ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাশেদ রউফ

স্কুলে বৈশাখী মেলা

প্রকাশিত: ০৭:০১, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

স্কুলে বৈশাখী মেলা

আয়মান পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। এ বছরই সে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এটি বাওয়া স্কুল নামে পরিচিত। চট্টগ্রাম শহরের নামী-দামী স্কুলের একটি। ঐতিহ্যবাহী স্কুল বলেই হয়ত এই স্কুলে আয়োজন করা হয় বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছে অন্য স্কুলে। সেটি মিশনারিজ স্কুল। সেন্ট মেরী’স স্কুল। আগের স্কুল আর বর্তমান স্কুলের মধ্যে আয়মান নিজে নিজেই অনেক পার্থক্য করে। তবে নতুন স্কুলকে বেশ ভাল লাগে ওর। পড়ালেখার বাড়তি চাপ নেই। বইয়ের অতিরিক্ত বোঝা নেই। শিক্ষক-আপারা যেন মাটির মতো শান্ত! মর্নিং শিফ্ট বলে আয়মানকে ঘুম থেকে উঠতে হয় খুব ভোরে। ভোরে ভোরে বিছানা ছাড়ার মধ্যে একটা বাহাদুরি ভাব আছে। অন্যরা ঘুমে, কেবল মা আর আয়মান জেগে উঠেছে। ভোরে স্কুলে যেতে তার খুব ভাল লাগে। রাস্তাঘাট থাকে ফাঁকা। একটা দু’টো কুকুর কেবল ঘোরাঘুরি করে। কাকগুলোকেও খুব আপন মনে হয়। আসলে এ শহরের কাকগুলোর হাবভাবই আলাদা। কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করে, পাউরুটি বা অন্যকিছু খেতে দিলে খুব ধীরে সুস্থে খায়। কোন হুড়োহুড়ি নেই। ছোঁ মেরে চলে যায় না। কাকের সঙ্গে যেন সকলের বন্ধুত্ব আছে! আয়মান কাককে ভালবাসে। ভালবাসে চড়ুইকেও। বাসায় বারান্দায় যখন গ্রিল ধরে আয়মান দাঁড়ায়, চড়ুই পাখি এসে কিচির মিচির করে ডাকে। ওর সঙ্গে খেলে। সে যখন আরও ছোট ছিল, তখন থেকেই। মা এই চড়ুইপাখিকে খাবার দেন। আসলে আয়মান যখন খেলতে চায়, তখন বাসায় সে পায় না খেলার কোন সঙ্গী। বাবা অফিসে থাকেন, ব্যস্ত মানুষ তিনি। মা-ও শিক্ষকতা করেন। স্কুলে তার ব্যস্ততা। তবু যতটুকু পারেন, কেবল তিনি সময় দেন। মা ছাড়া আর কেউ নেই। চড়ুই পাখিই কেবল বাড়তি সঙ্গী। মাঝে মাঝে কাক এসে খেলা করে তার সঙ্গে। সে যখন স্কুলে যায় ভোরে, তখন কেবল কাকগুলো তাকে স্বাগত জানায়। স্কুলের নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে দেরি হয় না আয়মানের। স্কুলে ভর্তি হয়েই সে পায় শহীদ দিবস। এরপর স্বাধীনতা দিবস। দু’দিনই স্কুলের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় সুন্দর অনুষ্ঠানমালার। ভাল লেগেছিল তার। সামনে বাংলা নববর্ষ। এবার আয়োজন করা হবে পহেলা বৈশাখ। অনেক আগে থেকেই ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ। অধ্যক্ষ আনোয়ারা ম্যাডাম নাকি তার সব শিক্ষককে নির্দেশ দিয়েছেন ‘পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উৎসব’ সফল করতে। ঠিক তো! অনুষ্ঠান সফল করার দায়িত্ব তো শিক্ষকদেরই। ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করবে বিভিন্ন ইভেন্টে, আনন্দ ভাগাভাগি করবে। কিন্তু উদ্যোগ তো ম্যাডামদেরই নিতে হবে। শোনা যাচ্ছে এবার বাওয়া স্কুল মাঠকে পরিণত করা হবে গ্রামে। ওখানে বসানো হবে গ্রাম্য মেলা। ক্লাস টিচার সাবেরা আপাকে নির্ভয়ে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করে ফেলে আয়মান। জিজ্ঞেস করে, পহেলা বৈশাখে কি মাঠে গ্রামের মেলা বসবে? টিচার বলেন, হ্যাঁ, এবার নতুন পরিকল্পনা আমাদের। গ্রামবাংলার মেলা আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। শহরের ঝলমলে পরিবেশ, মাইক্রোফোনের আওয়াজ, ব্যান্ড সঙ্গীত ইত্যাদি মেলার আবহমান ঐতিহ্যকে স্মান করলেও এখনও মেলা সংস্কৃতির প্রাণ। টিচারের কথাগুলো কঠিন মনে হলেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কত দিন ধরে সে কেবল মেলার কথা শুনছে। বাবা মাঝেমধ্যে গল্প করতেন তার গ্রামের ঠেগরপুনির মেলা নিয়ে। আহা! কী আনন্দ! কত মেলার কথা শুনেছে বাবার মুখে! বৈশাখী মেলা, কার্তিকের মেলা, রথের মেলা, চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। বগুড়ার মহাস্থানগড়ের মেলা ও খুলনার খানজাহান আলী দারোগার মেলা নাকি খুবই বড় মেলা। মনে হচ্ছে আয়মানের চোখে ভাসছে সেই মেলাগুলোর ছবি। সে তো যেতে পারে না, কিন্তু টেলিভিশনে দেখেছে অনেক মেলার ঝলমলে আয়োজন। দেখতে দেখতে চলে এলো সে কাক্সিক্ষত দিন। পহেলা বৈশাখের মেলা। বাওয়া স্কুল মাঠ যেন একটা সবুজাভ গ্রাম। সেই গ্রামে বসল একটা চমৎকার মেলা। ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবকরা ঘুরে ঘুরে দেখছেন মেলাটি। সবাই অভিভূত। আয়মান আর তার বান্ধবীরা খুবই মুগ্ধ। এই মেলায় তারা কী কী দেখছে! দেখছে বিভিন্ন ধরনের খেলনা, দেখছে মাটির হাঁড়ি-পাতিল, ব্যবহার্য অন্যান্য জিনিস, পুতুল, তাল পাতার পাখা, শীতল পাটি, নক্সি কাঁথা, বেতের ডালা, কুলা, ছাঁচের তৈরি বিভিন্ন জিনিস, যেমন : হাতি, ঘোড়া, পাখি, আম, কাঁঠাল, মসজিদের গম্বুজ, মন্দিরের চূড়া, বিন্নি ধানের খই ইত্যাদি। আয়মান ভাবতেই পারেনি তার স্কুল মাঠে এতো সব আয়োজন। বিশাল মাঠটি এখন উধাও। পুরোটাই গ্রাম। দেখা যাচ্ছে উত্তর পূর্ব কোনায় একটু বেশি ভিড়। ওখানে কী হচ্ছে? একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে চমৎকার আয়োজন। মোরগের লড়াই। ভালই লাগছে লড়াইটি। পাশেই জটলা আরেকটি। এতে উঁকি মেরে দেখে আয়মান। মজা তো! চলছে পুতুল নাচ। এখানে সে তার বান্ধবীদের নিয়ে কিছু সময় কাটায়। একে অন্যের সঙ্গে গল্প করে, ছোট ছোট ভাবনা বিনিময় করে। ভাগাভাগি করে আনন্দ। বিনোদনহীন নিরানন্দ একঘেয়ে জীবন-যাপন করছে শহরের মানুষগুলো। আয়মানরা বুঝতে পারে, তাদের মা-বাবাদের জীবন মানে কঠিন কঠোর একঘেয়ে জীবন। সেখানে এই মেলা আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে। আয়মাধনের বাবা প্রতিদিন তাকে স্কুলে নিয়ে গেলেও কখনও ভেতরে ঢোকেন না। এবার সেভাবে বাবাকে মেলাটি দেখাবে। ভেতরে নিয়ে আসবে সে। যেই কথা সেই কাজ। পরের দিন বাবাকে নিয়ে গেল মেলায়। বাবাও আয়মানের মতো অবাক। ওমা! এতো সুন্দর আয়োজন! বাবা চলে যান তার অতীতে। হারানো সেই স্মৃতি চোখে ভাসছে। পুরনো সেই দিনের কথা কি ভোলা যায়? এমন প্রাণপ্রাচুর্যময় আয়োজন দেখে অভিভূত হন তিনি। হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যের স্বাদ পাওয়া গেল নতুন করে। বাবা বলতে লাগলেন: দীর্ঘকাল ধরে গ্রামই ছিল বাঙালী-সংস্কৃতির প্রাণভূমি। পল্লী প্রকৃতির অবারিত উদার অঙ্গনে এই সংস্কৃতির লালন। এই গ্রামকে আমরা আজ নতুন করে অবলোকন করলাম। উপভোগ করলাম মেলার সৌন্দর্য। বাবার কথায় আয়মান খুশি। তার স্কুলের প্রশংসা করছেন বাবা। স্কুল তার প্রিয় বলে স্কুলের প্রশংসায় বেশ আন্দোলিত হয় আয়মান। পড়ালেখার পাশাপাশি সে পায় বাড়তি আনন্দ। রাতে সবাইকে নিয়ে যখন খেতে বসে সে, তখন গল্প চলে স্কুলের অপূর্ব মেলাটি নিয়ে। ঘুমাতে গিয়েও যেন ঘুম আসে না চোখে। সারাক্ষণই চোখে ভাসে মেলার ছবি। ‘হাত ঝুমঝুম, পা ঝুমঝুম, চোখ ঘুমঘুম রাত্রি নিঝুম রাত্রি নিঝুম রাত্রি নিঝুম’। রাত শেষ হলেই ভোর। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের সেই স্কুল। সেই মেলা। সেই গ্রাম। অনেক পরিকল্পনা করে আয়মান। আজ কী কী করবে! যথারীতি স্কুলে যাওয়ার জন্য সে অনেক আগেই তৈরি। বাবার হাত ধরে বাসা থেকে বের হয় সে। রিক্সায় করে যেতে সময় বেশি লাগে না। তারপরও তার মনে হচ্ছে বেশ দেরি হচ্ছে আজ যেতে। এতো দেরি, তর সয় না তার। রিক্সা থেকে নেমেই এদিক ওদিক না তাকিয়ে স্কুল গেট পার হয়ে সে সোজা ঢুকে গেল মাঠে। মাঠে ঢুকেই তার চক্ষু ছানাবড়া। কী আশ্চর্য! কোথায় মেলা! ঘূর্ণিঝড়ে তছনছ করে দেয়া গ্রামের মতো পড়ে আছে সেই মাঠটি। আয়মানের চোখে জল। সে জানে না দুদিনের জন্য আয়োজিত মেলা, তার পরের দিন থাকার কথা নয়। অনেকক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থাকার পর ক্লাসের দিকে পা বাড়ায় সে। অলঙ্করণ : নাসিফ আহমেদ
×