ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

দেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে

শাহীন রহমান ॥ নেপাল থেকে শুরু করে মনিপুরের ইম্ফল হয়ে মিয়ানমার। গত এক বছরে পরপর চারটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে দেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আভাস দিয়ে গেছে বড় ধরনের ভূমিকম্প এদিকেই আসছে। দেশে অবস্থানগত কারণেও ভূমিকম্পের আভাস অনেক আগ থেকে দিয়ে আসছে বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, পরপর চারটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর বড় ধরনে ভূমিকম্প ঝুঁকি নিয়ে এখন আর কোন বিতর্কও নেই। যত তাড়াতাড়ি ঝুঁকি মোকাবেলায় ব্যবস্থা নেয়া যাবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল। পূর্ব প্রস্তুতি থাকলেও ভূমিকম্পের ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ এড়ানো যাবে। তারা বলছেন, গত বছর ২৫ এপ্রিল ও ১২ মে নেপাল থেকে পরপর দুটি ভূমিকম্পের পর এ বছর জানুয়ারি ৪ ইম্ফল এবং সর্বশেষ মায়ানমার থেকে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্প জানান দিচ্ছে উৎপত্তি স্থলও ক্রমেই দেশের দিকে চলে আসছে। দেশের উত্তর দিকে হিমালয় ও উত্ত-পূর্ব দিকে বিভিন্ন বাউন্ডারি প্লেটের অবস্থানে কারণে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। দেশের চারদিকে ঘন ঘন শক্তিশালালী ভূমিকম্পের উৎপত্তিকে অশনি সঙ্কেত হিসেবেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি ভূতাত্ত্বি¡ক কাঠামোর কারণে অতিঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। সম্প্রতি উৎপত্তি হওয়া শক্তিশালী এসব ভূমিকম্প জানান দিচ্ছে কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দেশ। নেপাল ভূমিকম্প থেকে শুরু করে সর্বশেষ মিয়ানমার থেকে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্প বিবেচনায় নিলেও ঝুঁকির মাত্রা সহজেই অনুভব করা সম্ভব। তাদের মতে, সম্প্রতি উৎপত্তি হওয়া এসব ভূমিকম্পে মানুষ যতটা আতঙ্কিত হয়েছে অতীতের কোন ভূমিকম্পের জনগণকে এতটা আতঙ্কগ্রস্ত হতে দেখা যায়নি। পরপর শক্তিশালী ভূমিকম্প দেশের ভেতর থেকে উৎপত্তি না হলেও দেশে অবস্থানের কারণে ঝুঁকি বাড়ছে। আবার এসব ভূমিকম্পে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও জনগণের মনে ব্যাপক প্রভাব ঠিকই ফেলেছে যা আগে কখনও দেখা যায়নি। যার সর্বশেষ উদাহরণ গত বুধবার রাত ৭টা ৫৬ মিনিটে মিয়ানমারের ভূমিকম্প। সর্বশেষ গত বুধবারের ভূমিকম্পেও কোন বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও চট্টগ্রাম ও ফেনীতে ভূমিকম্পে ১০টি ভবন হেলে পডার ঘটনা ঘটেছে। আবার এর উৎপত্তি স্থলের অবস্থানগত কারণেও চট্টগ্রামের বেশ ঝুঁকির মধ্যে ছিল। উৎপত্তিস্থল মিয়ানমার থেকে খুব কাছাকাছি হওয়ায় চট্টগ্রামে ঝাঁকুনির মাত্রাও ঢাকার চেয়ে ছিল অনেক বেশি ও তীব্র। ভূমিকম্পের সময় বিভিন্ন বহুতল ভবন, বিপণিকেন্দ্র ও কারখানা থেকে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের ভূকিম্পের প্রচ- ঝাঁকুনিতে নগরের চাঁন্দগাঁও, হালিশহর আবাসিক এলাকা, লাভলেইন, জুবিলী রোড, সাগরিকা, রহমতগঞ্জ, জিইসি, মোমিন রোড ও ঝাউতলা এলাকায় ভবন হেলে পড়ার ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা থেকে ৪৬০ কিলোমিটার দূরত্বে এ ভূমিকম্পের উৎপত্তি হলে চট্টগ্রাম থেকে দূরত্বে মাত্রা ছিল অর্ধেক কম। এ বছর ৪ জানুয়ারি ভোরে গোটা দেশের মানুষ যখন ঘুমের মধ্যে ঠিক তখনি ভয়াবহ ভূমিকম্প মানুষের মনে বড় ধরনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে রাস্তায় বেরিয়ে আসে অধিকাংশ মানুষ। রিখটার স্কেলে ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.৭। ভারতের মনিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল থেকে ২৯ কিলোমিটার পশ্চিমে, যার দূরত্ব ঢাকা থেকে ৩৪৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। দূরত্ব বিবেচনা করলে এর উৎপত্তি দেশে জন্য বিপদের কারণ হতে পারত। এর রেশ কাটতে না কাটতেই আবার গত বুধবারের ভূমিকম্প মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রাত ৭টা ৫৬ মিনিট এই ভূমিকম্পর উৎপত্তি হয়। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের হিসাব অনুযায়ী এর মাত্রা ছিল ৬.৯। যা শক্তিশালী। দূরত্বের দিক দিয়েও দেশে সীমান্ত এলাকার নিকটের এর অবস্থান। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে ঢাকা থেকে ৪৬৫ কিলোমিটার পূর্বে হলেও চট্টগ্রাম থেকে নিকটেই এর অবস্থান। এ ভূমিকম্পে দীর্ঘক্ষণ ধরে ভবনগুলো দুলতে থাকায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন ভবন অফিস বাসাবাড়ি থেকে মানুষজন ভয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। এ সময় একে অপরের খোঁজ খবর নিতে দেখা যায়। তবে মোবাইল নেটওয়ার্কে বিঘœ ঘটায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। একে অপরের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য মোবাইলে চেষ্টা করতে থাকে। এসব বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখন একমত দেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে এ নিয়ে এখন আর দ্বিমতের কোন সুযোগ নেই। এখন বিষয়টি ঝুঁকি বিবেচনা করে সরকারের উচিত ভূমিকম্প মোকবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা। বিষেশ করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এখন চিহ্নিত করে ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া হলে ৫০ ভাগ ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে। তারা মনে করছেন রিক্ট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে প্রতিটি ভবনই ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেয়া হলে ঝুঁকিমাত্রা একেবারে কমে আসবে। এক্ষেত্রে তারা বলছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে ঝুঁকিপুর্ণ ভবনের সমস্যা চিহ্নিত করা যেতে পারে। এতে যদি কোন ভবনের কোন সমস্যা থাকে সে সমস্যা সমাধানের জন্য ভবনটিকে রেক্ট্রোফিট করে নিতে হবে। তাদের মতে, রেক্ট্রোফিট হলো এমন একটি প্রযুক্তি যেটা দিয়ে পুরনো ভবন না ভেঙে যথাযথ শক্তিশালী করা। রেক্ট্রোফিট করার ক্ষেত্রে দেশেও উদাহরণ রয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮৫ থেকে ৯০ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনকে রেক্ট্রোফিট করা হয়। এটি আগে চারতলা ছিল। কলাম ছিলই না। আরেকটা উদাহরণ হচ্ছে গুলশান শ্যুটিং ক্লাবের উল্টো দিকে ইউকেএআইডির একটা ভবন। আজকাল অনেক ভবন নতুনভাবে রেক্ট্রোফিট করা হচ্ছে। গত এক বছরে ১০ থেকে ১৫টা তৈরি পোশাকশিল্পের ভবন রেক্ট্রোফিট করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব¡ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, রেক্ট্রোফিটের মাধ্যমে ভবন নিরাপদ করার পাশপাশি জনসচেতনা তৈরি করা গেলে ঝুঁকি মাত্রা ৫০ ভাগ কমে আসবে। তার মতে, ভূমিকম্প হলো এমন একটি দুর্যোগ যা পূর্বাভাস ছাড়াই হানে। পৃথিবীতে যেসব প্রলংয়করী দুর্যোগ সৃষ্টি হয়েছে তার সবই ভূমিকম্প সৃষ্ট। তিনি জানান, দেশের উত্তাংশের পাশপাশি পূর্বাংশ এখন ভূমিকম্পের জন্য বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে যমুনা ও মেঘনা অববাহিকার পূর্ব অংশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে বিভিন্ন কারণে। এর মধ্যে রয়েছে তিন প্লেটের সংযোগ স্থল। যেখানে একটি প্লেটের সঙ্গে অন্য প্লেটের প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ চলছে। এছাড়া সিলেটের ডাউকি ফল্ট দেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে। এছাড়া ভারতের মনিপুর ও শিলং এলাকায় দেশে জন্য ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের উত্তর সীমান্ত বরাবর অবস্থিত ডাউকি চ্যুতি শিলং মালভূমির কারণে গঠিত হয়েছে। শিলং মালভূমির মনোরম পাহাড়পুঞ্জ মন কেড়ে নিলেও যেকোন সময়ে এটা দেশের জন্য হয়ে দাঁড়াতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিলং এবং আশপাশে প্রতিনিয়ত ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প জানান দিচ্ছে, শিলং ও আশপাশের এলাকাতে অধিক পরিমাণে চাপ সঞ্চিত হচ্ছে যা কিনা যেকোন সময় বড় মাত্রার ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে এবং বড় দুঃসংবাদ বয়ে আনতে পারে দেশের জন্য। তাদের মতে, টেকটোনিক প্লেট কাঠামো, বাংলাদেশের অবস্থানগত কারণসহ বিভিন্ন কারণে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্পনপ্রবণ এলাকায় পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভারত প্লেটের অংশ এবং উত্তর-পূর্বে ৩টি প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত। এ কারণে ভূমিকম্প নিয়ে শঙ্কা বেশি রয়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব প্লেটগুলোর গতি নির্ণয় করে দেখা গেছে ভারত প্লেট ইউরেশিয়া বর্মা প্লেট বাউন্ডারিতে গিয়ে আটকে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের ভেতরের ভূত্বকে প্রচুর পরিমাণ শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিন প্লেটের সীমান্তে অবস্থিত হওয়ার কারণেই বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্পন প্রবণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা, আরব সাগর ও বঙ্গোপসগার জুড়েই হলো ভারত প্লেটের অবস্থান। এই প্লেটের উত্তরের রয়েছে ইউরেশিয়া প্লেট। পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বে মুজ্জাফরাবাদ থেকে শুরু হয়ে হিমালয়ের দক্ষিণ পাদদেশ ঘেঁষে ভারতে উত্তর-পূর্ব অরুণাচল-চীন সীমান্ত পর্যন্ত ২৫শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। আর পূর্বে বর্মা প্লেটের সঙ্গে রয়েছে এর সংযোগ। এই সংযোগ উত্তরে অরুণাচল-চীন সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে মনিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পশ্চিম দিক দিয়ে আরও দক্ষিণে সুমাত্রা পর্যন্ত ৩ হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত। ফলে সোমবার ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলকে সঙ্গত কারণেই তারা ভূমিকম্পনপ্রবণ বলে উল্লেখ করছেন। সোমবারের ভূমিকম্পের ফলে এ চ্যুতি রেখা থেকে কিছু শক্তি ক্ষয় হলেও এখন প্রচুর শক্তি জমা রয়েছে। যা ভবিষ্যতের জন্য আরও বয়াবহ ভূকিম্পের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে বলে তারা উল্লেখ করেছেন।
×