ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

বিজয়ের ভিত্তি রচিত হয় ১৭ এপ্রিল

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১৭ এপ্রিল ২০১৬

বিজয়ের ভিত্তি রচিত হয় ১৭ এপ্রিল

আজ ১৭ এপ্রিল। ৪৫ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ২৩ দিনের মাথায় বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। বাঙালী জাতির জন্য নতুন ইতিহাস রচিত হয়। এটা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, সারা বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের জন্য সৃষ্টি হয় নতুন উদাহরণ। দখলদার অথবা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভের উদাহরণ বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠিত পেশাদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর মাত্র ২৩ দিনের মাথায় শতভাগ জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও আইনসিদ্ধ আনুষ্ঠানিক সরকার গঠন এবং যুদ্ধ পরিচালনার সবকিছু সেই সরকারের একক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার উদাহরণ বিরল। এর ফলে মাত্র ৯ মাসের মাথায় পাকিস্তানের ৯৩ হাজার প্রশিক্ষিত সেনাসদস্য বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়, যা ছিল বড় বড় রাজনৈতিক ও সামরিক প-িতকুলের প্রিডিকশনের বাইরে। কারণ, রাজনৈতিক ও সামরিক শিক্ষার উদাহরণ হিসেবে যে দুটি স্বাধীনতাযুদ্ধের নাম বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়, তার একটি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ করতে হয় ৮ বছরেরও অধিক সময় এবং অন্যটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করতে ভিয়েতনামের লাগে প্রায় ৩৪ বছর। কিন্তু যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ২৩ দিনের মাথায় একটি প্রশ্নহীন ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রেক্ষাপট তৈরি ও ক্ষেত্র প্রস্তুতের যে কাজ তা বঙ্গবন্ধু শুরু করেন বহু আগে, ছয় দফা প্রণয়নেরও পূর্বে, ষাটের দশকের শুরু থেকে এবং তারই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বন্দী হওয়ার আগ মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে শেষ কাজটি সেরে দেন। ভাষা রক্ষার আন্দোলনের উপলব্ধি, ১৯৫৪ সালে বিশাল জনসমর্থনপুষ্ট সরকার গঠন করার মাত্র এক মাসের মাথায় ক্ষমতাচ্যুতির তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক আইন জারি ও ক্ষমতা দখলের পর ইতোমধ্যে পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে মুজিব ভাই হয়ে ওঠা তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের এই মর্মে উপলব্ধি জন্মে যে, এ অঞ্চলের মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায় হলো পাকিস্তানের গোলামী থেকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন। এই উপলব্ধির কারণে সেদিনের শেখ মুজিব বুঝেছিলেন পাঞ্জাবীদের কর্তৃত্বের মধ্যে থেকে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, গবর্নর হয়ে নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন করা গেলেও বাংলার মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর করা যাবে না। আর এ জন্যই আইয়ুব খানের সামরিক আইন জারির আগে প্রধানমন্ত্রী মুহম্মদ আলীর মন্ত্রিসভা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী আইনমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করায় বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ হয়ে করাচীতে যান এবং সোহ্রাওয়ার্দীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘পাঞ্জাবীরা আপনাকে ট্র্যাপ করেছে, ফল ভাল হবে না, মন্ত্রী হয়ে কিছুই করতে পারবেন না, উল্টো জনপ্রিয়তা হারাবেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৮৬)। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু সেদিন সঠিক কথাই বলেছিলেন। তাই ষাটের দশকের শুরু থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের পথে একেকটা করে ইটের গাঁথুনি দিতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ভিশন ঠিক করে দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়েছেন, পথিমধ্যে যা করেছেন তার সবকিছুই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে করেছেন। ফলে তাঁর শত্রুরা বুঝলেও পথ আটকাতে পারেনি। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব, এ কারণেই তিনি মহান নেতা। একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করে সেই রাষ্ট্র ভেঙ্গে আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে স্তম্ভ তৈরি করছেন, গাঁথুনি দিয়ে যাচ্ছেন, অথচ শাসকবর্গ তাঁকে আইন দিয়ে আটকাতে পারছে না, বন্দুকের ভয় দেখিয়েও ঠেকানো যাচ্ছে না। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা প্রণয়নের পর ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বঙ্গবন্ধু বলতেন, স্বাধিকার থেকে পার হয়ে স্বাধীনতায় পৌঁছানোর সাঁকো দিলাম। এটা এখন প্রমাণিত যে, ছয় দফাই ছিল স্বাধীনতা অর্জনের মূল স্তম্ভ, অনুঘটক বা ম্যাগনাকার্টা। একাত্তরের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ওপর ইস্পাত কঠিনের মতো অটুট থাকলেন। ইয়াহিয়া উভয় সঙ্কটে। ছয় দফা মেনে শাসনতন্ত্র তৈরি হলে এবং বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে বছর না ঘুরতেই বাংলাদেশ এমনিতে স্বাধীন হয়ে যায়। ইয়াহিয়া খানের কাছে আর কোন উপায় ছিল না। পাকিস্তান রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে যা করলেন তাতে ইয়াহিয়া নিরীহ মানুষের ওপর আক্রমণকারী ও গণহত্যাকারী হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চিহ্নিত হলেন। বিশাল জনসমর্থন ও নির্বাচনে একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, জনগণ এবং গণমাধ্যমের কাছে ইয়াহিয়া ঘৃণিত ও প্রত্যাখ্যাত হলেন। এটাই হলো সেই মন্ত্র, যার দ্বারা মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে আমরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেছি, যার উদহারণ বিশ্বে নেই। ষাটের দশকের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন স্বাধীনতা অর্জনের পথে শেষ ধাপ হবে সশস্ত্র যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধে জয় লাভের জন্য ভারতের সর্বপ্রকার সমর্থনের অপরিহার্যতা সম্পর্কেও তিনি জানতেন। তাই ছয় দফা প্রণয়নের আগে ১৯৬৫ সালের শেষের দিকে লন্ডনে ফিরোজ গান্ধীর বন্ধু ড. তারাপদ বাবুর বাসায় এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কথা হয় ভারতের তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। এর এক মাসের মাথায় তাসখন্দে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিন থেকে বিএসএফের সীমান্ত খুলে দেয়া, ৩১ মার্চ বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করে ভারতের পার্লামেন্টের প্রস্তাব গ্রহণ, এপ্রিলের শুরুতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম সাক্ষাতেই ভারতের মাটিতে বসে সরকার গঠনের অনুমতি পাওয়াসহ পরবর্তী ৯ মাসের ঘটনাসমূহ প্রমাণ করে এর সবকিছু ছিল সুপরিকল্পিত ব্যবস্থার প্রতিফলন। সুতরাং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ষাটের দশকের শুরু থেকে বাঙালী জাতির জন্য যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে আসছিলেন তার আইনগত বৈধ ভিত্তি রচিত হয় এবং রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অঙ্গ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। নবগঠিত সরকারের রাষ্ট্রপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নবগঠিত সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সরকারের আইনগত ভিত্তি স্থাপনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা সনদটির মূল্য ছিল অপরিসীম। ঘোষণায় অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন দেয়া হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট ও নবগঠিত নীতিমালা এবং করণীয় সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়। বস্তুতপক্ষে যুদ্ধের পুরো ৯ মাস এই ঘোষণাপত্রই বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে কাজ করে। সপ্তম তফসিল হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এখন বাংলাদেশের সংবিধানের অংশ। ১৭৭৬ সালে ৪ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণার পর ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদ ঘোষণা ব্যতীত আর কোথাও অনুরূপ স্বাধীনতা ঘোষণার সনদ প্রদানের মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা দেখা যায় না। আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন এবং বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে মুজাহিদ বাহিনী কর্তৃক যুদ্ধ পরিচালনা এবং সোভিয়েত বাহিনী পশ্চাদপসরণের অব্যাহতির পর অভ্যন্তরীণ উপদলীয় সংঘর্ষের ইতিহাসের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি বৈধ সরকার গঠনের গুরুত্ব ও ভূমিকা কতখানি ছিল। শ্রীলঙ্কার তামিল জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতাকামী সংগঠন এলটিটিই দীর্ঘ ২৬ বছর যাবত গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েও শুধু আন্তর্জাতিক অঙ্গনের স্বীকৃতির অভাবে চরমভাবে পরাজিত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পর দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধরত স্থানীয় নেতারা সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা ভীষণভাবে অনুভব করছিলেন। মোবাইলহীন সময়ে আঞ্চলিক নেতাদের আন্তঃযোগাযোগের সহজ কোন সুযোগ ছিল না। এমতাবস্থায় বিক্ষিপ্তভাবে একাধিক সরকার গঠন করলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু ছিল না। এ রকম হলে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ পরিচালনার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেত। আর এ ধরনের কোন সরকারের সঙ্গে শত্রুপক্ষ যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ কর্তৃক একটি সরকার গঠন করা ছিল অপরিহার্য। সুতরাং অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদ সবদিক থেকেই মুজিবনগর সরকার গঠন এবং স্বাধীনতার সনদ ঘোষণার কাজটি ছিল যথার্থ এবং সময়োপযোগী। শপথ অনুষ্ঠানের পরে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী সচিবালয় স্থাপন করা হয় এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সর্বাত্মক কর্মযজ্ঞ চলতে থাকে। বস্তুত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের ভিত্তি হিসেবে ৯ মাস কাজ করে মুজিবনগর সরকার। শারীরিকভাবে অনুপস্থিত অর্থাৎ যুদ্ধের পুরো ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকলেও ফলত এবং আত্মিকভাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে এবং সারা বাংলার রণাঙ্গনে সদাসর্বত্র বিরাজমান ছিলেন। তাঁর নামেই সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। জাতিরাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য ১৭ এপ্রিলের মতো অনুপ্রেরণার উৎসস্থলগুলোকে অনাগত কাল ধরে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল সব ইতিহাস জাতির অমূল্য সম্পদ। এগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×