ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মহীসোপান নিয়ে শ্রীলঙ্কার অবৈধ দাবির বিরুদ্ধে জাতিসংঘে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৮ এপ্রিল ২০১৬

মহীসোপান নিয়ে শ্রীলঙ্কার অবৈধ দাবির বিরুদ্ধে জাতিসংঘে বাংলাদেশ

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ বঙ্গোপসাগরের সীমানায় মহীসোপানের দাবিতে শ্রীলঙ্কা জাতিসংঘের কাছে যে দাবি তুলেছে, তাতে আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা তার সমুদ্রসীমার ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপানের অধিকার নির্ধারণের জন্য ইতোমধ্যেই দাবি তুলেছে জাতিসংঘে। এই দাবির বিপক্ষে জাতিসংঘের কাছে আপত্তিপত্র পেশ করেছে বাংলাদেশ। এদিকে শ্রীলঙ্কা সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মালদ্বীপের সঙ্গেও বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। সূত্র জানায়, জাতিসংঘের মহীসোপান নিষ্পত্তি সংক্রান্ত কমিশনে (সিএলসিএস) সমুদ্র মহীসোপানের দাবিতে শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যেই আবেদন করেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শ্রীলঙ্কার আবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মহীসোপানের একটি অংশ দাবি করেছে শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি আপত্তিপত্র সিএলসিএস’র কাছে জমা দিয়েছে। আপত্তিপত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে শ্রীলঙ্কা সমুদ্রসীমায় যে মহীসোপান দাবি করছে, সেটা তাদের সীমানা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের বেশি। এছাড়া যেখানে সমুদ্রতল আড়াই হাজার মিটার গভীর সেখান থেকে আরও ১০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি মহীসোপান তারা দাবি করছে। অথচ সিএলসিএসের আর্টিক্যাল ৭৬(৫) অনুযায়ী এই দুটি দাবিই বৈধ নয়। বিষয়টি বিবেচনা করা জন্য গত ৭ এপ্রিল জাতিসংঘের সিএলসিএস’র কাছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কা যেন তাদের দাবি আদায় করতে না পারে, তার জন্য বাংলাদেশ সব ধরনের চেষ্টা করে চলেছে। কেননা জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী কোন দেশ তার সীমানা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল বা যেখানে সমুদ্র তল আড়াই হাজার মিটার গভীর তার ১০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি মহীসোপান দাবি করতে পারে না। কিন্তু শ্রীলঙ্কা প্রায় এক হাজার নটিক্যাল মাইল মহীসোপান দাবি করেছে, যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের মহীসোপান রয়েছে। শ্রীলঙ্কা জাতিসংঘের কাছে মহীসোপান দাবি করার পরে বিষয়টি সমাধানের জন্য কলম্বো ও ঢাকার মধ্যে আলোচনার চেষ্টা চালানো হয়। তবে কলম্বো কোনভাবেই এ নিয়ে আলোচনার জন্য রাজি হয়নি। সে কারণে সিএলসিএস নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দ্বীপ দেশ হিসেবে পরিচিত শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যেই ভারত ও মালদ্বীপের মহীসোপানের বিরুদ্ধেও আপত্তি তুলেছে। ওই দুই দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য সিএলসিএস কাছে আবেদন করেছে কলম্বো। ভারতের চেয়ে মালদ্বীপের মহীসোপানের অংশই বেশি দাবি করেছে শ্রীলঙ্কা। এছাড়া ভারতের সীমানায় শ্রীলঙ্কার জেলেদের মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ লেগেই আছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য দিল্লী-কলম্বো একাধিকবার আলোচনাও করেছে। তবে সে সমস্যার সমাধান হয়নি। সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি নিয়ে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে মামলা হয়েছিল। এই দুই দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর সালিশি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ জার্মানির হামবুর্গভিত্তিক সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (ইটলস) মামলা করেছিল। ২০১২ সালের ১৫ মার্চ ইটলস বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেয়। এরপর ২০১৪ সালের ৭ জুলাই নেদারল্যান্ডের স্থায়ী সালিশি আদালতে (পার্লামেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন-পিসিএ) বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। এদিকে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পরও সেটা এখন মানতে নারাজ মিয়ানমার। দেশটি আবারও সমুদ্রসীমানায় বাংলাদেশ ও ভারতের একটি অংশ দাবি করেছে। তবে মিয়ানমারের দাবিকে অযৌক্তিক বলেছে বাংলাদেশ। কেননা আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পরে তারা কোনভাবেই এই অংশ দাবি করতে পারে না। মিয়ানমারের দাবির বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণ বিষয়ক কমিশনের (সিএলসিএস) কাছে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ ও ভারতের মহীসোপানের অংশ দাবি করেছে। গত বছরের নবেম্বরে জাতিসংঘের সিএলসিএস’র কাছে চিঠি দিয়ে মিয়ানমার মহীসোপানের অংশ দাবি করে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মিয়ানমারের দাবি প্রত্যাখ্যানের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের কাছে পাল্টা চিঠি দেয়া হয়েছে। ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা আইনবিষয়ক সনদের অষ্টম অনুচ্ছেদের ৭৬তম ধারা অনুসরণ করে বঙ্গোপসাগরে মহীসোপানের অংশ দাবি করে মিয়ানমার। এ বিষয়ে সিএলসিএস’র কাছে নানা তথ্য উপাত্তও জমা দেয় দেশটি। এরই মধ্যে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে যায়। এই সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পরে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেছিল, সমুদ্রসীমানা সংক্রান্ত সমস্যাটি মিটে গেছে। এখন আর এটি নিয়ে কোন সমস্যা হবে না। তবে মিয়ানমার গত নবেম্বর মাসে সিএলসিএস’র কাছে একটি সংশোধিত প্রস্তাব জমা দেয়। এই সংশোধিত প্রস্তাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মহীসোপানের অংশ দাবি করে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল পেয়েছে। এছাড়া সমুদ্রে ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার অধিকারও পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে আদালতে নিষ্পত্তি হওয়ার পরও মহীসোপান নিয়ে মিয়ানমার আপত্তি তুলেছে। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কার মহীসোপানের দাবির বিপক্ষে এবার আপত্তি তুলল বাংলাদেশ।
×