ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে কৌশলী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৭ এপ্রিল ২০১৬

গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে কৌশলী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে

তৌহিদুর রহমান ॥ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে ধীরে পদক্ষেপ নিতে চায় সরকার। চীন ও ভারতকে সমঝোতায় নিয়েই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে আগ্রহী বাংলাদেশ। সোনাদিয়া ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পে ইতোমধ্যে যে ছয়টি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে একক কোন দেশকে দায়িত্ব না দিয়ে একাধিক দেশকেও সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চলছে। এদিকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখতে চলতি সপ্তাহে ভারতের একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসছে। সূত্র জানায়, সোনাদিয়া ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন, ভারত, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতোমধ্যেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এদের মধ্যে জি টু জি (সরকার-সরকার) ভিত্তিতে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীন, ভারত, নেদারল্যান্ডস ও দুবাইয়ের চারটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এসব প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তবে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ কাদের দেয়া হবে সেটা এখনও চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ আগামী ২০৫৫ সাল নাগাদ শেষ হবে বলে সরকারের আশা রয়েছে। আর এ বন্দর নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করতে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা ছিল সরকারের। তবে সে উদ্যোগে এখন অনেকটা ভাটা পড়েছে। আর পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে সরকার থেকে এক হাজার ১২৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার পর বিভিন্ন দেশ থেকে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। বিশেষ করে চীনের আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। পরবর্তীতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশও এই সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করে। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে কোন গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় এ অঞ্চলে পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা রয়েছে। সিঙ্গাপুর আর শ্রীলঙ্কার গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে আসছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে ভারত, নেপাল, ভুটানও লাভবান হবে। বাংলাদেশ পরিণত হবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে শুধুমাত্র শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানেই গভীর সমুদ্রবন্দর রয়েছে। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে গোটা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলই লাভবান হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন ও ভারতের আগ্রহের পর সরকার এ বিষয়ে ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নিতে চাইছে। সকল পক্ষকে সমঝোতায় এনেই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সামনে এগোতে চায় সরকার। কেননা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানে থাকার কারণে সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়েই এ ধরনের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী সরকার। সে কারণে একক কোন দেশকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ না দিয়ে যৌথভাবে একাধিক দেশকে নিয়েও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। প্রথমে এককভাবে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চাইলেও আগ্রহী দেশগুলোও সরকারের মনোভাব বুঝতে পেরেছে। সে কারণে তারাও এখন যৌথভাবে নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিং কিয়াং জানিয়েছেন, চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সর্বাত্মকভাবে কাজ করতে চায়। সোনাদিয়া বা পায়রা বাংলাদেশের যেখানেই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হোক সেখানে তৃতীয় যে কোন দেশকে যুক্ত করতেও রাজি চীন। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থেই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ জরুরী। কেননা বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর নেই। সে কারণে সিঙ্গাপুর অথবা শ্রীলঙ্কার বন্দরে গিয়ে পণ্য স্থানান্তরিত করতে হয়। তাই বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারলে এ দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এদিকে, গত মঙ্গলবার দিল্লীতে ভারতের কেন্দ্রীয় সড়ক ও নৌপরিবহনমন্ত্রী নীতিন গড়করি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন করতে চায় ভারত। সে লক্ষ্যে শীর্ষপর্যায়ের এক প্রতিনিধি দলকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মাটিতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের জন্য আমরা সুযোগের অপেক্ষায় আছি। আমরা চাই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পাক। এ লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিকে বাংলাদেশে পাঠানো হবে। তিনি আরও জানান, গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের বিষয়ে ইতোমধ্যে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রাথমিক আলোচনা করেছেন। নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আগামী সপ্তাহেই বাংলাদেশ সফর করবে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তীতে বন্দর তৈরির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগের প্রস্তাবটিও চূড়ান্ত করা হবে। পটুয়াখালীতে পায়রা বন্দর নির্মাণে ভারত অংশ নিলে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা মাইলস্টোন হবে বলেও মন্তব্য করেছেন গড়করি। এদিকে, গত বছরের নবেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেদারল্যান্ডস সফরের সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী সে সময় তাদের প্রস্তাবকেও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবেন বলেও জানিয়েছেন। এছাড়া গত বছর জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মার্ক রুট। সে সময়ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল নেদারল্যান্ডস। সূত্র জানায়, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন বিভেদ নেই। দেশের সকল রাজনৈতিক দলই চায় সোনাদিয়া ও পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হোক। অভ্যন্তরীণ বিভেদ না থাকলেও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সরকার। তবে এই অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের আগ্রহকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কেননা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতাই বেশি। বিশেষ করে পাকিস্তানের গোয়ারদার, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা ও মিয়ানমারের কুয়াকফুতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে চীন। এদিকে ভূরাজনৈতিক কারণে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরের ভবিষ্যত নিয়ে আশার আলো নেই বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর অদূর ভবিষ্যতে হবে না। এটা ভূরাজনৈতিক কারণে। ভারত চীনকে বঙ্গোপসাগরে আসতে দিতে চায় না। এতে ভারতের ভেটো (আপত্তি) রয়েছে। তবে চীনকে না দিলেও গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়ে অন্য অনেকের আগ্রহ আছে। তাদের প্রাধান্য দিতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান জানিয়েছেন, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ একটি মেগা প্রকল্প। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন তা কোন একক প্রতিষ্ঠান বা একক দেশের পক্ষে যোগান দেয়া দুরূহ ব্যাপার। তাই এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকার সামনের দিকে এগোচ্ছে বলেও তিনি জানান।
×