ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

টোকিও বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশ-জাপান যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

টোকিও বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশ-জাপান যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন

এম শাহজাহান ॥ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিগ-বি ইনিশিয়েটিভের আওতায় বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে জাপানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব করা হবে বাংলাদেশে। এ লক্ষ্যে এবার জাপানের প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারী খাতে জাপানের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ চায় সরকার। আর তাই বিনিয়োগের সম্ভাবনা যাচাই এবং এক্ষেত্রে সমস্যাগুলো চিহ্নিতকরণে টোকিওর বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশ-জাপান যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া আগামী মাসের শেষ সপ্তাহে জি-সেভেনের আউট রিচ মিটিয়েং অংশ নিতে জাপান সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর ওই সফরের সময় এদেশে জাপানের বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুজ নিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করা হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, জাপানের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য মুখিয়ে আছেন। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামোগত সমস্যা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তারা আসতে পারছেন না। বিদেশী বিনিয়োগ চলে যাচ্ছে ভারত, চীন, মিয়ানমার এবং ভিয়েতনামসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। তাই এবার জাপানসহ বিদেশী বিনিয়োগে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ইতোমধ্যে জাপানী শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করাসহ পাঁচটি ইপিজেডে ৪০টি শিল্প প্লট ও ২টি কারখানা ভবন সংরক্ষিত করা হয়েছে। এছাড়া জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে যেসব আলোচনা ও চুক্তি, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তা বাস্তবায়নে ৩১ দফা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে জাপানের সঙ্গে ৭২০ কোটি ডলারের যে চুক্তি হয়েছে তা বাস্তবায়নেও কাজ করা হচ্ছে। দেশটির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে জরুরী বৈঠক আহ্বান করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ বাড়াতে দ্বিতীয়বারের মতো জাপানের টোকিওতে সরকারী পর্যায়ে ৩ দিনের বিনিয়োগ সম্মেলন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন জাপানের অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, সচিব এবং ব্যবসায়ীরা। ওই সময় বাংলাদেশে বিনিয়োগের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয়। এই সম্মেলনে যোগ দেয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে বাংলাদেশে কয়েকটি প্রস্তুতিমূলক সভা করা হয়েছে। ওই সময় তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে জাপানের বিনিয়োগ বড় প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্টে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জাপান-বাংলাদেশ ও প্রাইভেট পাবলিক মিলে প্রতিনিয়ত ইস্যুজগুলো এ্যাড্রেস করবে, যাতে করে বিনিয়োগ খুব দ্রুত হতে পারে। তারা যে বিষয়গুলো তুলে আনবে সেগুলোর সমাধানও করবে। এছাড়া সরকারী পর্যায়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের বেসরকারী খাতে জাপানের বিনিয়োগের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে। জানা গেছে, চীনে শ্রমের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ বাড়বে। এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি জাপান, কোরিয়া ও চীনের কোম্পানিগুলো এ অঞ্চলে তাদের কারখানা সরিয়ে নিতে আগ্রহী। এ জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। এদিকে, গত ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় যে বিনিয়োগ সম্মেলনে সেখানে ভারতের রিলায়েন্স ও আদানি গ্রুপের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে জাপান, চীন ও কোরিয়াও ব্যাপকভিত্তিক বিনিয়োগ সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করেছে। গত ২০০৮ সালে জাপানী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে এসেছিল বিনিয়োগ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য। ওই সময় বিদ্যুত ও জমি সমস্যার কারণে জাপান কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন বিদ্যুত সমস্যার সমাধান অনেকাংশে হয়ে গেছে। এছাড়া এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজ শেষ পর্যায়ে, পানগাঁও টার্মিনাল নির্মাণ শেষ হয়েছে। চলতি বাজেটে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারের এসব প্রস্তুতিতে সন্তুষ্ট বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। জানা গেছে, তৈরি পোশাক ছাড়াও টেক্সটাইল, ডায়িং, সিরামিকস, তথ্যপ্রযুক্তি, হস্তশিল্প, হিমায়িত খাদ্য, চামড়া, পাটপণ্য ও পর্যটন খাতে জাপান বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জাপান এখন বাংলাদেশের এসব পণ্যের বড় বাজারে পরিণত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, জাপানে পোশাক রফতানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বিনিয়োগ বোর্ড জানিয়েছে, জাপানের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বড় মাপের কারখানা স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আসিয়ানসহ চীন, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে তাদের গার্মেন্টস কারখানাগুলোও তারা বাংলাদেশে স্থানান্তরের আগ্রহ দেখিয়েছে। এর অন্যতম কারণ বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশই তরুণ এবং অপেক্ষাকৃত সস্তায় জনশক্তি পাওয়া যায়। জাপানের আগ্রহকে বাস্তবে পরিণত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের মে মাসে টোকিও সফরের সময় শুধু জাপানের বিনিয়োগকারীদের জন্য চট্টগ্রামে ৫০০ একরের একটি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। সে সময় রফতানি প্রস্তুতকরণ কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও জাপানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা (জেটরো) একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করে। সে চুক্তি অনুসারে, জাপানের বিনিয়োগকারীদের জন্য পাঁচটি ইপিজেডে ৪০টি প্লট ও দুটি ভবন জাপানের জন্য করা হয়েছে। এছাড়া শেখ হাসিনার সফরে বাংলাদেশকে জাপান বড় ধরনের ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে এ ঋণের অর্থে বিভিন্ন প্রকল্পে বাস্তবায়ন হবে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের প্রস্তাব আছে বাংলাদেশের। এর মধ্যে আছে গঙ্গা ব্যারাজ, যমুনা নদীর নিচে টানেল, যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো শুধু রেলের জন্য আরেকটি সেতু, বহুমুখী ঢাকা ইস্টার্ন বাইপাস ও ঢাকার চার পাশে থাকা চার নদীর জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনার মতো বৃহৎ অর্থায়নের প্রকল্প। এ প্রকল্পগুলোই বাছাই, সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও তদারকির জন্য যৌথ কাঠামো চাইছে জাপান। একই সঙ্গে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে দেশের সবচেয়ে বড় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প ও রাজধানীতে মেট্রোরেল প্রকল্পেও অর্থায়ন করছে জাপান।
×