ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সম্প্রীতির প্রকাশে সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দেয়ার প্রত্যয়;###;উৎসব-আনুষ্ঠানিকতায় পথে নেমেছে অগণন মানুষ;###;ঐতিহ্য ও শেকড় সংস্কৃতির জাগরণে জেগেছে প্রতিটি জনপদ;###;শৈল্পিক আবহে বর্ণিল মঙ্গল শোভাযাত্রা একাত্ম হয়েছে আনন্দ মিছিলে

মেতেছে সারাদেশ ॥ বর্ষবরণে উচ্ছ্বাসের নানা রঙের আনন্দঘন আয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

মেতেছে সারাদেশ ॥ বর্ষবরণে উচ্ছ্বাসের নানা রঙের আনন্দঘন আয়োজন

মনোয়ার হোসেন ॥ কোন কোন দিন আছে যার শুরুটা হয় সুন্দরের সহযোগে। এমন দিনে পরাস্ত হয় সকল অসুন্দর। সকাল থেকেই সূচনা হয় সম্প্রীতির। দিনভর গাওয়া হয় মানবতার গান। সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে অনর্গল বলে যায় বিশেষ উপলক্ষে বিকশিত হওয়া অন্তর। শেকড়ের সংস্কৃতির জাগরণে কেঁপে ওঠে ধর্মান্ধ উন্মাদরা। মানবিক সমাজের তাগিদে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদী চেতনা। ধর্মের বিভেদ রেখা ঘুচিয়ে দেয়া বাঙালী সত্তার কাছে হেরে যায় অপশক্তি। এভাবেই বৃহস্পতিবার আনন্দের সঙ্গে চেতনার বন্ধনে দ্রোহের প্রকাশে এসেছে বৈশাখ। মানবতার মর্মবাণীতে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে রুখে দেয়ার প্রত্যয়ে স্বাগত জানানো হয়েছে ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে। বর্ষবরণের আনন্দময় আয়োজনে ভেসেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ। মনের রঙে পরানের গহিনে বেজেছে মঙ্গলের বারতা। কল্যাণের আকাক্সক্ষায় পুরনো বছরের মলিনতা মুছে উচ্চারিত হয়েছে আলোর পথে চলার শপথ। বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে ব্যক্ত হয়েছে পরাজিত শক্তিকে রুখে দিয়ে মুক্ত চিন্তার কল্যাণময় স্বদেশ গড়ার কথা। সম্প্রীতির পথরেখায় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে দিনটিকে বরণ করে নিতে দেশবাসী মেতে উঠেছিল বৈশাখী আমেজে। গ্রামে-গঞ্জে বসেছে বৈশাখী মেলা। খোলা হয়েছে হালখাতা। গ্রামীণ জনপদের পাশাপাশি দেশের সব জেলা শহরে আড়ম্বরে পালিত হয়েছে পহেলা বৈশাখ। নববর্ষে রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছে উৎসবের নগরীতে। আনন্দ আবাহনে সকাল থেকে রাত অবধি পথে পথে নেমে এসেছে অগণন মানুষ। শহরের অলিগলিসহ রাজধানীর নানা প্রান্তে হয়েছে রকমারি উৎসব-আনুষ্ঠানিকতা। বৈশাখের বর্ণছটায় মন রাঙানো আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক আয়োজনের কমতি ছিল না কোথাও। বিকেল পাঁচটার পর উন্মুক্ত স্থানে বর্ষবরণ আনুষ্ঠানিকতায় ছিল বিধি-নিষেধের বেড়াজাল। বিকেল পাঁচটার পর উন্মুক্ত অনুষ্ঠান করতে না দেয়ায় এবার অনুষ্ঠিত হয়নি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নববর্ষের অনুষ্ঠান। এ প্রসঙ্গে জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ বলেন, ‘আইনী বাধ্যবাধকতার কারণে আমরা এটি মানতে বাধ্য হয়েছি। তবে সিদ্ধান্তটি ছিল অবিবেচনাপ্রসূত।’ বিকেলে উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠান হয়নি বলে থেমে যায়নি নববর্ষ উদ্্যাপনকারী নগরবাসীর স্রোতধারা। জাতিসত্তার বর্ণময় প্রকাশের দিনে সহজাতভাবেই আনন্দের সন্ধানে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে নগরবাসী। তাই তো সকালে রমনা বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতী অনুষ্ঠান ও চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার পর অলস দুপুরের কিছুটা বিরতি শেষে বিকেল থেকে রাত সব স্থানেই ছিল উৎসবে রঙিন হওয়া মানুষের ভিড়। খোঁজ মিলেছে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সীমারেখা পেরিয়ে যাওয়া উচ্ছ্বাসের। সব মিলিয়ে নববর্ষ উপলক্ষে সকাল থেকে রাত অবধি শহর পরিণত হয়েছে জনারণ্যে। শহরবাসীর নববর্ষের আনন্দ উদ্্যাপন আরও বেশি নির্মল হয়েছে ভুভুজেলা নামক যন্ত্রণাটি নিষিদ্ধ থাকায়। আমদানিকৃত ভিনদেশী সংস্কৃতির উৎকট শব্দযন্ত্রটির বিকট আওয়াজ শুনতে হয়নি নগরবাসীকে। রাজপথে ঘুরে বেড়ানো মানুষ পেয়েছে স্বস্তির আস্বাদ। তখনও পুব আকাশে ছড়ায়নি সূযের্র আলোকরেখা। পুরনো সব জরাজীর্ণতা মুছে নবপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় সূর্যোদয়ের আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে রাজধানবাসী। ঐতিহ্যের অনুসরণে ছুটে গেছেন রমনা বটমূলে। শরিক হয়েছে নববর্ষ উদ্্যাপনের ঐতিহ্যবাহী ছায়ানটের প্রভাতী বর্ষবরণ আয়োজনে। সকালের এ সময়টায় রাজধানীর বর্ষবরণ উদ্যাপনকারীদের পথের ঠিকানা ছিল একটাইÑরমনা বটমূল। গানের সুরে কিংবা কবিতার দোলায়িত ছন্দে উপভোগ করেছে নববর্ষের প্রথম প্রহরের অনাবিল আনন্দ। প্রভাতী অনুষ্ঠান শেষে উৎসব উদ্্যাপকারীরা ছুটে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে। অংশ নিয়েছেন নববর্ষের সর্বোচ্চ রং ছড়ানো মঙ্গল শোভাযাত্রায়। ঢাক-ঢোলসহ নানা বাদ্য-বাজনার তালে বর্ণবহুল শোভাযাত্রার নজরকাড়া নানা শৈল্পিক কাঠামোকে সঙ্গী করে একাত্ম হয়েছে আনন্দ মিছিলে। এ সময় শহুরে জনতার পদচারণায় রীতিমতো জনারণ্যে পরিণত হয় শাহবাগ-রমনা ও সোহাওয়ার্দী উদ্যানের নানা প্রান্ত। আমোদপ্রিয় বাঙালীর উৎসব আমেজের কাছে পাত্তা পায়নি বৈশাখের কাঠফাটা রোদ। ঝাঁঝালো রোদের তীব্র দাহকে পাশ কাটিয়ে চলেছে উৎসব অবগাহন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উৎসব উদ্্যাপনকারীদের আনাগোনোয় মুখরিত ছিল উৎসবে শাহবাগের আশপাশ। এ ছাড়াও নতুন ঢাকাসহ পুরনো ঢাকার নানা স্থানে ছিল বৈশাখী আয়োজন। নিরাপত্তাজনিত কারণে শাহবাগকেন্দ্রিক বৈশাখী উৎসবে কিছুটা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে রাজধানীবাসীকে। অনেকটা পথ হেঁটে তবেই পৌঁছতে হয়েছে গন্তব্যে। বাংলামোটর থেকে রূপসী বাংলা হয়ে রমনা, পল্টন, প্রেসক্লাব থেকে মৎস্য ভবন হয়ে রমনা, পুরান ঢাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে রমনা এবং ধানম-ি থেকে কাটাবন হয়ে রমনায় ঢোকার পথেই যান চলাচল বন্ধ ছিল। ধর্ম ও বর্ণের সঙ্গে বয়সের পার্থক্য পাশ কাটিয়ে দিনভর নববর্ষ উৎসবে মেতেছে নগরবাসী। বাবার কোলে মেয়ে কিংবা মায়ের হাত ধরে ছোট ছেলেটি হাজির হয়েছে নববর্ষ উদ্্যাপনের আয়োজনে। বাদ পড়েননি বাড়ির বয়স্ক সদস্যরাও। তারাও যোগ দিয়েছেন সর্বজনীন নববর্ষ উৎসবে। মননের সাথে সবার পোশাকেই ছিল উৎসব আমেজ। অধিকাংশ নারীই লাল, সাদা, নীল কিংবা বাসন্তীসহ নানা রঙের শাড়িতে আবৃত করেছে নিজেদের। সালোয়ার-কামিজ পরেও উৎসবে অংশ নিয়েছেন অনেকে। রূপসজ্জায় অনেকেই শরণাপন্ন হয়েছেন পুষ্পের । কেউ খোঁপায় গুজেছেন বেলি ফুলের মালা। আবার কেউবা লাল-সাদা গোলাপের সঙ্গে হলদে সূর্যমুখীসহ নানা রঙের ফুলের তৈরি টায়রা পরেছেন মাথায়। ছেলেরা নকশাকৃত বর্ণময় পাঞ্জাবি কিংবা ফতুয়া পরে অংশ নিয়েছেন উৎসবে। শিশুদের পোশাকেও ছিল হরেক রঙের বাহার। রাজধানীজুড়ে প্রাণকেন্দ্র শাহবাগসহ নানা প্রান্তে হয়েছে নববর্ষের অনুষ্ঠান। প্রতিটি আয়োজনেই উচ্চারিত হয়েছে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে বার্তা। নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন বন্ধে পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়েছে সুন্দর সুন্দর সমাজ গড়ার প্রত্যয়। মানুষ মানুষের জন্যÑ মর্মবাণীতে অকল্যাণের পথে চলা কূপম-ূক অশুভ শক্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে জানানো হয়েছে সম্ভাবনাময় সোনার বাংলা গড়ার আহ্বান। মানবতার মর্মবাণীতে ছায়ানটের বর্ষবরণ ॥ মানবতার মর্মবাণী ধারণ করে রমনা বটমূলে ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে বরণ করেছে ছায়ানট। মৌলবাদের বিনাশী ডাক ও সামাজিক অবক্ষয় রোধের আহ্বানে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠনটি গেয়েছে মানবতার জয়গান। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সলিল চৌধুরী, লালন সাঁইসহ বাঙালী মনীষীদের সৃষ্টির আশ্রয়ে সাজানো হয় প্রভাতী অনুষ্ঠানটি। অশ্বত্থ ছায়াবীথিতলে হাঁটু মুড়ে বিশাল মঞ্চের পাঁচটি সারিতে বসে পরিবেশনায় অংশ নেন প্রায় দেড় শ’ শিল্পী। লালপাড়ের সঙ্গে সাদা জমিনে আবৃত্ত ছিল শিল্পদের শাড়িগুলো। ছেলে শিল্পীরা পরেছিল সাদা পাঞ্জাবি। ১৫টি এককের সঙ্গে ১২টি সম্মেলক গান, তিনটি আবৃত্তি ও পাঠ দিয়ে সাজানো হয় অনুষ্ঠান। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় অনুষ্ঠান। সকালের রাগ আলাপ রাগ গুণকেলিতে সুর তোলেন অভিজিত কু-ু ও সুস্মিতা দেবনাথ শুচি। নতুনের আবাহনে একক কণ্ঠে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জাগো সকল অমৃতের অধিকারী’ গানটি গান শিল্পী ইলোরা আহমেদ শুক্লা। মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে মঙ্গল শোভাযাত্রা ॥ ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’ সেøাগানে এবার শহর ঘুরেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রার ভাবনায় ছিল সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। রূপকথার রাজা-রানী কিংবা পেঁচার মুখোশের সঙ্গে ৯টি বিশাল আকৃতির শিল্প কাঠামোয় সজ্জিত শোভাযাত্রার সামনে ছিল সহিংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যের প্রতীক গাছে বসে থাকা তিনটি পাখি। একেবারে শেষে ছিল বিশাল টেপা পুতুলে মা ও শিশুর অবয়ব। এছাড়াও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ছিল বিশাল আকৃতির হাতি। রাস্তায় ঘুরেছে সুদৃশ্য ময়ূরপঙ্খী নাও। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি বিবেচিত হয়েছে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে। দুর্নীতি ও জঙ্গীবাদ রুখে দাঁড়ানোর প্রতীকী হিসেবে ছিল একরোখা ষাঁড়। মাঝে প্রথম ও শেষের দুই শিল্পকাঠামোর মধ্য দিয়ে সব অবক্ষয়কে পাশ কাটিয়ে শান্তির বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ের ডাক দিয়েছে বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রা। বৈশাখী সকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে বের করা হয় ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রা। চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হওয়া শোভাযাত্রাটি রূপসী বাংলা মোড় ঘুরে টিএসসি হয়ে আবারও চারুকলার সামনে এসে শেষ হয়। সামনে-পেছনে ঢাক-ঢোলের বাদ্যির সঙ্গে নৃত্য, হাতে ধরা বিশালাকৃতির রঙ-বেরঙের মুখোশ। গ্রাম বাংলার লোকজ ঐতিহ্য টেপা পুতুল আর বাঁশের শিল্প কাঠামোয় উঠে আসে বাংলার ইতিহাস। সেসব প্রতীক বলেছে বাংলার সমৃদ্ধির কথা, বলেছে সাম্প্রতিক সময়ের অমঙ্গলের কথা। এসব দূর করে সবাইকে এক হয়ে দেশ গড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। শোভাযাত্রায় চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অংশ নেয় নানা শ্রেণী-পেশা ও বয়সের মানুষ। চারুশিক্ষার্থীদের উš§াতাল নৃত্যের সঙ্গে তারাও নেচেছেন, গেয়েছেন। বলেছেন মানবতার কথা। তাদের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক ভিনদেশীও অংশ নিয়ে জেনেছেন, বাঙালীর সংস্কৃতির কথা। চলমান সময়ে মায়ের হাতে সন্তান, সন্তানের হাতে মায়ের মৃত্য, শিশু নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা আর ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর আস্ফালন রুখে দেয়ার প্রত্যয়ে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয় ‘সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’। শোভাযাত্রার উদ্বোধনী বক্তব্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুনের দিকে আমরা ধাবিত হচ্ছি। আগের বছরের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে নতুন করে আমাদের পথ চলতে হবে। এবারের শোভাযাত্রায় মা ও সন্তানের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে কাজ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। আজকে যারা শিশু তারাই নেতৃত্ব দেবে আগামী দিনে । নতুন বছরে তাদের জন্য সুন্দর ও শান্তিময় বাংলাদেশ গড়ার দিকেও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। শোভাযাত্রার সম্মুখ ও শেষভাগে ছিল পুলিশ, র‌্যাব ও সোয়াতের নিরাপত্তা বলয়। ছিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিএনসিসির সদস্যরা। এছাড়া আকাশপথে ছিল হেলিকম্পটারে প্রহরা এবং পুলিশ-র‌্যাবের ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমেও ছিল সতর্ক দৃষ্টি। শোভাযাত্রায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় নববর্ষ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সহিদ আকতার হুসাইন, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দীন, কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ এম আমজাদ প্রমুখ। হাজারও কণ্ঠে কোটি বাঙালীর বর্ষবরণ ॥ কল্যাণ ও মঙ্গলময় জীবনের আহবান জানিয়ে নববর্ষ উদযাপন করেছে ‘সানসিল্ক হাজারও কণ্ঠে কোটি বাঙালীর বর্ষবরণ-১৪২৩। ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠিত হয় চ্যানেল আই ও সুরের ধারার এ যৌথ আয়োজন। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে এক হাজার শিল্পীর কণ্ঠে বর্ষবরণের গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। সেতার ও বাঁশি রাগ মূর্ছনায় ভোর ৬টায় বিভিন্ন বয়সী এক হাজার শিল্পী অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চে প্রবেশ করে। স্বাগত বক্তব্য রাখেন চ্যানেল আই-এর পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ ও শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা পরিবেশিত ওঠো ওঠো রে... গানটি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। নারকেলবীথি চত্বরে ঋষিজের বর্ষবরণ ॥ সাংস্কৃতিক শক্তিই পারে অপশক্তি রুখে দাঁড়াতে সেøাগানে বর্ণাঢ্য আয়োজনে নববর্ষ উদযাপন করেছে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী। বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহবাগে ভাসানী সড়কে শিশু পার্কের সামনে নারকেলবীথি চত্বরে বর্ষবরণের এ আয়োজন শুরু হয় সকাল সাড়ে ৭টায়। এ অনুষ্ঠানে সম্মাননা জানানো হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ফাহিম হোসেন চৌধুরী, শিল্পী অনিমা মুক্তি গোমেজ, রাজু আলীম ও শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. আলিমের মেয়ে ড. নুজাত চৌধুরীকে। আয়োজনটি উৎসর্গ করা হয় কবি রফিক আজাদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন, খালিদ মাহমুদ মিঠু, চিত্রনায়িকা দিতিসহ সংস্কৃতি অঙ্গনের সদ্য প্রয়াতদের স্মৃতির উদ্দেশে। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। বিশেষ অতিথি ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও ডাঃ অরূপ রতন চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর। মেয়র সাঈদ খোকন তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ঢাকাবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান। নববর্ষে বাংলা একাডেমির আয়োজন ॥ সঙ্গীত পরিবেশনা, নববর্ষ বিষয়ক আলোচনা, কুটির শিল্প মেলা ও বইয়ের আড়ং উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নববর্ষকে উদযাপন করছে বাংলা একাডেমি। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৭টায় একাডেমির রবীন্দ্র চত্বরে নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এমপি। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। বাংলা নববর্ষ বিষয়ে একক বক্তৃতা প্রদান করেন জামিল চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্পী তপন মাহমুদের পরিচালনায় ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন বৈতালিক রবীন্দ্রসঙ্গীতাঙ্গনের পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী অনিমা মুক্তি গোমেজ, এ.কে.এম শহীদ কবীর, অভিলাষ দাস, শান্তা সরকার, পল্লবী সরকার মালতী, তপন চন্দ্র ম-ল ও কোহিনূর আক্তার গোলাপী। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজন ॥ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে একাডেমির নন্দন মঞ্চে বিকেলে নববর্ষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যন্ত্রসঙ্গী, সম্মেলক ও একক গান, আবৃত্তি, পাঠ, সমবেত নৃত্য, পুঁথি পাঠ ও এ্যাক্রোবেটিকের মনোমুগ্ধ পরিবেশনায় সাজানো হয় বর্ণিল অনুষ্ঠানটি। মুুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নববর্ষ বরণ ॥ বৃহস্পতিবার সকালে নববর্ষ উদ্্যাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। সেগুনবাগিচার কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যজন ও নটরাজ। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেয় মৈত্রী শিশুদল, আগারগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও ছোলমাইদ উচ্চ বিদ্যালয়। বাউল গান পরিবেশন করে বাউল সোনিয়া ও তার দল। শিশু একাডেমির বর্ষবরণ ॥ ‘নতুন আশা-নতুন প্রাণ, নতুন সুরে-নতুন গান, নতুন ঊষার-নতুন আলো, নতুন বছর-কাটুক ভালো’ প্রতিপাদ্যে নববর্ষ উদ্যাপন করেছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। একাডেমির শহীদ মতিউর মুক্তমঞ্চে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং একাডেমি চত্বরে সকাল থেকে অনুর্ধ ১৬ বছরের ছেলে ও মেয়ে শিশুদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা (বিস্কুট দৌড়, মোরগ লড়াই, যেমন খুশি তেমন সাজো) এবং অভিভাবক ও কর্মকর্তাদের জন্যও বিভিন্ন প্রতিযোগিতা (ঝুড়িতে বল নিক্ষেপ, মিউজিক্যাল চেয়ার) অনুষ্ঠিত হয়। দুপুরে শহীদ মতিউর মুক্তমঞ্চে বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার প্রদান করেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন। এছাড়া একাডেমি চত্বরে আনন্দ উৎসব ও বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। মেলা ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিনই সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলবে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির বর্ষবরণ ॥ নান্দনিক সব আয়োজনে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) পহেলা বৈশাখ পালন করেছে। নববর্ষ উদ্্যাপনে আয়োজনে ছিল বৈশাখের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিশ্রুতিশীল সঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনা, গানের সঙ্গে নৃত্য, খ্যাতিমান বাচিক শিল্পীদের কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি এবং সবশেষে ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এ্যাক্রোবেটিক দলের অনবদ্য পরিবেশনা। এমন আয়োজনে দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক অঙ্গনের অনেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। এই আয়োজনের প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। কলাবাগান মাঠে মেলা ॥ নববর্ষে রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্র মাঠে বাংলা মা গ্রুপ আয়োজন করে তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থানের অর্ধশত বিভিন্ন পণ্যের স্টল অংশ নিয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল লাঠিখেলা, লোকগীতি, রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত, নৃত্য, জাদু, কৌতুকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। মেলা চলবে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এছাড়াও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলা, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র, বাংলামা, গুলশান সাউথ পার্ক ক্লাব লিমিটেড, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জনপ্রিয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে ছিল বৈশাখী কনসার্ট। পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে হয়েছে রকমারি অনুষ্ঠান।
×