। কোন সিলিন্ডারে ত্রুটি থাকলে সেটা তাৎক্ষণিক জব্দ করার বিধান থাকা উচিত। কিন্তু এমন কোন বাধ্যবাধকতার আইন নেই। বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞদের মতে, রিটেস্টে ত্রুটি ধরা পড়লেও সেগুলো আবার কম দামে অন্যরা কিনে নিয়ে গাড়িতে ব্যবহার করে। যা চরম ভয়ানক। ত্রুটিপূর্ণ বা অযোগ্য সিলিন্ডার গাড়িতে ব্যবহার করা মানে মারণাস্ত্রের সঙ্গে বসবাস। আর ভাল সিলিন্ডারে দুর্ঘটনার আশঙ্কা একেবারেই নেই বললে চলে, শতকরা হারে ০.১ ভাগেরও কম। তবে ভাল সিলিন্ডারেও বিস্ফোরণ ঘটছে শুধু গাড়ির ফিটনেসের অভাবে। গাড়ির পেছনে লাইট না থাকার কারণে রাতে অন্য গাড়ি যদি ধাক্কা দেয় তাহলে তো ভাল সিলিন্ডারও বিস্ফোরণ ঘটবে। জানা যায়, এসব কনভার্সন সেন্টারের লাইসেন্সিং অথরিটি রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিঃ (আরপিজিসিএল)-এর অনুমোদন ছাড়াই সিএনজি কনভার্সন সেন্টার চালানো অবৈধ অথচ খোদ রাজধানীতেই এ রকম প্রায় ১৮টি কনভার্সন সেন্টার রয়েছে। যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, ধোলাইখাল, বিজয়নগর, মিরপুর শেওড়া ও মুগদাসহ বেশ কয়েকটা জায়গায় এসব অবৈধ কসভার্সন সেন্টার রয়েছে। যেখানে প্রতিদিনই গাড়িতে সংযুক্ত করা হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ সিএনজি সিলিন্ডার। এ সব অননুমোদিত সেন্টারে বেশিরভাগই হলার, থ্রি হুইলার ও অন্যান্য কম দামী গাড়ির মালিকরাই ভিড় জমায়। তারা কত পয়সায় দ্রুততম সময়ে গাড়ি কনভার্ট করার প্রতি বেশি আগ্রহী। চট্টগ্রাম ও মানিকগঞ্জের বিম্ফোরণের শিকার গাড়ি দুটোর সিলিন্ডারও এ ধরনের অননুমোদিত সেন্টার থেকেই কনভার্সন করা হয়েছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে ধরা পড়ে। গত অক্টোবরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে একটি বাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায় এবং তাতে ১৫ জন আহত হয়। এর আগের বছর ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মানিকগঞ্জে একটি বাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৬ জন নিহত হয়। পরে তদন্তে দেখা যায়, ওই দুটো বাসের সিলিন্ডারেও বড় ধরনের ত্রুটি ছিল। এসব বিষয়ে আরপিজিসিএলের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী জনকণ্ঠকে বলেন, এ সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাছে যাতে তারা বিআরটিএ-এর ফিটনেস দেয়ার মতো এ বিষয়টি দেখে গাড়ির সিলিন্ডার ঠিকমতো পাঁচ বছর পর পর রিটেস্ট করা হয়েছে কিনা। কিন্তু এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। দেশে রিটেস্ট সেন্টার কম থাকার কারণ দেখিয়ে তা বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মতামত দেয়। কিন্তু দুর্ঘটনা তো আর তার জন্য অপেক্ষায় থাকে না। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আরপিজিসিএল দেশে সিএনজি কনভার্সন সেন্টার ও ফিলিংস্টেশনের লাইসেন্স দিয়ে থাকে এবং সেটা সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী চলছে কিনা সেটার দেখভাল করে। এ সম্পর্কে বিআরটিএ পরিচালক প্রকৌশল নুরল ইসলাম বলেন, বর্তমানে যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছে ১৯৮৩ সালের যানবাহন অধ্যাদেশ ও ’৮৪ সালে যানবাহন রুল অনুযায়ী। তখন দেশে যানবাহনে সিএনজি চালু ছিল না। সেজন্য সেটা এর আওতায় পড়েনি। এ জন্য বিআরটিএ-এর করার কিছু নেই । কী কারণে বিস্ফোরণ ঘটছে জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী জানান, অনেক ফ্যাক্টর এখানে কাজ করছেÑ প্রথমত, দেখতে হবে সিলিন্ডারটা ভাল কিনা। তারপর সিলিন্ডার ভাল হলেই যে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে তেমনটাও নয়। গাড়ির ফিটনেস যদি না থাকে তাহলে সেখানে সিলিন্ডার ঠিকমতো লাগানোর পর গাড়ির দুর্ঘটনার দরুন সেটা বিস্ফোরিত হতে পারে। আবার দেখা যাচ্ছে সিএনজির জন্য সুনির্দিষ্ট সিলিন্ডার না লাগিয়ে অন্য সিলিন্ডার যেমন অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এলপিজি সিলিন্ডার লাগানো হয়েছে। সে ক্ষেত্রেও বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা খুবই বেশি। কেননা যানবাহনে যে সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে থাকে ৩ হাজার পিএসআই সহ্য ক্ষমতা। কিন্তু এলপিজি বা অক্সিজেন সিলিন্ডারে এত পরিমাণ পিএসআই থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গাড়ির সিলিন্ডারের জন্য কমপক্ষে তিন হাজার পিএসআই দরকার। কিন্তু এ পরিমাণ পিএসআই ক্ষমতা অক্সিজেন এলপিজি সিলিন্ডারে না থাকায় তা যানবাহনে ব্যবহার নিষিদ্ধ অথচ দেখা যায়, মানুষ অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে হলার ও ছোট্ট পিকআপ ভ্যান চালাচ্ছে। এসব সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা বা ফিলিং করার সময়েই বিস্ফোরণ ঘটে যায়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীতে এ ধরনের হলার, পিকআপ ভ্যান বা ছোট ট্রাকগুলোতেও এলপিজি বা অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। হাসপাতালে ব্যবহৃত অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে গ্যারেজে গিয়ে মেকানিক নিজের হাতেই নাট-বল্টু পেঁচিয়ে লাগাচ্ছে। এমনটি অহরহ ঘটছে। এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আলী বলেছেন, অবিশ্বাস্য ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। নিয়ম হচ্ছে পেট্রোল গাড়িকে সিএনজি সিলিন্ডার লাগিয়ে কনভার্ট করা। কিন্তু এখন ডিজেল গাড়িকে পেট্রোল গাড়িতে রূপান্তরিত করে তারপর সেটাতে লাগানো হচ্ছে সিএনজি সিলিন্ডার। এটা যে কত ভয়ঙ্কর সেটাও তারা বুঝতে পারছে না। এদিকে আশুলিয়া ও চট্টগ্রামে দুদিনের ব্যবধানে দুুটো ভয়াবহ বিস্ফোরণে দুটো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে প্রাণহানির ঘটনায় রাজধানীতে গাড়ির মালিক ও যাত্রী সাধারণের মাঝে আতঙ্ক নেমে আসে। সিএনজি যানবাহনের মালিকরা এখন স্বতঃস্ফূর্ত ছুটছেন গাড়ি রিটেস্ট করতে। পাঁচ বছর অতিক্রম হয়ে যাওয়া গাড়ির মালিকরা ভিড় জমাচ্ছেন রিটেস্ট সেন্টারে। রাজধানীর নিকুঞ্জে আরপিজিসিএলের নিজস্ব কেন্দ্রেও বাণিজ্যিকভিত্তিতে রিটেস্ট করার সুযোগ রয়েছে। রবিবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি গাড়ির ভিড়। তারা লাইন ধরছেন গাড়ির সিলিন্ডার ঠিক আছে কিনা, সেটা টেস্ট করতে। এ সম্পর্কে আরপিজিসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এটা তো খুব বেশি ব্যয়বহুল নয়। মাঝারি ধরনের একটা সিলিন্ডার টেস্ট করতে হাজার তিনেক টাকা খরচ হয় আর সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েক অথচ এটা না করে মানুষ এত বড় ঝুঁকি নিচ্ছে কেন সেটা বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারে মানুষকে সজাগ ও সচেতন করতে হবে। এটা যে সামান্য ভুল বা গাফিলতির দরুন মারণাস্ত্রের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে সেটা জানাতে হবে মানুষকে। আরপিজিসিএল ইতোমধ্যে এ জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রতিটি ফিলিংস্টেশনে সতর্কবার্তা রয়েছে রিফুয়েলিং করার সময় যেন যানবাহনের যাত্রী ও চালককে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। একইভাবে নকল কনভার্সন সেন্টারে গিয়ে কেউ যেন গাড়িতে সিএনজি সিলিন্ডার না লাগায় সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে গাড়ির ফিটনেসের দায়িত্ব পালনকারী বিআরটিএ একটি মূল ভূমিকা পালন করতে পারে।
×