ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আইন, তথ্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য

সুনির্দিষ্ট মামলায় শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৮ এপ্রিল ২০১৬

সুনির্দিষ্ট মামলায় শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সাংবাদিকতার জন্য নয়, অপরাধে সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকায় শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। রবিবার সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, তাকে সুনির্দিষ্ট মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সেই মামলা এখন তদন্তাধীন আছে। তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তিনি মুক্তি পাবেন। রবিবার বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে একটি কর্মশালা উদ্বোধনের পর মন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন। একই কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা চেষ্টায় জড়িতদের সঙ্গে সাংবাদিক শফিক রেহমানের কথোপকথন হয়েছিল- এমন তথ্যের ভিত্তিতেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর সঙ্গে অন্য একটি পত্রিকার সম্পাদকও জড়িত রয়েছে, যিনি বর্তমানে কারাবন্দী। রবিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানম-ি বিলিয়া অডিটরিয়ামে ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আমার কাছে এমন তথ্য নেই যে এখানে ৮ হাজার জঙ্গী রয়েছে। যেগুলো লুকিয়ে রয়েছে বা অপকর্ম করার চেষ্টা করছে। তারা সকলে গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। তথ্যমন্ত্রী বলেন, আইনের উর্ধে কেউ নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই নীতি কার্যকর করছে। সংবাদপত্রে চর্চার জন্য শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়নি। সুনির্দিষ্ট ও ভিন্ন অপরাধজনিত কাজের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণেই প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হওয়ায় তাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেছে। সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের পূর্ণ সুযোগ আছে। নির্দোষ হলে সসম্মানে বেরিয়ে আসবেন। এটা সংবাদপত্র, গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। শনিবার সকালে রাজধানীর ইস্কাটনের বাসা থেকে শফিক রেহমানকে ধরে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ চক্রান্তের মামলায় গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। পরে ওই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের অনুমতিতে তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এই সাংবাদিককে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে সরকারের চরম স্বেচ্ছাচারিতার বহির্প্রকাশ ঘটেছে। তবে বিএনপি ঘনিষ্ঠ এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার প্রমাণ আছে বলে দাবি করেছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। যুক্তরাষ্ট্রে তার সম্পর্কে তথ্য পেতে এফবিআই কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার অপরাধে এক বিএনপি নেতার ছেলের কারাদ-ের মামলা থেকেই ওই সব প্রমাণ এসেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশী এক রাজনীতিকের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সংরক্ষিত তথ্য পেতে এফবিআইয়ের এক সদস্যকে ঘুষ দেয়ায় ২০১৫ সালে রিজভী আহমেদ সিজার (৩৬) নামে একজনকে গত বছর তিন বছরের কারাদ- দেয় দেশটির একটি আদালত। সিজার বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাসাসের নেতা মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনের ছেলে। ওই রাজনীতিকের নাম মার্কিন আদালতের নথিপত্রে প্রথমে উহ্য রাখা হলেও রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণে তাকে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা’ বলা হয়। সিজারের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে রায়ে বলা হয়Ñ অপহরণ, ভয় দেখানো ও তথ্য ক্ষতি করাই ছিল তার তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য। সিজার কিছু তথ্য বাংলাদেশী এক সাংবাদিককে সরবরাহ করেছিলেন এবং বিনিময়ে প্রায় ৩০ হাজার ডলার পেয়েছিলেন বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে দুই হাজার ৮০০ মুদ্রিত সংবাদপত্রে একজন করে সম্পাদক আছেন। এর মধ্যে বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, সাগর-রুনীর বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি, সে ব্যাপারে আমরা দুঃখিত। তবে মামলাটি বন্ধ করে দেয়া হয়নি। তদন্ত চালাচ্ছি, আশা করছি সুরাহা হবে। লিখিত বক্তব্যে ইনু বলেন, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে গত সাত বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূর্বের সামরিক-সাম্প্রদায়িকতার জঞ্জাল অপসারণ এবং দেশকে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। জঙ্গীবাদ দমন, দেশের উন্নয়ন ও আইনের শাসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাপী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জঙ্গীদমন, পরিবেশ রক্ষা, নারী উন্নয়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রম সম্মানিত ও প্রশংসিত হয়েছে। খোদ মার্কিন বিভিন্ন সংস্থাও এ কার্যক্রমগুলোর ভূয়সী প্রশংসা করেছে, প্রধানমন্ত্রীকে ভূষিত করেছে আন্তর্জাতিক পুরস্কারসমূহে। ঠিক এমনই সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু বিষয়ের উল্লেখ আমাদের জন্য দুঃখজনক। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে স্বীকার করা হয়েছেÑ বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী, সংসদীয় গণতন্ত্র চলছে। তাদের এ সত্য স্বীকারের জন্য ধন্যবাদ জানাই। তারপরও এ রিপোর্টে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, নিখোঁজ, উগ্রবাদীদের দ্বারা ব্লগার হত্যা, সংবাদপত্র ও অনলাইনে মতপ্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ, বাধ্যতামূলক বিবাহ, লৈঙ্গিক সহিংসতা, শ্রমিকদের অধিকার ও নিম্নমানের কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তাবাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন, বিনাবিচারের আটক, শিশুশ্রম, ধর্মীয় ও নৃ-গোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুদের সামাজিক দমন ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে বেশি স্বাধীনতা ভোগ ও চর্চা করছে। স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোন গণমাধ্যমের ওপর সামান্যতম চাপ নেই। গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে যা ইচ্ছে তাই প্রকাশ বা প্রচার করছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত সংবাদে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রতিকার পাওয়ার জন্য আইন বা আদালতে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে সরকারের কোন ভূমিকা থাকার কথা নয়। তারপরও সরকারের পক্ষপাত গণমাধ্যম, গণমাধ্যমকর্মী, সাংবাদিক ও সম্পাদকের দিকেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক শাসন চলছে। এখানে গণতন্ত্র সঙ্কুচিত করার সুযোগ নেই। সংবাদপত্র, দল গঠন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার সাংবিধানিকভাবে সুসংরক্ষিত। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান হচ্ছে। কাউকেই তার স্বাধীন মত বা রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনায় বাধা দেয়া হচ্ছে না। গণতন্ত্রে কাউকেই গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে অপরাধ করার সুযোগ দেয় না। সরকার কারও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে না, শুধুমাত্র অপরাধ সংগঠন বা সন্ত্রাস-সহিংসতা সংগঠনে বিরত রেখে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা প্রদানে পদক্ষেপ নিয়েছে। সফল দল তাদের ইচ্ছেমতো রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করছে, নির্বাচন করছে। সুতরাং গণতন্ত্র সঙ্কুচিত নয়। অপরাধ সংগঠনের বাধা দেয়া বা অপরাধীকে আইন বা বিচারের সম্মুখীন করা গণতন্ত্র সঙ্কুচিত করা নয়। সরকার কোন এনজিও বা সিভিল সোসাইটি সংগঠনের কার্যক্রমে বাধা দেয়া বা চাপ দিচ্ছে না। এনজিও বা সিভিল সোসাইটি সংগঠনসমূহ স্বাধীনভাবে ইচ্ছেমতো তাদের মতপ্রকাশ করছে। তাদের বক্তব্য বা মতপ্রকাশের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করলে বা তাদের স্বচ্ছতার কথা উঠলেই অত্যন্ত অযৌক্তিকভাবে তাদের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ তুলে শোরগোল তোলা হয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ভাবখানা সরকারের সমালোচনা জায়েজ, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দাবি করা জায়েজ। কিন্তু এনজিও বা সিভিল সোসাইটির স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা নিয়ে কথা নাজায়েজ। লিঙ্গ বৈষম্য, শিশুশ্রমসহ অন্যান্য যে সকল সামাজিক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে সেগুলোর বিষয়েও জবাব বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ই দিয়েছে। বাংলাদেশ রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা থেকে কিভাবে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে নারীর ক্ষমতায়ন করছে, কিভাবে সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিস্তৃত করছে, কি বিস্ময়কর ও জাদুকরি আর্থসামাজিক উন্নয়ন কর্মকা- করছে, তা আজ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দুনিয়ার জন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, আমি যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ দিচ্ছি তারা বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী গণতন্ত্র চলছে বলে স্বীকার করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমার আহ্বান, বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী, সংসদীয় গণতন্ত্র অর্থাৎ উদার ও মুক্তগণতন্ত্র এগিয়ে নেয়ার জন্য যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে যচ্ছে, বাংলাদেশের সেই প্রয়াস ও পদক্ষেপের পাশে তাদের আরও সমর্থন নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য। আইনের শাসন কোন অপরাধীকে ছাড় দেয় না। গণতন্ত্রে সব মতের জায়গা রয়েছে, জঙ্গীদের নেই। স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যমেও উস্কানি, মিথ্যাচার, খ-িত তথ্য ও হলুদ সাংবাদিকতার কোন জায়গা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের রিপোর্টটিতে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার সঠিক প্রতিফলন হয়নি। রিপোর্টটিতে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে, ফলে সঠিক চিত্রটি উঠে আসেনি। এদিকে গ্রেফতার সাংবাদিক শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তিনি মুক্তি পাবেন। রবিবার বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে একটি কর্মশালা উদ্বোধনের পর মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, তাকে একটা সুনির্দিষ্ট মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সেই মামলা এখন তদন্তাধীন আছে। তদন্ত হবে। যদি তিনি নির্দোষ থাকেন, তাহলে তিনি মুক্তি পাবেন।
×