ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কার্যকারিতা দৃশ্যমান না হওয়ায় গড়ে উঠছে আইন না মানার সংস্কৃতি ;###;অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্যেই মানা হচ্ছে না আদালতের আদেশ

গলদ প্রয়োগেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৮ এপ্রিল ২০১৬

গলদ প্রয়োগেই

বিকাশ দত্ত ॥ দেশে প্রায় অর্ধশতাধিক আইন আছে কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। আইনের শাসনের মূলমন্ত্রই হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগ। বাংলাদেশে অনেক আইন থাকলেও যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার কারণে মানুষ আইনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। কাগজে কলমে আইন আছে কিন্তু বাস্তবে তা প্রয়োগ না হওয়াতে জনগণের কাছেই আইন না মানাটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে দেশের বর্তমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী ও আইন বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, যে সমস্ত আইন প্রযোজ্য সেখানে প্রয়োগ করা হচ্ছে। একেবারে যে হচ্ছে না তা নয়। এর মাধ্যমেই জনগণ উপকৃত হচ্ছেন। সমাজকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্যই আইন করা হয়ে থাকে। আইন আছে, আইন প্রণয়ন হচ্ছে। আদালত আছে, বিচার চলছে। জনগণকে আগে আইন জানতে হবে। আইন না জানলে সেটা মানবে কী করে? এজন্য সরকারকে সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে প্রচার করা প্রয়োজন। আইনের প্রয়োগের অভাবে খাদ্য সামগ্রী থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আজ ভেজালে সয়লাব। অন্যদিকে পরিবেশ রক্ষার্থে নদ-নদী ভরাটের বিরুদ্ধে আদালতের আদেশও মানছে না ভূমিখোররা। নদ-নদীও আজ হুমকির সম্মুখীন। আইনের প্রয়োগের অভাবে বাংলাদেশে ছোট বড় যে তিন শতাধিক নদী আছে তা আজ হারাতে বসেছে। রাজধানী ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর অবস্থাও খুবই করুণ। নদীখেকোদের কারণে আজ দেশের নদ-নদীগুলো তাদের মানচিত্রও হারাতে বসেছে। পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ। আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ কতটুকু হচ্ছে। জনগণ প্রকাশ্যে পাবলিক প্লেসে ধূমপান করছে। তাদের কিছুই হচ্ছে না। উপরন্তু যারা প্রতিবাদ করছেন তাদেরই নানা ধরনের ঝামেলা সহ্য করতে হচ্ছে। জনসাধারণের ব্যবহৃত স্থানে (পাবলিক প্লেসে) প্রকাশ্যে ধূমপানের শাস্তি ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হচ্ছে। তাছাড়া আইন বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে ‘পাবলিক প্লেসের’ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৪(১) ধারায় বলা হয়েছেÑ কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করতে পারবে না। যানবাহনগুলোতে অবাধে ব্যবহƒত হচ্ছে হাইড্রোলিক হর্ন, মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯, ভোজ্যতেলের ভিটামিন এ সমৃদ্ধ আইন-২০১৩, বিশুদ্ধ খাদ্য আইন, গ্রাম আদালত আইন, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন-২০১১, পলিথিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১০, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩, মোটরযান নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৬৩, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০, বাংলাভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭, ট্রেডমার্ক আইন-২০০৯, কপিরাইট আইন-২০০০, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ এ সমস্ত আইন আছে কিন্তু বাস্তবে এর কোন প্রয়োগ নেই। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, আইন প্রয়োগের বিষয়ে আইন আছে। যে সমস্ত আইন প্রযোজ্য সেখানে আইনের প্রয়োগ করা হচ্ছে। একেবারে যে হচ্ছে না তা নয়। এর মাধ্যমেই জনগণ উপকৃত হচ্ছে। অন্যদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, আইনের প্রয়োগ করা হবে যদি মানুষ প্রয়োগ করতে চায়। জনগণ যদি কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে তিনি আদালতে যেতে পারেন। আদালতে গেলে তিনি অবশ্যই প্রতিকার পাবেন। তখন আদালত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আদেশ প্রদান করে থাকে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে হাইকোর্ট একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি। বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে পাশাপাশি এলাকাভেদে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ ভাড়া নির্ধারণের জন্য ৬ মাসের মধ্যে একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন’ কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি বজলুর রহমান ও বিচারপতি মোঃ রুহুল কুদ্দুসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ২০১৫ সালের ১ জুলাই এ রায় দেন। আদালত রায়ে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ কমিটি গঠন করবেন। যার নেতৃত্বে থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, আইন মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন আইন বিশেষজ্ঞ, একজন অর্থনীতিবিদ, নগর ও গৃহায়ন বিশেষজ্ঞ, বাড়িভাড়া বিষয়ক এনজিওর একজন প্রতিনিধি, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি। এ কমিশন ভাড়াটিয়া ও বাড়ির মালিকদের মতামত শুনে, প্রয়োজনে গণশুনানির মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করবে। পাশাপাশি দেশের ভাড়াটিয়া ও মালিকদের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে প্রতিকারের সুপারিশ করবে। রায়ের পর রিট আবেদনের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ জনকণ্ঠকে জানান, মামলাটি চলমান থাকবে। যেকোন প্রতিকারের জন্য আবেদনকারীরা আবার আদালতের কাছে প্রতিকার চাইতে পারবেন। এ রায়ে আমি খুবই খুশি হয়েছি। বাড়িভাড়া নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মানুষ যে অপেক্ষা করছিল সেই পথ খুলে গেল। ভবিষ্যতে এ ধরনের বিরোধ শতকরা আশি ভাগ কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। নদী-খাল দখল দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষিত হচ্ছে। উচ্চ আদালতের আদেশ না মানায় বাংলাদেশে ছোট বড় যে তিন শতাধিক নদী আছে, তা আজ হারাতে বসেছে। প্রায় ৩০টি নদী ও খালের দখল, পুনরুদ্ধার ও দূষণ রোধে আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও নদী ও ভূমিখেকোদের কবল থেকে নদী ও খালগুলোকে বাঁচানো যাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর অবস্থাও খুবই করুণ। নদীখেকোদের কারণে আজ দেশের নদ-নদীগুলো তাদের মানচিত্রও হারাতে বসেছে। পরিবেশ সচেতন আইনজীবীগণ বলেছেন, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে পদক্ষেপ নেয়া হলে বুড়িগঙ্গাসহ চার নদী রক্ষা করে রাজধানী ঢাকাকে ভেনিস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ জনকণ্ঠকে বলেন, নদীগুলোর বর্তমান যে অবস্থা তা ভয়াবহ। সংবিধানে এবং আলাদা আইনে খাল-নদী-পুকুর-জলাধার ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীদের কারণে ভরাট অব্যাহত রয়েছে।
×