ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাহালুল মজনুন চুন্নু

দৃপ্ত শপথের সেই মুজিবনগর সরকার

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১৭ এপ্রিল ২০১৬

দৃপ্ত শপথের সেই মুজিবনগর সরকার

বিস্মৃতির মহাকাব্য অনেক বিষয় নিয়ে লেখা সম্ভব হলেও মুজিবনগর দিবস নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। যেই দিনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য আনুষ্ঠানিকভাবে উদিত হয়েছিল, সেই দিনটি বিস্মৃতির অন্তরালে যাবে এটা কখনও সম্ভব নয়। বিশেষ করে যারা অত্যাচার-নিপীড়নের নাগপাশ থেকে মুক্তির স্বপ্নে, দেশমাতৃকার স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, যারা দখলদার হানাদারদের পবিত্র মাতৃভূমির মাটি থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন, তাদের কাছে ঐ দিনের ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাই এমন মহার্ঘরূপে আবির্ভূত হয়েছিল যে, তা বিস্মৃত হওয়া কল্পনাতীত একটি বিষয় বটে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার ঠিক ২১৪ বছর পরে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগরের আরেক আম্রকাননে বাংলার সেই অস্তমিত স্বাধীনতার সূর্য আবারও উদিত হয়ে বাংলাদেশ নামক ভূখ-টিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে দিল। তাই ১৭ এপ্রিলকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা মানে নিজের আত্মপরিচয়কেই ভুলে যাওয়া, নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা। দুর্ভাগ্য, এদেশে এখনও অনেকে আছেন যারা মহান ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগরের ঘটে যাওয়া ঘটনাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। তাদের সেটা করার যৌক্তিকতাও আছে বটে! তারা মননে সৃজনে আর কর্মে সবর্দাই পাকিস্তানী ভাবধারায় বিশ্বাসী। পাকিস্তানের পরাজয়ের মূল ভিত্তি তৈরি হয়েছিল যেই মুজিব নগরের ঘটনার প্রেক্ষিতে, তাকে তো তারা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবেনই। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে আমরা দেখি ২৬ মার্চের মহান স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস নামমাত্র পালন করতে। কিন্তু যেখান থেকে এই দেশ মাতৃকার যাত্রা শুরু সেই বিপ্লবী সরকারের ১৭ এপ্রিলের শপথ গ্রহণ দিবসটি তো তাদের উদ্যাপন করতে দেখা যায় না! যেন মুজিবনগর দিবসটি হারিয়ে গেছে তাদের স্মৃতির অন্তরালে। এই নিয়ে যদি তাদেরকে প্রশ্ন করি কী জবাব দেবেন তারা? ১৭ এপ্রিল আমাদের জীবনে আকস্মিকভাবে আসেনি। ’৪৮, ’৫২, ’৫৪, ’৬২, ’৬৬,’৬৯,’৭০-এর পথ বেয়ে আসে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। দীর্ঘকাল ব্রিটিশের কাছে বন্দী থাকার পর বাঙালী ভেবেছিল মুক্তি মিলেছে তাদের। পরাধীনতার গ্লানি আর সইতে হবে না। কিন্তু না, তারা আবারও বন্দী হয়ে পড়ে পাকিস্তানী শাসকদের হাতে। সেই বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে জীবনবাজি রেখে মরণপণ লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। দীর্ঘ আন্দোলনের জোয়ারে ধীরে ধীরে বাঙালীর হৃদয়ে আঁকা হয়ে যায় একটি লাল-সবুজ পতাকা, একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ছবি। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাঙালী জাতির মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, ওই ভাষণেই ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথাটি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন দেশের ঘোষণা করেছিলেন তিনি। এটাকে অনেক দেশবিরোধী চক্র এখন স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে মানতে নারাজ। খোলা ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথাটি বলার মধ্য দিয়েই যে আমাদের জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তা একটি শিশুও বুঝতে পারে। কিন্তু যারা পারেনি তারা হয় উন্মাদ, নয় ধূর্ত। স্বাধীনতার ঘোষণা যে বঙ্গবন্ধু আগেই দিয়েছিলেন সেই বিষয়ে আরেকটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকা এসেছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের অংশ নয়। আর ইয়াহিয়া বিদেশী প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি।’ তাঁর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেন। সে যাই হোক, স্বাধীনতা সংগ্রামের ৭ মার্চের ঘোষণায় পাকিস্তানী শাসকচক্র দিশেহারা হয়ে যায়। প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে তাদের মাঝে। আর তাই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদাররা শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে রক্তের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে শুরু করেছিল ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর গণহত্যা। মৃত্যু, ধ্বংস, আগুন আর আর্তনাদে বীভৎস হয়ে উঠেছিল চারদিক। বাঙালী জাতিকে এমন পরিস্থিতিতে শত্রুর মোকাবেলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর পরপরই তাকে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তাই তিনি একদিকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রচারের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করে রেখেছিলেন, তেমনি একটি সরকার গঠনের পরিকল্পনাও করেছিলেন। তাঁর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই পরবর্তী সময়ে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান দেশের মানুষকে রক্ষা ও পাল্টা আক্রমণে ভারতের সাহায্যে লাভের উদ্দেশ্যে। দিল্লীতে গিয়ে তাজউদ্দীন বুঝেছিলেন কেবল আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে দেশের জন্য সহানুভূতি ও সমবেদনা ছাড়া তেমন কিছু তিনি আশা করতে পারেন না। ভারত সরকারের জন্য একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক করা প্রয়োজনীয় ছিল। তাই তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে সেটা যেমন বলেছেন, তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট ও নিজেকে প্রধানমন্ত্রীরূপে তুলে ধরেন। সেটাই ছিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের ধারণার সূচনা। কলকাতায় ফিরে এসে তিনি সরকার গঠনের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু দলের অভ্যন্তর থেকেই আসতে থাকে নানারকম বাধা। সকল বাধা অতিক্রম করে ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন। এই সরকারের মূল ভিত্তি ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া সেই পরাজয় মেনে নেননি। যাই হোক, তাজউদ্দীন আহমদ সেই ঘোষণায় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখ-তা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।’ ঐ ঘোষণা আকাশবাণীসহ আরও কয়েকটি প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। সেই ঘোষণায় কতটা আনন্দিত হয়েছিলাম তা আজও ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তখন মনে বারবার হয়েছিলÑ আমি, আমরা এখন থেকে স্বাধীন দেশের নাগরিক। বস্তুত, স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা ও পাক হানাদার বাহিনীকে এই প্রিয় দেশ থেকে বিতাড়িত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত এবং নির্দেশিত পথে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের জন্য এই সরকার গঠন করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সেনাবাহিনী ফ্রান্স দখল করে নিলে জেনারেল দ্য গলে লন্ডনে যেভাবে ফ্রান্সের প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন, অনেকটা সেভাবেই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার আদর্শের উত্তরসূরিরা কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন। এই সরকারের সঙ্গে কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুকের সরকার তুলনীয়। যার সঙ্গে পলপটের খেমাররুজ যুক্ত ছিল। এদের সদর দফতর দীর্ঘকাল ছিল চীনের বেজিংয়ে। কোন কোন সময় থাইল্যান্ডেও ছিল। সিহানুকের স্বাধীন কম্বোডিয়া সরকার একদিকে প্রবাসী ছিল অন্যদিকে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল তাদের দখলে, যেখানে তাঁরা সরকার পরিচালনা করতেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বহুলাংশে এই সরকারের সঙ্গে তুলনীয়। সে যাই হোক, প্রবাসী সরকার ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করে সেখানে সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদ ঘোষণা ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের গোপন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছিল বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে ভারতের মাটিতে বসে। ইয়াহিয়ার এ প্রচার মিথ্যা প্রমাণ করতেই বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, যে কোনোভাবেই হোক খবরটি পৌঁছে যায় পাকিস্তানী হানাদারদের কাছে। এজন্য ১৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমান থেকে বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ করে ওরা। ফলে শপথ অনুষ্ঠান পিছিয়ে যায়। এবার খুবই সতর্কতার সঙ্গে শপথ অনুষ্ঠানের তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করেন তাজউদ্দীন আহমদসহ বিশ্বস্ত কয়েকজন। পাকবাহিনীর বিমান হামলার কথা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে সর্বোত্তম নিরাপদ একটি স্থান হিসেবে মেহেরপুরকে শপথ অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে তাঁরা নির্ধারণ করেছিলেন। ভৌগোলিক সুবিধার জন্য সেখান থেকে স্বল্প সময়ে ভারতে প্রবেশ করা যাবে এবং ভারত থেকে শত্রুদের ওপর আঘাত হানাও সহজতর হবে, এমন চিন্তাই এক্ষেত্রে কাজ করেছে। ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে বাংলাদেশের সরকারের অফিসের কেউ জানত না, কলকাতা থেকে শত শত মাইল দূরে বাঙালী জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসের এক স্বর্ণালি অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এতই কঠিন গোপনীয়তা অবলম্ব^ন করেছেন যে, মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যও তা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর হুকুমে ১৭ এপ্রিলের সকালে দমদম এয়ারপোর্টে গোপনে সজ্জিত হয়েছিল ভারতীয় যুদ্ধ বিমান বহর। মেহেরপুর সীমান্তে ভারতীয় ভূখ-ে অবস্থান করছিল ভারতের সামরিক বাহিনী। মেহেরপুর আম্রকাননের দূর-দূরান্তে ঘাস-পাতা বিছানো জালের ছাউনিতে ভারতীয় বাহিনীর এ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান মেহেরপুরের আকাশ নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে দিয়েছিল। মেহেরপুরের অখ্যাত ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় সাদামাটা পরিবেশে একটি আমবাগানে শপথ নিয়েছিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার। শপথের দিনটি ছিল শনিবার। আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সকাল নয়টা থেকেই সেখানে নেতৃবৃন্দ ও আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমন শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেশী-বিদেশী প্রায় জনা পঞ্চাশেক সাংবাদিক ঐ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। আম্রকানন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা শেষ মুহূর্তে খবর পেয়ে যে যেখানে ছিলেন পঙ্গপালের মতো যেন উড়ে আসতে থাকেন। আনন্দ-আবেগে উদ্বেলিত শত শত কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’Ñ গগনবিদারী স্লোগানে স্লোগানে আম্রকাননের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল সেদিন। চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছিল শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ছয়খানা চেয়ার। আশপাশের বাড়ি থেকে চৌকি, চেয়ার ও বাঁশ আনা হয়েছিল সেদিন। ওপরে শামিয়ানাও লাগানো সম্ভব হয়নি। ফলে খোলা আকাশের নিচে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। বেলা এগারোটায় শুরু হয়েছিল শপথ অনুষ্ঠান। মঞ্চে উঠে এলেন তাজউদ্দীন আহমদ, তাঁর পেছনে ক্যাপ্টেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও জেনারেল এমএজি ওসমানী। তাঁদের গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন তৎকালীন মেহেরপুরের এসডিপিও এসপি মাহবুব উদ্দিন বীরবিক্রম। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাংলাদেশকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রূপে ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একে একে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এম কামরুজ্জামান, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর নতুন রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে কর্নেল এমএজি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম ঘোষণা করেন। সেখানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটিই হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান আইনী দলিল যা আমাদের সংবিধান এবং সরকার গঠনের মূল ভিত্তি। একটি সত্য কথন হলো যে, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার একজন ছিলেন বিতর্কিত। তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। জ্যেষ্ঠতার কারণে মুজিবনগর সরকারের প্রধান তারই হওয়া উচিত বলে মনে করতেন তিনি। সুযোগ বুঝে তিনি পাকিস্তান ও সিআইয়ের হয়ে কনফেডারেশন গঠন করতে চেয়েছিলেন। খন্দকার মোশতাক কত বড় মীরজাফর তা জাতির জনকের হত্যার মধ্যে দিয়েই আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি। যাই হোক, সেই শপথ অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছিলেন। শপথ গ্রহণ শেষে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমরা যা করছি সবই মুজিবের নির্দেশে।’ তিনি আরো বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালী অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালী সন্তান রক্ত দিয়ে এ নতুন শিশুরাষ্ট্রকে লালিত-পালিত করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য।’ তাঁর বক্তব্যে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের তরে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই শপথ অনুষ্ঠানে নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনই বিশ্ববাসীর কাছে নব গঠিত রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। এই শপথ অনুষ্ঠানটি বাঙালীদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন জুগিয়েছিল। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে উজ্জীবিত হয়েছিল আমাদের বীর সৈনিকরা। মুজিবনগর সরকার আত্মপ্রকাশের পরপরই হানাদার বাহিনী মেহেরপুর মহকুমা এলাকা দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কয়েকবার তারা ইপিআর ক্যাম্প দখলে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণে মুজিবনগর প্রশাসন সুবিধামতো মুক্তাঞ্চলে চলে যায়। পরে নিরাপত্তাজনিত কারণে ভারতের কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে প্রবাসী সরকার। এই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতীক। সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক কর্মকা-, কূটনৈতিক প্রচার বিশ্ব জনমত গঠন এবং এক কোটি উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেছিলেন। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের ওপরে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই সরকার ছিল সম্পূর্ণ বৈধ একটি সরকার। মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে জনগণ যতই প্রশংসা করুক না কেন আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা বিদ্রোহী হয়ে পড়তাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
×