ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সম্প্রীতির বন্ধনে মিলনমেলা বসে বৈশাখে

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

সম্প্রীতির বন্ধনে মিলনমেলা বসে বৈশাখে

একঝাঁক মেলা নিয়ে এবার এসেছে বৈশাখ। অবশ্য সব মেলা বৈশাখে নয়। তবে বৈশাখের মেলার আবেদন বাঙালীর জীবনে চিরন্তন হয়ে আছে। একটা সময় এই দেশে বৈশাখ বরণের চেয়ে বড় ছিল চৈত্র সংক্রান্তি। অর্থাৎ চৈত্রের দিন তিনেক আগে ও শেষ দিনের চড়ক উৎসবকে ঘিরে পরবর্তী বছরকে বরণ করে নেয়া। যখন দেখা গেল নতুন বছর বরণের কিছুই রইল না, তখনই গুরুত্ব পেল বৈশাখ। আর বৈশাখ মানেই মূল আয়োজন মেলা। বৈশাখে মেলা শুরু হয়ে নানা পর্বে পার্বনে বছর শেষে চৈত্রে গিয়ে ঠিক কয়টি মেলা দাঁড়ায় এর সঠিক হিসাব মেলে না। তবে এক হিসাব মতে মূল মেলা অন্তত আড়াই শ’। তবে এর শাখা প্রশাখা ধরে এক হাজারেরও বেশি। সেই হিসাবে অবশ্যই বলা যায় বাংলাদেশ মেলার দেশ। এর সঙ্গে আরও অনুষঙ্গও আছে। সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি মেলা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, প্রায় দুই হাজার মেলা। তবে মার্কিনীদের মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক ব্যবসার। মেলায় পণ্য বেচাকেনা ও পণ্যের প্রসার মূল লক্ষ্য। মেলা শুধু সাজগোজের। ওই মেলায় নেই প্রাণের ছোঁয়া। নেই বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য ও প্রাণের ছোঁয়ার সমন্বয়ের মেলায় আমরা কখনও হার মানব না। হৃদয়ের আবেগ ও অনুভূতি সর্বোপরি সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে আমরা হিমালয়সম চূড়ায় আছি। এটা কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক। কিছুই আসে যায় না। বাঙালী মাত্র বলতে পারি আমাদের মেলা আমাদের হৃদয়ে স্পন্দন এনে দেয়। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় মেলার উৎপত্তি কোন সময়ে সেই দিনক্ষণ নেই। কেবল আভাসে বলা হয় একটি সময় কালের কথা। ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ড এক মেলার সনদ দেন। বলা হয়, কেম্ব্রিজ শহরে যে মেলা হবে তার দোকানপাট থেকে যে আয় বা কর মিলবে তার সিংহভাগ যাবে শহর উন্নয়নে। রাজা পাবে একটি অংশ। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মেলার কোন লৌকিক সনদ ছিল না। ছিল ব্যবসায়িক সনদ। মেলার প্রধান লক্ষ্য মুনাফার কড়ি গোনা। এর আগে জনকল্যাণে একটি মেলা বসে একই শহরে। তার নাম বার্থোলমিউর মেলা। এই মেলাটিও বাণিজ্যিক। তবে মেলা থেকে অর্জিত অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় মঠ ও দাতব্য চিকিৎসালয় হাসপাতাল। যে কোন মেলার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উদ্দেশ্য থাকে ‘মুনাফা’। তবে এর মধ্যেই সংস্কৃতির সকল ধারা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে বিনোদন ও শিক্ষণীয় আয়োজন, সংস্কৃতির শিকড়ের পাঠ তুলে ধরা। বাঙালীর মেলাগুলোর মধ্যে এর সকল আবেদনই আছে। যা শুরু হয় বৈশাখ থেকে। এভাবে মেলা নিজেকে ছড়িয়ে দেয় নানা আঙ্গিকে। বিস্তার করে শাখা প্রশাখা। মেলার নিজের ধারায় নিজেকে প্রসার করে পণ্য দিয়ে। বর্তমানে মেলার বিজ্ঞাপিত নাম প্রদর্শনী। এই মেলা বেশিরভাগই শিল্পমেলা নামের প্রদর্শনী। মেলা যেভাবেই আসুক না কেন মেলার আদিকালীন আয়োজন ছিল লৌকিক এবং লোকজ। বাংলাদেশে এ জাতীয় মেলার শুরু বৈশাখ হতেই। যা লোকজ ধারায় এবং সংস্কৃতির গভীর থেকে আসা। তার প্রমাণ চিরন্তন হয়েই থাকবে। বৈশাখী মেলার গ-ি শহরে মনে হলেও তা শহুরে নয়। এই মেলা বটতলা হাটখোলার। একটা সময় বেশিরভাগ গ্রামেই ছিল খেয়াঘাট। আর খেয়াঘাট মানেই কোন বটপাকুরের গাছ তলায় বাঁশের মাচাং। খেয়াঘাটের কাছেই থাকত ঢুলি সম্প্রদায়। যাদের কাজ উৎসব পার্বনে ঢোল খোল ইত্যাদি বাজিয়ে সংস্কৃতির ধারা তুলে ধরার সঙ্গে বাড়তি দু’টো পয়সা। চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবের সূত্র ধরে বৈশাখের আগমনী বার্তা আসে ঢুলিদের কাছ থেকেই। মানুষের আনন্দ বিনোদনের পালায় মিঠাই মিষ্টান্ন, কুমোরদের তৈরি মাটির হাঁড়ি পাতিল কলসি ছোট্টমণিদের খেলনাপাতি ঘিরনি টাক বাজানো গাড়ি ইত্যাদি নিয়ে বড় গাছতলায় পসরা সাজিয়ে বসে দোকানীরা। এরই মধ্যে কবিগান পালা জারি সারি গান নিয়ে আসে কবিয়ালরা। গ্রামীণ খেলা ওপানটি বায়োস্কোপ চেঙ্গু পান্টি বৌছি ঝুকঝুক রেলগাড়ি দাঁড়িয়াবান্ধা হাডুডু (যার বর্তমান নাম কাবাডি) মোরগ লড়াই ইত্যাদি ঠাঁই পেতে থাকে এসব আয়োজনে। মেলার ব্যপ্তি এভাবে বাড়তে থাকায় এক সময় ছড়িয়ে পড়ে শহরে। তারপর বৈশাখী মেলাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এগিয়ে চলেছে বাংলার বৈশাখী। বর্তমানে বৈশাখী মেলার আয়োজন শুরু হয় ফাল্গুন মাস থেকেই। কুমোরের বাড়িতে গতি আসে কয়েকগুণ। মাটির বাসনকোসনের সঙ্গে যোগ হয়েছে শোপিস বড় ফুলদানি সোফার পাশে রাখা ফুলদানি ইত্যাদি। ছোট্টমণিরা এই দিনে বায়না তোলে মাটির হাঁড়িপাতিলের। শিশু মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে বৈশাখেই শিশুমনে ঘর-সংসার করার পাঠ অবচেতনেই চলে আসে খেলনাপাতি দিয়ে। এদিনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হয়ে আছে বাঙালী সত্তার পোশাক। বেশিরভাগ তরুণ ও মধ্যবয়সী এবং বয়স্করাও পাঞ্জাবি কুর্তি ফতুয়া গায়ে চড়ায়। তরুণীদের পরনে ওঠে লাল পেড়ে শাড়ি। এ যেন বৈশাখের পোশাক হয়ে গেছে। মেলায় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের আগমন ঘটে। এই মেলা পরিণত হয় সম্প্রীতির বন্ধনের মিলন মেলা। বৈশাখ মাস আসেই মেলাকে কেন্দ্র করে। এমন কোন স্থান নেই যেখানে একদিনের হলেও এই মেলা বসে না। মেলাকে ঘিরে আয়োজন হতে থাকে নানা কিছুর। সংস্কৃতির অপার সৌন্দর্যগুলো একে একে ফুটে ওঠে বাঙালীর মিলনমেলায়। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমরা যে সম্প্রীতির বন্ধনের কথা বলি তার সবই আছে বাংলা নববর্ষে। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×