ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অসংক্রামক রোগে মৃত্যু ঝুঁকি ভবিষ্যতে আরও প্রকট হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৮ এপ্রিল ২০১৬

অসংক্রামক রোগে মৃত্যু ঝুঁকি ভবিষ্যতে আরও প্রকট হবে

নিখিল মানখিন ॥ ক্যান্সার, হৃদরোগ, লিভার, কিডনি, ডায়বেটিস, ফুসফুসসহ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা, সরকারী দিকনির্দেশনার অভাব, সংক্রামক রোগের প্রতি বেশি মনোযোগ ইত্যাদি কারণেই মূলত অসংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটছে বেশি। আইসিডিডিআর’বির সর্বশেষ প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে অবশ্য উল্লেখ করা হয়, সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে অসংক্রামক রোগের গুরুত্ব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মহিলার মধ্যে অসংক্রামক রোগের অন্তত একটি রিস্ক ফ্যাক্টর পাওয়া যাবে। এই হার পুরুষদের ক্ষেত্রে ৯৯.৬ শতাংশ এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৯৭.৯ শতাংশ। দেশের মানুষের সার্বিক অসুস্থতার মধ্যে ৬১ শতাংশের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ ও আঘাতজনিত কারণ। এর ফলে মানুষের জীবনের একপর্যায়ে অক্ষমতা দেখা দেয়ায় জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাচ্ছে। আগামী কয়েক দশকে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অসংক্রামক রোগের কারণে মৃত্যু ও অসুস্থতার বিরূপ প্রভাব আরও প্রকট হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অসংক্রামক রোগ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রচার কার্যক্রম শুধুমাত্র সেমিনার এবং ওয়ার্কশপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এক্ষেত্রে বিশেষ কোন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে না এবং অসংক্রামক রোগের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো প্রতিরোধের ওপর গুরুত্বও কম দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এখনও অসংক্রামক রোগকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্ট জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি হয়নি এবং বর্তমানে অসংক্রামক রোগসৃষ্ট অসুস্থতা এবং মৃত্যু অথবা এর রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর জন্য কোন নিয়মিত নিরীক্ষা ব্যবস্থা নেই। আরও দেখা গেছে যে, সীমিত জনবল ও কারিগরি দক্ষতার কারণে স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রচারও সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। অসংক্রামক রোগগুলো এইচপিএনএসএসপি’র অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রচার চলছে না। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, অসংক্রামক রোগের প্রতিরোধ ও জরিপের জন্য প্রণীত কর্মকৌশল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলকে সম্পৃক্ত করার প্রক্রিয়া নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য পাইলট কার্যক্রমের মাধ্যমে এনসিডি কর্নার নামের একটি বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালু করলেও প্রকৃতপক্ষে এর ভূমিকা ও কর্মকা- এখনও অসম্পূর্ণ এবং অস্পষ্ট। হৃদরোগ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী জটিল রোগ, ক্যান্সার প্রভৃতি অসংক্রামক রোগের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ছয় লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৬০ শতাংশের বয়স ৭০ বছরের কম। অসংক্রামক রোগের বর্তমান ব্যাপকতা এবং ভবিষ্যতে মহামারী আকারে দেখা দেয়ার আশঙ্কা বিবেচনা করে আইসিডিডিআর’বি একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অসংক্রামক রোগের ব্যাপকতা মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত এবং কতটা সক্ষম তা মূল্যায়ন করাই এর উদ্দেশ্য। প্রতিষ্ঠানের ‘সেন্টার ফর কন্ট্রোল অব ক্রনিক ডিজিজেস’ (সিসিসিডি) চারটি মুখ্য দিকের ওপর ফ্রেমওয়ার্কভিত্তিক পর্যালোচনার মাধ্যমে গবেষণাটি পরিচালনা করে। দিকগুলো হলোÑ সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিশ্রুতি সৃষ্টি করা, জননীতিগুলোর পুনর্বিন্যাস করা, সেবাদান ব্যবস্থার নতুন মডেল তৈরি করা এবং সমতা নিশ্চিত করা। বর্তমানে অসংক্রামক রোগের চিকিৎসাসেবা প্রধানত হাসপাতালগুলোতে এবং বড় শহরগুলোতে পাওয়া যায়। সারাদেশে এসব সুযোগ-সুবিধা না থাকায় স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যসেবা বণ্টনে অসমতা দেখা দিচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় সমতার বিষয়টি সাধারণভাবে যাচাই করা হলেও অসংক্রামক রোগের জন্য চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি এবং এসব রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যয়ের ক্ষেত্রে সমতার বিষয়টি কেউ যাচাই করেনি। সমতার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার মতো কোন চলমান কর্মসূচী নেই। যাদের অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি তাদের নিয়ে পরিচালিত কোন গবেষণার তথ্যও পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি এবং অর্থ প্রদানে সমতা সংক্রান্ত কোন মূল্যায়ন কর্মকা- দেখা যায়নি। দিকনির্দেশনা নেই ॥ অভিযোগ রয়েছে, অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় কোন জাতীয় দিকনির্দেশনা নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে নেই কোন ব্যবস্থাপনা। প্রথমবারের মতো এ জাতীয় রোগ নিয়ে বিশেষ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর। বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিজেদের মতো করে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এ জাতীয় রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে বিশেষ কার্যক্রম সাজাতে গিয়ে পদে পদে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যয় দেশের অধিকাংশ মানুষের সামর্থ্যরে বাইরে। অনেক রোগের শতভাগ চিকিৎসাই দেশে নেই। চিকিৎসার অভাবে অনেক রোগীকে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের (আর্সেনিক ও এনসিডি) বিভাগ জানায়, অসংক্রামক রোগ মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। অনেকগুলো অসংক্রামক রোগের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছেÑ কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ (সিভিডি), ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কোচনজনিত রোগ। বর্তমানে দেশে অসংক্রামক রোগের শতকরা ১৭.৯ ভাগ উচ্চ রক্তচাপে, ৩.৭ ভাগ ক্যান্সারে, ৩ ভাগ এ্যাজমায়, ৩.৯ ভাগ ডায়াবেটিসে ও ২.৪ ভাগ ভুগছে স্ট্রোকে। সংক্রামক রোগকে অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে নীরব ঘাতক অসংক্রামক রোগ উপেক্ষিত রয়ে গেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব আজ সমগ্র জাতির সামনে দৃশ্যমান। অধিকতর কারিগরি নির্ভরশীলতা আমাদের কম কায়িক পরিশ্রম এবং অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবারের দিকে ধাবিত করছে, যার প্রেক্ষিতে বর্তমানে অসংক্রামক রোগের মাত্রা বেড়েই চলেছে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা ॥ দেশে যে কয়েকটি বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা হয় তার ব্যয় সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপনের কোন ব্যবস্থা নেই বাংলাদেশে। লিভার প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, একজন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রায় ১৮শ’ থেকে ২২শ’ গ্রাম লিভার থাকে। এর দুই-তৃতীয়াংশ অন্যত্র ব্যবহৃত হতে পারে। স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার গড়ে উঠলে এ ব্যয় ৩০ থেকে ৩৫ লাখে নেমে আসতে পারে। এ কাজ সম্পন্ন করতে সিঙ্গাপুরে আড়াই কোটি টাকা এবং ভারতে লাগে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। দেশের শত শত লিভার রোগীর পক্ষে কোটি টাকা যোগাড় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। একই অবস্থা বিরাজ করছে কিডনি চিকিৎসার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ রেনাল এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন খুবই ব্যয়বহুল। একজন রোগীর প্রতি সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে প্রাইভেট হাসপাতালে প্রায় ১০ হাজার টাকা চলে যায়। কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। বিদেশে এ রোগের চিকিৎসা ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, নিজেরা কিডনি দেয়ার পরও সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা, থাইল্যান্ডে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং ভারতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা লাগে সংযোজনের জন্য। প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার রোগীর কিডনি পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি জানায়, দেশে বর্তমানে ৬০ লাখ ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। আগামী ২০৩০ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম স্থানে। নানা কর্মসূচী অব্যাহত রাখার পরও দেশের ৬০ লাখ ডায়াবেটিস রোগীর মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ রোগীকে স্বাস্ব্যসেবার আওতায় আনতে পেরেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। সমিতি নিজ থেকে সারাদেশে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ কার্যক্রমে নামলেও জাতীয়ভাবে এ রোগ মোকাবেলায় কোন দিকনির্দেশনা নেই। ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী জানান, পৃথিবীতে মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ক্যান্সারকে ধরা হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। পৃথিবীতে যত মৃত্যু হয় তার প্রায় শতকরা ১৩ ভাগ ঘটে ক্যান্সারের কারণে। প্রতি বছর ফুসফুসের ক্যান্সারে ১৩ লাখ, পাকস্থলীর ক্যান্সারে ৮ লাখ, মলদ্বারের ক্যান্সারে ৬ লাখ ৩৯ হাজার এবং স্তন ক্যান্সারে মারা যায় ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ। আর বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৮ জন আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে ১ দশমিক ৩ জন। আর প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা না পড়লে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর পরিবারকে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে পথে বসা ছাড়া উপায় থাকে না। বিভিন্ন ধরনের থেরাপি দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে যায় রোগীর পরিবার। আর বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করাতে দেশের বাইরে ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকা লাগে। দেশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন সেন্টার চালু হলেও তা এখনও সীমিত পরিসরে রয়েছে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, উচ্চ রক্তচাপ রোগটিকে বিশ্বব্যাপী নীরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপে হার্ট এ্যাটাক, ব্রেন এ্যাটাক (স্ট্রোক), হৃদরোগ, কিডনি বিকল এবং অন্ধত্ববরণের ঝুঁকি থাকে। বিশ্বে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ আক্রান্ত হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপে। এ রোগের চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে অবশ্য এই রোগের চিকিৎসা এখন সহজলভ্য।
×