ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফজলুল বারী, সিডনি থেকে

প্রবাসে বাঙালিয়ানা

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১৮ এপ্রিল ২০১৬

প্রবাসে বাঙালিয়ানা

দু’হাজার সালে সিডনি অলিম্পিক উপলক্ষে গড়া হয় আজকের সিডনি অলিম্পিক ভিলেজ। অনেকগুলো স্টেডিয়াম-ক্রীড়া কমপ্লেক্স গড়া হয় তখন এই অলিম্পিক ভিলেজে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় স্টেডিয়ামটি এএনজেড স্টেডিয়াম। সিডনি অলিম্পিকের উদ্বোধনী-সমাপনী অনুষ্ঠান এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। সেই এএনজেড স্টেডিয়ামে এখন মাঝে মাঝে কনসার্ট হয় বিশ্বখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী বা ব্যান্ডের দল সিডনি এলে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার আর কোন ভাষাভাষী মানুষের নববর্ষ বা আর কোন কমিউনিটি প্রোগ্রামের আগে এখানে হয়নি। এই ভ্যেনুটি এত ব্যয়বহুল যে, অন্য কেউ হয়তো এখানে তাদের কমিউনিটি প্রোগ্রাম করার কথা ভাবতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়ার বাঙালীরা এক্ষেত্রেও একটি রেকর্ডের শিলালিপি স্থাপন করে রেখে দিল শনিবার, ১৬ এপ্রিল। এখানে হয়ে গেল বাঙালীর প্রাণের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা। এএনজেড পার্কের স্টাফরা এর আগে হয়তো বাঙালীদের নিয়ে এতটা জানত না। তাদের একজন সিনথিয়া শনিবার স্টেডিয়ামে প্রায় পঁচিশ হাজার বাঙালীর সমাবেশ দেখে মুগ্ধতায় একটা শব্দই প্রথমে বলল, ‘এমাজিং’! এরপর বলল এত কালারফুল একটা জাতি, তাদের উৎসব, মেয়েগুলো এত সুন্দর করে সাজে, এমন আর আগে আমি কখনও দেখিনি! এ মাঠে ৭৫ হাজার দর্শকের জায়গা হয়। অত বাঙালী অস্ট্রেলিয়ায় নেই। কিন্তু শনিবার বাংলা নব বর্ষবরণ উপলক্ষে প্রায় পঁচিশ হাজার দর্শক এসেছিলেন এ মাঠে। উদ্যোক্তরা বলেছেন, এটি তাদের এ যাবতকালের সবচেয়ে সফল মেলা। এই মেলাপাগল বাঙালীদের সবাই দশ ডলারের টিকেট কেটে মাঠে ঢোকেন। সারাদিনের জন্যে গাড়ি পার্কিং বাবদ খরচ করেন পঁচিশ ডলার করে। বাংলা নববর্ষে বাংলাদেশের অথবা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা যেমন বাহারি সাজের শাড়ি-পাঞ্জাবি পরেন, এএনজেড স্টেডিয়ামের বর্ষবরণ-বৈশাখী মেলাতেও তারা তেমন সেজেগুজে এসেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বাঙালী মেলার আরেক বৈশিষ্ট্য এখানে সমবেতদের নব্বই শতাংশ তরুণ এবং নতুন দম্পতি। এরা পড়াশোনা উপলক্ষে এদেশে এসেছিলেন। পড়াশোনা শেষে মাইগ্রেশন হয়ে যাবার পর দেশে গিয়ে বিয়ে করে স্ত্রী বা স্বামীকে নিয়ে এসেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসীদের বেশিরভাগেরই ব্যাকগ্রাউন্ড এমন। অনেকের সঙ্গে তাদের বাবা-মা এদেশে এসেছেন নাতি-নাতনির জন্ম উপলক্ষে। বৈশাখী মেলা উপলক্ষে যে স্যুভেনির প্রকাশ করা হয়েছে তাতে অস্ট্রেলিয়ার বাঙালীদের বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল, বিরোধী দলের নেতা বিল শর্টন, নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের প্রিমিয়ার মাইক বার্ডসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। অস্ট্রেলিয়ার প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা মঞ্চে উঠে তাদের দেশে বসবাসরত বাঙালীদের বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রথমেই ইংরেজী উচ্চারণে বাংলায় বলার চেষ্টা করেছেন, ‘শুভো নববর্ষা’! সিডনির অলিম্পিক পার্কের এই বৈশাখী মেলা এর মাঝে বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের বাইরের সবচেয়ে বড় বাঙালী সমাবেশের অভিধা পেয়ে গেছে। কারণ বিদেশে মূলত সভা-সমাবেশ হয় মিলনায়তনের ভেতরে। এদেশে সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কোন সভায় পঞ্চাশ-এক শ’জন লোক জোগাড় করা গেলে বলা হয়, ‘হাউ এ বিগ মিটিং ইট ইজ’! আর এখানে বাঙালীর মিলন উৎসবটি হয় পৃথিবীর অন্যতম বড় একটি স্টেডিয়ামে। এই বৈশাখী মেলা উপলক্ষে বিশেষ শার্টল ট্রেন-বাসের ব্যবস্থা করে সিডনির পরিবহন অধিদফতর। এবারও করেছে। এর মিডিয়া পার্টনার হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় টিভি স্টেশন, চ্যানেল নাইন। বাঙালীর মেলা মানে নাগরদোলা। অলিম্পিক পার্কের মেলা উপলক্ষেও নাগরদোলাসহ নানা রাইডের ব্যবস্থা করা হয়। এবার মেলায় স্টল ছিল এক শ’র বেশি। গয়নাগাটি, শাড়ি-পাঞ্জাবি-থ্রি-পিস থেকে শুরু করে বই, খাবারের স্টল ছিল এএনজেড স্টেডিয়ামের সামনের বড় অংশজুড়ে। বাংলা নববর্ষের মেলায় যা যা পাওয়া যায়, হাওয়াই মিঠাই থেকে শুরু করে পিঠা-পুলি, লুচি-লাবড়া, ঝালমুড়ি, ফুচকা থেকে শুরু করে পিয়াজু-সিঙ্গারা, কাবাব-নান, মোগলাই, জিলিপি-বিরিয়ানি থেকে শুরু করে সবকিছুই ছিল এ মেলায়। একেকটি খাবারের দোকানে কাজ করেছেন দশজনের বেশি ছেলেমেয়ে। ভিয়েতনামীদের একটি স্টলে লম্বা লাইন সামাল দিয়ে আখের রস বিক্রি করা হয়। এভাবে লোকজন এখানে খাবার নিয়েছেন লাইনে দাঁড়িয়ে। পরিচিতজনের সঙ্গে মেলায় দেখা-আড্ডার সঙ্গে হালের ক্রেজ সেলফি, কিছুই বাদ যায়নি। এখন সেলফি তুলেই সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি আপলোড করা যায়। এর কারণে বুঝি বাঙালীর নববর্ষ এখন অনেক বেশি বর্ণিল-প্রান্তবন্ত। বড় ইভেন্ট উপলক্ষে অস্ট্রেলিয়ার সব স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধার ব্যবস্থা করে। সে কারণে এএনজেড স্টেডিয়াম থেকে কারও সেলফি বা ছবি আপলোডে একদম সমস্যা হয়নি। সিডনি অলিম্পিক পার্কের এ মেলার আয়োজক বঙ্গবন্ধু পরিষদ অস্ট্রেলিয়া। এই সংগঠনের কর্তা ব্যক্তিদের সবাই বাংলাদেশী-অস্ট্রেলিয়ান। এই মেলার প্রধান প্রাণপুরুষ শেখ শামীমুল হক বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্যতম সদস্য। কিন্তু এ মেলাকে শুধু প্রবাসী বাংলাদেশীদের মেলা বলা বা দাবি করার সুযোগ নেই। সিডনিবাসী পশ্চিমবঙ্গের বিপুলসংখ্যক বাঙালী এবারও যোগ দিয়েছেন এ মেলায়। তাদের বই ও খাবারের দোকান মেলায় ছিল। এর কারণে এটি এখন নিখাদ বাঙালীর মেলা। এবারে মেলার অতিথি শিল্পী ছিলেন নচিকেতা। স্বভাবসুলভভাবে ভীষণ জমিয়ে গেয়েছেন এই শিল্পী। তার ‘রাজশ্রী তোমার জন্যে মুদ্রাস্ফীতি অস্ট্রেলিয়ায়’সহ নানা গানের সঙ্গে গেয়েছেন সবাই। এবার মেলা কমিটির বোধোদয়ের কারণেও অনেক গান গাইতে পেরেছেন নচিকেতা। অন্যবার সিডনির শিল্পীদের শুরুতে এত সময় দেয়া হয় যে, শেষের দিকে বৃষ্টি এসে গেলে অতিথি শিল্পী আর সেভাবে গাইবার সুযোগ পাননি। এবার তা হয়নি। শুরুটা সিডনির শিল্পীদের দিয়ে শুরু হলেও মাঝের পুরো সময়টা ছিল নচিকেতার। একবার বেচারাকে চায়ের বিরতিও নিতে হয়েছে। নচিকেতার পর আবার মঞ্চে ফেরেন সিডনির শিল্পীরা। প্রশান্ত পাড়ের দেশটায় যে কত বাঙালী প্রতিভা আছেন, এ মেলায় যারা আসেন তা তারা দেখেন-জানেন। বাঙালীর এত স্মার্ট প্রজন্ম যে অস্ট্রেলিয়ায় তা এ মেলায় না এলে বোঝা কঠিন। বাঙালীর অনেক স্মার্ট ছেলেমেয়ে এখন অস্ট্রেলিয়ার নানা কিছুর মূলধারায়। মেলার সুযোগে তারাও আসেন। মন ভাল হয় তাদের দেখে। এদের দেখে মন বলে একদিন কোন এক বাঙালী ছেলেমেয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীও হবে। সিডনির নিউইয়ার সেলিব্রেশনের অপেরা হাউস পর্বটির আতশবাজি দুনিয়াখ্যাত। আর অলিম্পিক পার্কের বর্ষবরণও শেষ হয় বর্ণাঢ্য আতশবাজির মাধ্যমে। আবহাওয়া ভাল থাকায় এই শনিবারের আতশবাজি পর্বটাও বিশেষ জমেছিল। অলিম্পিক পার্কের চারপাশে দাঁড়িয়ে নানা দেশের পর্যটকরা দেখছিল বাঙালীর বর্ষবরণের আনন্দ। মনটা তখন আরও প্রশস্ত হয় বহুগুণ। ভিন্ দেশের ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হলেও মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর সেই অমোঘ উক্তিÑ ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’।
×