ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণভবনে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়

বর্ষবরণে ধর্মীয় বাধা নিষেধ নেই ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

বর্ষবরণে ধর্মীয় বাধা নিষেধ নেই ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের বিরোধিতাকারীদের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, বর্ষবরণে ধর্মীয় কোন বাধা-নিষেধ নেই। দেশে বহু পার্বণ আছে। আমরা ঈদ পালন করি, সঙ্গে সঙ্গে পহেলা বৈশাখও পালন করি। এখানে ধর্মীয় কোন বাধা দেয়ার কিছু নেই। যারা নিষেধ করে, তারা কেন করে তা আমি জানি না। তারা কোন্্ ধর্ম পালন করে, আদৌ কোন ধর্ম পালন করে কি নাÑ সেটি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি করে এদের কেউ কেউ বোমা মেরে মানুষ পর্যন্ত হত্যা করেছে এবং হত্যার হুমকি দিচ্ছে। তারা আসলে আমাদের শান্তির ধর্ম ইসলামকে ক্ষতিগ্রস্ত করে অন্যদের এ সম্পর্কে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছে। ধর্মের প্রতি আঘাতকারীদের সতর্ক করে দিয়ে সহনশীলতার সঙ্গে সংস্কৃতি ও ধর্ম পালনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখা কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। এখন একটি ফ্যাশনে দাঁড়িয়ে গেছে যে, ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তা হয়ে গেল মুক্তচিন্তা। আমি এটাকে মুক্তচিন্তা দেখি না। এটাকে দেখি নোংরামি। এত নোংরা লেখা কেন লিখবে? মুক্তচিন্তার নামে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সম্পূর্ণ বিকৃত ও নোংরা রুচির পরিচায়ক। গত বৃহস্পতিবার বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন গণভবনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, দেশের আরও উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সকলকে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে বসবাস করতে হবে। কারণ শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় থাকা একটি বিরাট বিষয়। এছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যতটুকুই অগ্রগতি হয়েছে তা কেবল দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বলবৎ থাকায় সম্ভব হয়েছে। গত এক বছর দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় থাকায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশের বেশি এবং মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বর্ষবরণে ধর্মীয় কোন বাধা-নিষেধ নেই। সবাইকে ধর্মীয়ভাবে সহনশীল হতে হবে। সহনশীলতা শান্তি আনে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনে যারা বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করে তারা আদৌও কোন ধর্মের অনুসারী কি না আমার সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনকে অনেকেই অনেক রকম মন্তব্য করার চেষ্টা করেন। কেউ বলে ফেলে যে এটা হিন্দুয়ানি। আমরা মুসলমান হলেও বাংলাদেশে বাস করি। আমরা তো বাঙালী। কারণ বাঙালী হিসেবে যুদ্ধ করে আমরা দেশকে স্বাধীন করেছি। আমরা বাঙালী হলে যে মুসলমান হতে পারব না এ রকম তো কোন কথা নেই। ধর্মের কোথায় তা লেখা আছে? শেখ হাসিনা বলেন, এটা দুভার্গ্যজনক কতিপয় ব্যক্তি বা দল অন্য ধর্মের সমালোচনা করে। পবিত্র ধর্ম ইসলামে এ সম্পর্কে স্পষ্ট বলা হয়েছে- যার যার ধর্ম-কর্ম সে সে পালন করবে এবং অন্যের ধর্মমতে কোনভাবেই আঘাত করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রিয় নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা) নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে বলেন, ইসলাম কোনভাবেই ধর্মের নামে বিভ্রান্তি সৃষ্টি, হুমকি-ধমকি এবং বোমা মেরে মানুষ হত্যা সমর্থন করে না। যারা এসব করে তারা প্রকৃতপক্ষেই আমাদের ধর্মের ক্ষতি সাধন করে, বদনাম সৃষ্টি করে। যে কারণে অন্যরাও আমাদের ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায়। নবী করিম (সা) তো বলেই গেছেন যে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে শান্তি বজায় থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীও এখন ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করছে। আমাদের দেশের মানুষের উৎসবের জন্য শুধু উপলক্ষ লাগে। তারা বছরজুড়েই ঈদ, পূজা এবং পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে। সমাজের চিহ্নিত অপশক্তি যারা চিরাচরিত উৎসবকে ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করে তাদের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, যারা ধর্মের নামে এসব উৎসব উদযাপন বন্ধ করার হুমকি দেয় তারা প্রকৃতপক্ষে ধর্মকেই অবমাননা করে। শেখ হাসিনা বলেন, অনন্তকাল ধরেই এ দেশের মানুষ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালন করে আসছে। এরই অংশ হিসেবে বাঙালী জাতি বৈশাখের প্রথম দিনটি বাংলা নববর্ষ হিসেবে উদযাপন করে আসছে। যদিও অনেকেই একে ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে থাকেন। তিনি বলেন, আমরা মুসলিম এবং বাঙালী এবং আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেই বিজয় অর্জন করেছি। প্রধানমন্ত্রী আরব দেশগুলোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, আরব (সৌদি আরব), কাতার, কুয়েত এবং ফিলিস্তিনীরা আরব জাতি বলে পরিচিত, তাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। কিন্তু তারাও তো মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। আজকে পৃথিবীতে যেসব দেশে মুসলমান আছে সেই সব দেশের নামেই তো সেই জাতির নাম। আরব দেশের মানুষকে এ্যারাবিয়ান, ফিলিস্তিনীদের লোকদের পালেস্টাইনি বলেই ডাকা হয়। প্রত্যেকেরই তো পরিচয় দেশ, ভৌগোলিক সীমারেখায় সেই পরিচয় দেয়া হয়। তবে কি তাদের মুসলমানিত্ব চলে যাচ্ছে? তাদের মুসলমানিত্ব তো চলে যাচ্ছে না। পহেলা বৈশাখের নিরাপত্তাজনিত কড়াকড়ি নিয়ে সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরেকটা গ্রুপ আছে। আমরা মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সব সময় সচেতন। একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করার জন্য কী কী করণীয় আমরা তার কতগুলো অনুশাসন দেই। এই নির্দেশনা দেয়াতে অনেকে দেখলাম ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। যিনি ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, তাঁকে আমি বলতে চাই, যদি কোন অঘটন ঘটে, তার দায় কী তিনি নেবেন? তাকেই নিতে হবে, এটা মনে রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বোমা হামলার উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশেও বোমা হামলার ঘটনা ঘটছে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা সারা বিশ্বকে মর্মাহত করেছে, ভীতির সঞ্চার করেছে। দেশের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। আশা করব, সরকার যে নিরাপত্তা গ্রহণ করছে তার নিদের্শনা ও পরামর্শ সকলেই মেনে চলবেন। ধর্মীয় প্রসঙ্গে লেখালেখির ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি যাকে নবী মানি তাঁর সম্পর্কে নোংরা কথা যদি কেউ লেখে, সেটা কখনও আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ঠিক তেমনি অন্য ধর্মেরও যারা, তাঁর সম্পর্কেও কেউ কিছু যদি লেখে, তা হলে এটাও কখনও গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, একজন মুসলমান হিসেবে আমি প্রতিনিয়ত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলি। সেটা নিয়ে যদি কেউ লেখে, তাহলে আমার নিজেরও কষ্ট হয়। আর এই লেখার জন্য কোন অঘটন ঘটলে সেটা সরকারের ওপর আসবে কেন? এ সময় তিনি সবাইকে সংযম ও শালীনতা বজায় রেখে ‘অসভ্যতা’ পরিহার করার আহ্বান জানান। ধর্মের নামে মানুষ হত্যাকারীদের কঠোর সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ খুন করার মধ্যে সমস্যার সমাধান নেই। একজন লিখল, একজন খুন করে প্রতিশোধ নেবেÑ এটাও তো ইসলাম ধর্ম বলেনি। বিচার তো আল্লাহ করবে। আল্লাহই তো বলে দিয়েছেন, উনিই শেষ বিচার করবেন। যাদের আল্লাহর ওপর ভরসা নেই তারাই এই খুন-খারাবি করতে চায়। কারণ তারা আসলে আল্লাহ রসূলও মানে না, তারা নিজেরাই আল্লাহর কাজ করতে চেষ্টা করে। এটা তো শিরক। বক্তৃতার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী দেশী প্রবাসী সকল বাংলাদেশীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি সবার জীবনে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি কামনা করেন। তিনি বলেন, সরকার এবারই প্রথম সরকারী চাকুরেদের জন্য বৈশাখী ভাতা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করায় এবারের বর্ষবরণে এটি একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি বলেন, পয়লা বৈশাখে আমি কাউকে ইলিশ খেতে নিষেধ করিনি। তবে আমার খাদ্য তালিকায় ইলিশ ছিল না এবং কী কী ছিল সেটি জানিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি আশাপ্রকাশ করেন, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন কর্মসূচী আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। তিনি ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। এর আগে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ফুলের তোড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বাংলা নববর্ষ ১৪২৩ এর শুভেচ্ছা জানান। পরে দলের নেতাকর্মীসহ আগতদের দেশী ফলমূল, পিঠা, মুড়ি, নারু, কদমা, জিলেপী এবং বিভিন্ন মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, সতীশ চন্দ্র রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা লে. কর্নেল (অব) মুহম্মদ ফারুক খান, ড. আবদুস সোবহান গোলাপ প্রমুখ নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা নববর্ষ ১৪২৩ উপলক্ষে সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এ উপলক্ষে তিনি তাঁদের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ফুল, ফল ও মিষ্টি পাঠান। প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস)-১ জাহাঙ্গীর আলম, এপিএস-২ এ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর ও প্রটোকল অফিসার খুরশীদ-উল-আলম বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কেন্দ্রে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এসব উপহার হস্তান্তর করেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ঈদ ও পহেলা বৈশাখসহ সকল উৎসবে তাঁদের স্মরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য মোহাম্মদপুরে একটি বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। উল্লেখ্য, এই ভবনে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ৮০ পরিবার বসবাস করছে।
×