ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মদিনে ভালবাসায় সিক্ত হাশেম খান

জাতিসত্তার শিল্পী, আঁকতে চান শেষ দিন পর্যন্ত

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৭ এপ্রিল ২০১৬

জাতিসত্তার শিল্পী, আঁকতে চান শেষ দিন পর্যন্ত

মোরসালিন মিজান ॥ পঁচাত্তরে পা। দীর্ঘ সময়। পুরোটাই ছবি এঁকে গেছে বলা যায়। দেশের ছবি আর মানুষের কথা বলেছেন রং তুলিতে। একদিকে বাংলাদেশ গড়ে উঠছে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে বেড়ে উঠছেন শিল্পী। তিনি হাশেম খান। স্কুলের পাঠ্যবই থেকে শুরু করে দেশের প্রথম হাতে লেখা সংবিধানে তাঁর শিল্পভাবনা যোগ হয়েছে। এখনও সচল। নদীর মতো। এই নদী বয়ে যাক। জন্মদিনে এমন শুভ কামনাই জানালেন বন্ধু, সুহৃদ ও বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা। বরেণ্য শিল্পীর জন্মদিন উপলক্ষে শনিবার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে বিশেষ আনন্দ আড্ডার আয়োজন করা হয়। একাধিক প্রতিষ্ঠান গ্যালারি ও সংগঠন একত্রিত হয়ে উদ্যাপন করে শিল্পীর জন্মদিন। অনুষ্ঠান শুরু হয় বিকেল চারটায়। তারও আগে থেকে আসতে শুরু করেন গুণমুগ্ধরা। শিল্পীর জন্মদিন বটে। কেবল শিল্পীদের হয়ে ছিল না আয়োজনটি। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্টজনরা আলোকিত করে রাখেন মিলনায়তন। এদিন সবার হাতেই ছিল ফুল। কাঁচা রজনী গন্ধার মিষ্টি ঘ্রাণ ছুঁয়ে ছিল শিল্পীকে। চোখ বড় করে তাঁর দিকেই তাকিয়েছিল গোলাপ। আর হাশেম খান তাকিয়ে দেখছিলেন ভালবাসার মানুষগুলোকে। উপস্থাপক যাদের নাম ঘোষণা করছিলেন, মঞ্চে আসছিলেন তারা। ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করছিলেন প্রিয় শিল্পীকে। কখনও ব্যক্তি এসে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন। কেউ কেউ আসছিলেন দলবেঁধে। দেখতে দেখতে ফুলে ভরে ওঠে সামনের টেবিল। ঠিক পাশেই আরও একটি টেবিল। সেখানেও এতটুকু জায়গা নেই। সব মিলিয়ে দারুণ মিষ্টি একটা পরিবেশ। অনুষ্ঠান শুরুর আগে কথা হয় শিল্পীর সঙ্গে। ‘কী বলব? আমি তো আসলে বলতে পারি না।’ এই ছিল প্রথম প্রতিক্রিয়া। এর পর এই প্রশ্ন ওই প্রশ্ন। জবাব দেয়ার চেষ্টা করেন শিল্পী। ছোট ছোট কথার মালা গাঁথলে এই রকম দাঁড়ায়Ñ আমি সব সময় চেয়েছি, আমার কাজ যেন সর্বত্র আদৃত হয়। গ্রহণীয় হয়। যেটুকু হয়েছে, আমি খুশি। ব্যক্তি জীবন ও শিল্পী জীবন দুটোর ব্যাপারেই আন্তরিক ছিলাম। উভয় জীবন আমি উপভোগ করছি। কেবল ছবি আঁকা নয়, এই চর্চাকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, একটি সমাজে ডাক্তারের যেমন প্রয়োজন আছে, স্থপতির যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন শিল্পীর। আমি বার বার সে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিছু কাজও হয়েছে তাতে। এখন সারাদেশে অসংখ্য শিশু ছবি আঁকছে। ক্লাস ওয়ান থেকে এইট পর্যন্ত এটি পাঠ্য। আমি দেখিয়েছি, ছবি আঁকা অন্য শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মানুষকে সুন্দর করে। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাকে কেউ ডেকে নেয়নি আন্দোলন সংগ্রামে। নিজের দায় বোধ থেকে ছিলাম। এখনও আছি। শেষ দিন পর্যন্ত এভাবেই চালিয়ে যেতে চান বলে জানান হাশেম খান। মঞ্চে শিল্পীকে ঘিরে ছিলেন অনেক বিশিষ্টজন। দুর্লভ উপস্থিতি বলতে বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে। বন্ধু হাশেম খান সম্পর্কে বলতে গিয়ে সমকালীন বাংলাদেশের কথাটিও চমৎকারভাবে যুক্ত করেন তিনি। বলেন, আমি আমার বন্ধুর জন্য বলতেই থাকব। শেষ পর্যন্ত বলতেই থাকব। তিনি একশ’ বছর পেরিয়ে বেঁচে থাকুন আমাদের মধ্যে। এই বেঁচে থাকার সঙ্গে আজকের বাংলাদেশকে যুক্ত করে বিশিষ্ট চিন্তক বলেন, বেঁচে থাকাটা আমাদের দেশে একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা যেভাবে বাঁচতে চাই সেভাবে বাঁচতে পারছি না। আর যারা আমাদের বাঁচার উপরে হস্তক্ষেপ করছে তারা বুক ফুলিয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ পর্যায়ে হাশেম খান প্রসঙ্গে আসেন। বলেন, এই অবস্থার বিরুদ্ধে হাশেম খান কাজ করেছেন। মাথা নুইয়ে বেঁচে থাকার কোন অর্থ নেই। যারা মাথা নুইয়ে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের পরামর্শ দিচ্ছেন, তাদের মৃত্যু হোক। তারা দয়া করে আমাদের সামনে থেকে সরে যান। যদি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারি ঠিক তেমনি আমরা এ ধরনের বাচাল বৃদ্ধদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারি। তারা অনন্য অমর এটা সত্য নয়। আমি নাম উল্লেখ করতে চাই না। কিন্তু দেখতেই তো পারছেন, কী বুক ফুলিয়ে তারা কথাবার্তা বলছে, কী ধরনের অসম্ভব মিথ্যাচার করছে। জবাবে আমরা বলব, তোমরা সত্য নয়। কিছুতেই সত্য নয়। আমরাই সত্য। আমরাই বেঁচে থাকব শেষ পর্যন্ত। এ কথাগুলো কেন বার বার বলছি? বলছি, আমার বন্ধু হাশেম খানের দিকে মুখ করে। তিনি ছবির পর ছবি এঁকেছেন। এঁকেছেন কিসের জন্যে? এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্যে। তাঁর ছবিতে একটি কথাই বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছেÑ মানুষের মৃত্যু নেই। পিশাচের মৃত্যু আছে। শয়তানের মৃত্যু আছে। বদমাশদের মৃত্যু আছে। কিন্তু মানুষের কোন মৃত্যু নেই। অনুষ্ঠানে হাশেম খানের শিল্পীজীবন ও কর্মের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলার চেষ্টা করেন আরেক শিল্পী ও স্থপতি রবিউল হুসাইন। তিনি বলেন, হাশেম খান জাতিসত্তার শিল্পী। তার ইজেলটা যখন দেখি, চিত্রসম্ভার দেখি, তখন বাংলাদেশের প্রত্যেকটা রাজনৈতিক সামাজিক ঘটনার একটা চিত্র খুঁজে পাই। এমন কোন ঘটনা নেই, যেটা রাজনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য, কিন্তু তার ইজেলে নেই। শিল্পী রাজনীতি করেননি। কিন্তু চিত্রসম্ভার সচেতনভাবেই বলেছে রাজনীতির কথা। তিনি বলেন, শিল্প সার্বজনীন। শিল্পী যে পরিবেশে শিল্পচর্চা করেন, সেই আবহাওয়া তার রং তুলিতে ফুটে ওঠে। হাশেম খানের বেলায় তাই হয়েছে। আমাদের রুচি গঠনে তার যে ভূমিকা সত্যি কোন তুলনা হয় না। তিনি আমাদের ভালভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। হাশেম খানের চিত্র জগত এত বিস্তৃত যে, বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন থেকে যে ধারাবাহিকতা চলছে তার মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তি হলেন হাশেম খান। তিনি আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ, রাজনীতি, পরিবেশ- সব মিলিয়ে জাতিসত্তার শিল্পী। অনুষ্ঠানে আরও আলোচনা করেন আনন্দ আয়োজন কমিটির আহ্বায়ক ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবীর প্রমুখ। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট চিত্রসমালোচক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের লেখা ‘হাশেম খানের কাজ’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনন্য সাধারণ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে শিল্পীর লেখা একটি উপন্যাস। এভাবে নানা আয়োজনে পূর্ণ ছিল জন্মদিনের অনুষ্ঠান। হাশেম খানকে এদিন জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে আসেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, শিল্পী আবুল র্বাক আলভী, মনিরুল ইসলাম, কবি মোহাম্মদ সামাদসহ বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা। সবারই প্রত্যাশা- দীর্ঘজীবী হবেন প্রিয় শিল্পী। রং তুলিতে দেশের কথা, মানুষের কথা বলবেন শেষ দিন পর্যন্ত।
×