ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সহিংসতার মূলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৭ এপ্রিল ২০১৬

সহিংসতার মূলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণেই ইউপি নির্বাচনের তৃতীয় দফায়ও সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে এ দফায় নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা আওয়ামী লীগে রয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিগত দুটি নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগ ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যেই মূলত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৃতীয় দফায় বেশিরভাগ ইউপিতে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। আর এদের পক্ষ হয়ে কাজ করছেন দলের স্থানীয় অনেক নেতাকর্মীও। কেন্দ্র থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কার করা হলেও অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। তৃতীয় দফার নির্বাচনেও এ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠু করতে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলা না গেলে সহিংসতা এড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও তাদের বিদ্রোহী প্রার্থীর পাশাপাশি তৃতীয় দফায়ও বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। দুই দফায় নিষ্ক্রিয় থাকার পর দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয় রয়েছেন। ইউপি নির্বাচনে বিএনপি নেতাদের মাঠে নামার ঘোষণায় তৃণমূলেও নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আগামী ধাপের নির্বাচনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। ইউপি নির্বাচনের সহিংসতার সূত্রপাত হচ্ছে মূলত প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করে। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার ক্ষোভ থেকেই বিদ্রোহীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। বিদ্রোহীদের পক্ষে অনেক নেতাকর্মী এমনকি দলীয় এমপিদের কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। দলের পক্ষ থেকে বিদ্রোহী দমনে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই শুধু দল থেকে বহিষ্কার করেই দায়সারা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে সরাসরি নির্বাচনের মাঠে। দু’দফায় নির্বাচনে এখন পর্যন্ত যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই হয়েছে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। নির্বাচনে প্রতিপক্ষ বিএনপি হলে নির্বাচনের মাঠে তারা অনেকটাই কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। আর এ সুযোগ গ্রহণ করছে মূলত বিদ্রোহী প্রার্থীরা। এ কারণে নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভে সমর্থ হয়েছেন। আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে সহিংসতা রোধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দল থেকে মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর থেকেই মূলত এ সংঘাতের সূচনা হয়েছে। মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে অনেক প্রার্থীর মনোনয়ন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এভাবে মনোনয়ন পাওয়া আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীর সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা নেই। মূলত রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা নির্বাচনে জয়লাভ করার চেষ্টা করছেন। এর বাইরে দীর্ঘদিন ধরে যারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই এবার মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। এসব প্রার্থীর বেশিরভাগ বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিয়েছেন। জনগণের সমর্থনও অনেকটা তাদের পক্ষেই কাজ করছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে বিএনপি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদেরও সমর্থন যুগিয়েছে। আগামী দফার নির্বাচনেও এ ধারা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আওয়ামী লীগের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে সহিংসতার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে আগেই আভাস দেয়া হয়েছিল। গত ৩ মার্চ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ইসির বৈঠকে এ আভাস দেয়া হয়। ওই বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ইসিকে সতর্ক করা হয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে। তারা বৈঠকে উল্লেখ করেন, বেশিরভাগ জায়গায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মূলত এসব বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যেই সংঘাতের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। এ আশঙ্কার পরও নির্বাচন কমিশন সহিংসতা দমনে শক্ত কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। ফলে দু’দফায় বিক্ষিপ্তভাবে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর পাশাপাশি সহিংসতা রোধে নির্বাচন কমিশনের রয়েছে ব্যর্থতা। তারা মুখে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে তার প্রতিফলন কমই ঘটেছে। আগের দুটি নির্বাচনের সহিংসতা বিবেচনায় নিয়ে পুনরায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তবে বৈঠকে সহিংসতা রোধে আগের মতোই কঠোর নির্দেশের বাইরে নতুন কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি। গত বুধবার বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানান, পরবর্তী দফায় যাতে কোন সহিংসতা না ঘটে সেজন্য আরও কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ইসির পক্ষ থেকে এ ধরনের নির্দেশনার কথা একাধিকবার বলা হলেও দুই দফার নির্বাচনে বিক্ষিপ্তভাবে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে একাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ইসি সহিংসতা রোধে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলেও সহিংসতার দায় পর্যন্ত নিতে অস্বীকার করেছে। অথচ আইন অনুযায়ী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ইসিকে আইন ও বিধান করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অথচ প্রথম থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া আর কোন ব্যবস্থা ইসির পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। এমনকি পুনরায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন একটি ঝামেলাপূর্ণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে অতীতেও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতা রোধে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ধাপে ধাপে ইউপি নির্বাচন করা হচ্ছে। দুই ধাপের ভোটের অভিজ্ঞতা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আবারও বৈঠক হয়েছে। আগামী দফার নির্বাচনে কিভাবে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট করা যায় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সহিংসতা রোধে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে উল্লেখ করেন। অথচ ওই বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে সহিংসতা রোধে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকের আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে ইসির পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হয়েছে। তারা জানিয়েছে, ইউপি নির্বাচন নিয়ে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ মুহূর্তে বৈঠকের কোন সম্ভাবনা নেই। যেহেতু দুই ধাপের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে তাই এ মুহূর্তে সহিংসতা এড়াতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসার প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এদিকে, দলীয় নির্বাচন হওয়ার করণে প্রার্থী বাছাই থেকে যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হচ্ছে এর জের নির্বাচনে পড়ার পাশাপাশি নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। গত শুক্রবার এ ঘটনায় চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের দলীয় অফিস ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। মাদারীপুরে নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা এখনও অব্যাহত আছে। শুক্রবার আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী ও পরাজিত বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থদের মধ্যে সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায়ও তৃতীয় দফার নির্বাচনী প্রচারকে কেন্দ্র করে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠু করতে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলা না গেলে সহিংসতা এড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।
×