ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাশেম খানের কাজ;###;বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

৭৫ -এ হাশেম খান

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

৭৫ -এ হাশেম খান

হাশেম খানের কথা যখন ভাবি তখন মনে হয়, তিনি তাঁর স্টুডিওতে দাঁড়িয়ে আছেন ব্রাশ হাতে, তাঁর চোখ খোলা, তিনি কিছু দেখছেন কিংবা ভাবছেন। তাঁর চেনা কিংবা ভাবা তাঁকে বদলে দেয়, তাঁকে মনে হয় অনেকটা সেইন্টের মতো, তাঁকে মনে হয় খুবই মডেস্ট ব্যক্তি। হাশেম খানের কাজ শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজের মতো, নিশ্চিত। বিষয় প্রায় একই। প্রতিটি কাজ, প্রতিটি ক্যানভাস, রঙের ক্ষেত্র, আর রঙের আলোক ভিন্ন, এই ভিন্নতাই বিশাল ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করে। এই ল্যান্ডস্কেপ কোথাকার? বাংলাদেশের, চাঁদপুরের, মেঘনা-ডাকাতিয়ার সঙ্গমস্থলের। শুধু একটা ল্যান্ডস্কেপ ছড়ানো, হয়ত চাঁদপুরের, হয়ত ঢাকার, হয়ত সিলেটের। যেখানে নদী আছে, সার সার নৌকা আছে, নৌকা দুলছে ঢেউয়ে, নৌকা ও নদীর ওপর ছায়া পড়েছে আকাশের। যত আমি দেখি তত আমার চোখ নিবদ্ধ হয়ে আসে, চোখ ভাবনামগ্ন হয়ে আসে। নদী আকাশ নৌকা গাছপালা থেকে ভাবনা আসে, পাখির ওড়াউড়ির মতো। হাশেম খান তাকিয়ে আছেন বাইরে, সেইন্টের মতো, যে সেইন্টের চোখে ঈশ্বর ছাড়া কিছু নেই, তেমনি হাশেম খানের চোখে নিসর্গ ছাড়া কিছু নেই। তিনি দেখছেন এবং ভাবছেন। দেখাটাই ভাবনা তাঁর কাছে। দেখা থেকে প্রতিভাস তৈরি হয়। প্রতিভাসকে উদ্ধার করতে চান হাশেম খান। ল্যান্ডস্কেপ হাশেম খানকে আকুল করে রাখে। তাঁর জমি এবং নদী সম্বন্ধে আকুলতা উত্তাল হয়ে ওঠে ল্যান্ডস্কেপের বিভিন্ন দৃশ্যে। ল্যান্ডস্কেপে তিনি মিলিয়েছেন ফিগর (মানুষ কিংবা নদী কিংবা নৌকা কিংবা পাখি) এবং দৃশ্যের সুন্দরের পর সুন্দর। মানুষ নদী নৌকা পাখি হয়ে ওঠে কাছের এবং দূরের রঙের ছোপ। এসব থেকে তিনি তৈরি করেন দূরের কিংবা কাছের ফিগর। ল্যান্ডস্কেপের পটভূমিতে মানুষ নদী নৌকা পাখি তার মায়াবী পোর্ট্রেট। এরা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌরাণিক ফিগর নয় কিংবা জয়নুল আবেদিনের কর্কশ রুক্ষ পেশল ফিগর নয়। এরা হাশেম খানের লাবণ্যময় ফিগর, তিনি এসব ফিগর দিয়ে প্রকৃতি কিংবা নিসর্গ জড়িয়ে ধরেন। এই জড়িয়ে ধরাটা নাটকীয়, যেখানে তিনি উজাড় করেন তাঁর সকল প্যাশন। তাঁর কাজের মধ্যে দূরের আভাস সব সময় থাকে। নিসর্গের বৈশিষ্ট্য দূরত্বে হারায় না, হারায় বরং কাছের উপস্থিতিতে। এটা একটা অপটিক্যাল প্রশ্ন নয়। চোখের ফোকাস নিয়ে প্রশ্নটা। আবার, কাছের বিষয় পরিমাপ করতে হবে কোমলতা ও অন্তরঙ্গতার আবেগের ভিত্তিতে। সেজন্য কোনো কিছু হারায় না কিংবা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয় না। হাশেম খান সমস্ত শরীর ও বোধ দিয়ে দেখেন এবং দেখাটা একটা কেন্দ্র পেয়ে যায়। হাশেম খানের কাজ আমাদের সরল করে, তেমনি সাহসী করে। সাহসী করার অর্থ : তাঁর কাজের ইমপ্রেশন বুঝতে পারি কিংবা ধরতে পারি। ইমপ্রেশন বেঁচে থাকে, একা এবং একাকী হয়ে। তাঁর ইমপ্রেশনের দিকে যত তাকাই কিংবা তাকিয়ে থাকি, ইমপ্রেশনপরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠে স্মৃতি। এই স্মৃতির কাছে তিনি আমাদের হাত ধরে নিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত রং জ্বলতে থাকে, রঙের মধ্যে নিজেদের চোখ ফোকাস করি। আমরা দেখি। (সংক্ষেপিত) হাশেম খান মুনতাসীর মামুন হাশেম খানকে শুধু ‘শুদ্ধ শিল্পী’ হিসেবে আমি বিচার করতে চাই না। তিনি চিত্রকর বা শিল্পী তো বটেই, কিন্তু বাংলাদেশে তাঁর পরিচয় এতেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি প্রচ্ছদ শিল্পী, বই নকশাকার, পোস্টার ডিজাইনার, শিশুসংগঠক, প্রতিষ্ঠান নির্মাতা এবং লেখক। কিন্তু সব কিছুই তাঁর উৎসারিত হয়েছে শিল্পকলা থেকে, শিল্পবোধ থেকে। বাংলাদেশের একটি শিশু যখন পড়তে শেখে তখন সে প্রথমে দেখে হাশেম খানের সচিত্রকরণ। নিসর্গ, বালক-বালিকা, পাখি, ফুল প্রভৃতি। অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের শিশুরা হাশেম খানের চোখ দিয়ে প্রথম দেখে এ দেশের ঋতু, গাছ-পালা, ফুল-পাখি বা বাংলাদেশকে। গত পাঁচ দশক হাশেম খান প্রাথমিক শিক্ষার প্রায় সমস্ত বইয়েরই নকশাকার। নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। এবং বাংলাদেশকে শিশুর অন্তরে প্রবিষ্ট করিয়েছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক অজ পাড়াগাঁয়ে হাশেম খানের সঙ্গে হাঁটছি। মধ্য তিরিশের এক যুবক এসে বললেন, আপনি হাশেম খান? বইয়ে বইয়ে আপনার ছবি দেখে বড় হয়েছি। শিশুটি যখন পাঠ্যবই ছাড়া অন্যান্য বই পড়তে শেখে তখনও সে আবার মুখোমুখি হয় হাশেম খানের। ছড়ার বইয়ের মনোলোভা ইলাস্ট্রেশন, গল্পের বইয়ের সচিত্রকরণ, শিশু-কিশোরটিকে নিয়ে যায় কল্পনার জগতে। তাকে ভাবতে শেখায়, কল্পনা করতে শেখায়, তার সৃজনশীলতা উন্মোচন করে। গত চার দশকে বাংলাদেশে যাবতীয় শিশুতোষ গ্রন্থের অন্যতম নকশাকার হাশেম খান। শিশুটি যখন কিশোর হয় তখন আবার সে হয়ত মুখোমুখি হয় হাশেম খানের। কচিকাঁচার মেলার শুরু থেকে তিনি এর সঙ্গে জড়িত। দেশজুড়ে কিশোর সংগঠন আছে একমাত্র কচিকাঁচার। এর বিকাশে হাশেম খানের অবদান অনেক। এই সূত্রে তিনি চষে বেড়িয়েছেন সারা বাংলাদেশ। শিশু-কিশোরদের আঁকতে শিখিয়েছেন, শিল্পকলার প্রতি মনোযোগ তৈরিতে সাহায্য করেছেন। হাশেম খান তাদের মুরুব্বি নয়, বন্ধু। কিশোরটি যখন যুবক হয় তখন হয়ত তার সঙ্গে আবার হাশেম খানের দেখা হয়, রাস্তায় ‘আন্দোলনে প্রতিবাদের মিছিলে’। ১৯৬৯ সাল থেকে সমস্ত গণআন্দোলনের সঙ্গে হাশেম খান জড়িত। মিছিলে তাঁকে পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ছবি, আলপনা আঁকায়। আরো আগে যখন ছয় দফার পোস্টার করা হয়, তখন লোগো ও ছয়দফা প্রচারের আঁকা-আঁকিতে ডাক পড়েছিল হাশেম খানের। ১৯৭০-এর ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’, এই বিখ্যাত পোস্টারটি তাঁরই আঁকা। বাংলাদেশের সংবিধান অলংকরণে ও বই নকশার প্রধান শিল্পী ছিলেন তিনিই। ১৯৭৫-এর পরও যত গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে সেখানেও সক্রিয় ছিলেন তিনি, নাট্য আন্দোলনে সহায়তা করেছেন তাদের পোস্টার এঁকে। আরো আছে, এদেশে থিমেটিক ক্যালেন্ডার প্রকাশের যে জোয়ার তারও অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। হাশেম খান তাঁর কর্মজীবন অতিবাহিত করছেন চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হিসেবে। শুধু ছাত্র তৈরি করেননি, ছাত্রদের বহুল পঠিত ‘চারুকলা পাঠ’ তাঁরই রচনা। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে চারুকলার পাঠক্রম তাঁরই তৈরি। লিখেছেন শিশুতোষ এবং মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত গ্রন্থ। ‘চারুকলা’ বিষয়টি মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে বর্তমানে আবশ্যিক পাঠ্য বিষয়। এটি তাঁরই কৃতিত্ব। অনেকে হয়তো জানেন কিনা জানি না, বঙ্গবন্ধু জাদুঘর ও ঢাকা নগর জাদুঘর তাঁর সক্রিয় সহযোগিতা না থাকলে প্রতিষ্ঠা করা হতো দুরূহ। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউটের জাদুঘর ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণে তিনি ছিলেন সক্রিয়। শিল্পীদের সংগঠনেরও তিনি ছিলেন সভাপতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘টাকা জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠায় আমরা চার প্রধান ব্যক্তিত্বের অন্যতম শিল্পী হাশেম খান। ২০১২ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি কর্তৃক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর বিষয়ে ২৫টি বই ও এ্যালবামের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন হাশেম খান। এ সমস্ত কাজের ফিরিস্তি দিলাম হাশেম খানকে বোঝার জন্য, তাঁর ছবির পটভূমি বা নির্মাণ বোঝার জন্য। এ সমস্ত তাঁর সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অংশমাত্র। তিনি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত থেকেছেন, মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়েছেন; কারণ, এই দেশের প্রতি ভালোবাসা তাঁর অসীম। চাঁদপুরে তার জন্ম, কৈশোর কেটেছে সেখানে তারপর থিতু হয়েছেন ঢাকায়। চার দশকে বর্তমান ঢাকার গড়ে ওঠাটাকেও প্রত্যক্ষ করেছেন। এ দেশটিকে ভালোবাসেন, গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধশালী একটি দেশ হিসেবে তিনি এ ভূখণ্ডকে দেখতে চেয়েছেন যেখানে সংস্কৃতির সুষ্ঠু বিকাশ হবে। এটিকে তিনি একজন সচেতন মানুষের বোধ হিসেবে বিচার করেছেন যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিল্পবোধ। তাঁর বই নকশা, আলপনা আঁকা, সংগঠন করা, সব কিছুুই ছিল শিল্পের প্রায়োগিক ক্ষেত্র। শিল্পকে সাধারণের সংলগ্ন করা, যা আমাদের দেশের অধিকাংশ শিল্পীরা উপেক্ষা করেছেন। এই চর্চা যাতে অব্যাহত থাকে এ কারণে প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানের। এবং সেজন্য প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে তিনি এগিয়ে এসেছেন। ‘শুদ্ধ শিল্প’ তো আছেই। তাঁর এই জীবনবোধ অন্তিমে সঞ্চারিত করেছেন চিত্রকলায়, এভাবে একটি শিশুর কাছে, একজন যুবকের কাছে, একজন সক্রিয়তাবাদীর কাছে মধ্যবিত্ত রুচিশীল পরিবারে হাশেম খান হয়ে উঠেছেন অনন্য। সে জন্য তাঁর চিত্রকলার বিষয়, নির্মাণ, মেলানো যাবে না কারো সঙ্গে। কারণ, এসব বিষয়, উপাদান তিনি সঞ্চয় করেছেন বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে এবং তাই পরিস্ফুট হয়েছে ক্যানভাসে। রং, নির্মাণশৈলীও অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়েছে সেই বোধ থেকে। এভাবে হাশেম খান হয়ে ওঠেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ, একজন ব্যতিক্রমী শিল্পী। একটি ছবির গুণ কী? সাধারণ দর্শক হিসেবে বলব, যে ছবি দুদণ্ড দেখতে ইচ্ছে করে এবং মনে গেঁথে থাকে। তারপর আসে শিল্পীর কলাকৌশল, প্রতীক ইত্যাদি। হাশেম খানের ছবিতে রাজনীতি আছে, সমাজ আছে, বিভিন্ন প্রতীকের বিভিন্ন ব্যবহার আছে। একেবারে নির্বস্তুক ছবিও আছে। রংয়ের ওপর রং চাপিয়ে দেয়া। এসব ছবির অর্থ না খুঁজলেও চলে। আমার তাঁর নৌকা, পাখি বা এমনকি বাংলার বিদ্রোহের সামনে দাঁড়ালেও ভালো লাগে। এটিই হচ্ছে মূল বিষয় এবং এখানেই একজন শিল্পীর সার্থকতা। এই দুই অর্থেই তিনি শিল্পী যিনি আলাদা একটি ধারার সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। হাশেম খানের ছবি রবিউল হুসাইন একজন প্রকৃত শিল্পী বহুবোধে প্রভাবান্বিত হয়ে থাকেন, হতে পারে তা সমাজ, রাজনীতি, লৌকিক আচার ও সনাতন শিল্পের ধারাবাহিকতা, বৈশ্বিক বা আধুনিক মননের প্রাতিস্বিকতা, নিসর্গ, জীবজন্তু, প্রাণী, পক্ষীকুল, কীটপতঙ্গ বলা যায় আপামর বিশ্বের যাবতীয় : অন্তর্ভুক্ত সদস্যের প্রতিভূরা এবং এর সঙ্গে যোগ হয় বিশ্বের প্রকৃতি দ্বারা নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ জীবকুল মানুষের অন্তর্গত অবচেতনার সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, প্রেম বা অপ্রেমের বিশাল রহস্যময় জগত। শিল্পী হাশেম খান ক্রমাগতভাবে ওসব প্রাগুক্ত বিষয়ে বাস্তবিক আকার ও গঠন, রং, রেখা আর বুনুনি দিয়ে তাঁর আপন পটভূমি বিম্বিত করে চলেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি এসব জটিল বিষয়কে একটি পরিসরে দৃষ্টিনন্দন, চক্ষুপ্রিয় এবং চিন্তাশীল করে তুলে খুব অকপট ও সহজভাবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন। আপাত সরল উপস্থাপনা-উজ্জ্বল রং-এর মাধ্যমে সূক্ষ্ম তুলির ব্যাপ্তি সেখানে চ্যাপ্টা ব্রাশে অবগাহিত হয়ে বিষয়কে খুব প্রত্যক্ষভাবে হাজির করা হয়, সেখানে শিল্পীর নিরীক্ষাধর্মী প্রয়াসের বলিষ্ঠ স্বাক্ষরতা রাখে এবং সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যগ্রাহ্য বিষয়ের প্রতি একটি প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি করে এবং উৎস থেকে একটি বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তার প্রক্রিয়া উদ্ভাসিত হয়, এ কথার অত্যুক্তি হয় না। শিল্পীর আর একটি সফল উপস্থাপনা-সৃষ্টি তা হলো সাধারণ এবং বহুল ব্যবহৃত চিত্র বিষয়, যেমন নারী, বৃক্ষ, নৌকো, মাছ, জাল, কিশোর কালের উড্ডীয়মান ঘুড়ি, পাখিÑ এ সবের উপস্থাপনা তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বলা যায় যে এ শিল্পকর্ম হাশেম খানের একান্ত পরিচয়ের সাক্ষ্য বহন করছে। এ অর্জনটি প্রত্যেক শিল্পীরই কাম্য যা তাঁর নিজস্ব শিল্পভাষা। শিল্পী একজন সামাজিক জীব এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি বহমান স্বচ্ছ রাজনৈতিক প্রভাবের আওতাধীন যদিও সেটি তাঁর একান্ত মনোগত দৈশিক ইতিহাসÑ অন্তর্গত চিন্তা-চেতনার বিষয়। এরূপ রাজনৈতিক ঘটনা বা ব্যক্তিত্বকে নিয়ে শিল্পী হাশেম খান শিল্পসৃষ্টির একটি নতুন পথে অগ্রসরমান যা তার ছবিতে বোধকরি নতুন সংযোজন এবং আশ্চর্যজনকভাবে তিনি এরূপ পোস্টার বা সরাসরি বক্তব্য প্রধান বিষয়কে শিল্পে উন্নত করেছেন সফলভাবে। বাংলা ভাষা বা মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধুর সাত-ই মার্চের ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সৃষ্টির শুভ ঘোষণাÑ এসব নিয়ে শিল্পী ছবি সৃষ্টি করেছেন যা তাঁর শিল্প অন্বেষার নিরন্তর প্রচেষ্টা। এর মধ্যে একটি প্রবল ঝুঁকিও বিদ্যমান। তিনি সফলভাবে সে ঝুঁকিকে অতিক্রম করেছেন। আধা-বিমূর্ত আধা-বাস্তবতাসমৃদ্ধ চেনা অবয়ব যেমন দেশকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে, পাশাপাশি নৈরূপ্যরীতির অভিজ্ঞতাও পৃথক বৈশ্বিক অস্তিত্ব বহন করে। শিল্পী এ দু’টিকে একত্রীকরণ করেছেন এবং তাঁর পক্ষপাতিত্ব প্রথম পক্ষের দিকে বলা যায়। এসব মিলিয়ে তাঁর ছবি মিশ্ররীতির পর্যায়ভুক্ত এবং সৃষ্ট। শিল্পী একজন প্রথম শ্রেণীর প্রচ্ছদ ও পোস্টার স্রষ্টা। প্রকাশনা ও মুদ্রণ জগতে তা রুচিস্নিগ্ধ নক্সা ও অলংকরণ একটি মূলবান প্রাপ্তি ও সংযোজন। খুব স্বাভাবিকভাবে তাঁর মূল ছবিতে এই বিষয়গুলোর প্রভাব পড়ে। তিনি তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না বরং সেটিকে তাঁর নিজ শিল্প ক্ষমতা, আঙ্গিকে এবং নৈপুণ্যে শিল্পের আকর্ষণীয় ও ভাবোদ্দীপক মহিমা প্রদান করেন। (সংক্ষেপিত) শিল্পী ও শিক্ষক রোকেয়া সুলতানা একজন মানুষের কথা ভাবলে, আমার চোখে ভাসে গোটা বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি গ্রাম বাংলা, আমাদের পল্লীবধূ কাক, কবুতর টিয়া, তালগাছ, নদী, জেলে, গরু-ছাগল, ও সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। কার কথা বলছি? তিনি আমার আমাদের পরম প্রিয়শিল্পী শিক্ষক শ্রদ্ধেয় হাশেম খান। আমার ছোট বেলায় বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে থাকতাম প্রবাসী বাঙালী ‘পশ্চিম পাকিস্তানে’ কিন্তু বাবার অক্লান্ত চেষ্টায় আমাদের বাংলা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়েছে। বাংলা বইগুলো হাতে নিলে বইয়ের পাতায় পাতায় কে যেন পুরো গ্রাম বাংলাকে ও বাংলাদেশকে ছবির মতো সাজিয়ে দিয়েছে। অঙ্কনে অঙ্কনে ড্রইং করে সেই আমার ড্রইংয়ে শিক্ষা। আমার বড় দুই বোন ছবি আঁকতেন তারাও সেই সুদূরে বসে পল্লী বাংলার ছবি আঁকতেন। আমিও বসে পরলাম হাশেম খান স্যারের বই দেখে দেখে বাংলাদেশের গ্রামের ছবি আঁকতে যেই দেশকে দেখি নাই স্যার আমার চোখের সামনে পরতে পরতে পর্দা উন্মোচন করে যাচ্ছেন নদী, নদীর মধ্যে দিয়ে নৌকা বেয়ে চলে যাচ্ছে মাঝি, দুই পারে হিজল তমাল বন তালগাছ, নারিকেল গাছ, গ্রামের কৃষক, কুমার-জেলে আরও কত কিছু। আমিও দৃশ্যবলী এঁকে যেতাম শিশুর মন নিয়ে। স্যারকে প্রথম দেখি আমার চারুকলার ভর্তি পরীক্ষাতে। আমার নক্সা অঙ্কন পরীক্ষার দিন হঠাৎ দেখি একজন দেখতে সুন্দর একটু জাপানিজ দেখতে, আমাকে এসে বলছেন, কেমন হচ্ছে পরীক্ষা? ভয়ের কিছু নাই, এঁকে ফেল। একজনকে জিজ্ঞাস করে জানলাম উনি সেই আমার ও আমাদের ভাই-বোনের রূপকথার নায়ক শিল্পী (আমার গুরু শিক্ষক) হাশেম খান। পরবর্তীতে আমার শিক্ষা জীবন শেষ করে শিল্পকলার রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম শিল্পী হতে হবে। খালি শুনি মেয়েরা ছবি আঁকে না, শিল্পী হয় না, সার্টিফিকেট নিয়ে বিয়ে করে চলে যায়, সিট নষ্ট করে। আমার প্রতিনিয়ত চেষ্টা এটা ভুল প্রমাণ করা। অনেক কাজ করি এবং শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করি। যাত্রা পথে প্রতিনিয়ত আমার গুরু শিক্ষক হাশেম খানের উৎসাহ পেয়েছি সব সময়, বলেছেন কাজ কর ভাল হবেই। আমার ঝুলিতে অনেক সাফল্য যা আমার এই গুরুদের দেয়া। মানুষ হাশেম খান খুবই বিনয়ী ও অসম্ভব ভাল হৃদয়ের মানুষ। দীর্ঘকাল স্যারদের সহকর্মী হয়ে পথ চলেছি। চলছি বিভিন্ন উদ্ভত পরিস্থিতিতে স্যারকে মাথা ঠা-া রেখে সকলকে নিয়ে বুঝিয়ে চলতে দেখেছি। ছাত্রছাত্রীদের খুব জনপ্রিয় শিক্ষক। দেশের বাইরে আমার কয়েকবার স্যারের যাত্রাসঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছে স্যারকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। সবসময় স্যার খেয়াল রেখেছেন সকলের। আর বিশেষ সময়ে স্যারের সঙ্গে দেশ থেকে আনা বাদাম ও ছোট ছোট খাদ্যসামগ্রী আমাদের তাল সামলিয়েছে। এটা নিয়ে আমরা স্যারের সঙ্গে খুব মজা করি। স্যারের পেইন্টিং আমাকে অবাক বিস্ময়ের রাজ্যে নিয়ে যায়। রঙের ওপর স্যারের অসীম দখল। স্যার একটা ছবিতে একটি বা দুটি রঙ নিয়ে খেলা (এক্সপেরিমেন্ট) করেন। কীভাবে একটা সবুজ গাঢ় থেকে আরও গাঢ়তর ও সেখানে হালকা হতে হতে একেবারে আর একটা রঙে মিলিয়ে গেল আমি অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকি। তারপর হঠাৎ কোথা থেকে একটু সাদা চলে এলো এবং পিগমেন্টে মোটা মোটা রেখা (লাইন) দেন উনি সাবলীলভাবে। কারণ ওনার ড্রইং খুবই স্ট্রং। কাক যে মায়াবী হতে পারে স্যারের হলুদ বা সবুজ পটভূমিকায় কালো কাক দেখলে বোঝা যায়। অসাধারণ! কলসি কাঁখে মেয়ে বাংলার চিরন্তন দৃশ্য কিন্তু এই চিরন্তন দৃশ্য স্যারের মায়াবী ও বলিষ্ঠ তুলির আঁচড়ে মেঘ বালিকা হয়ে যায়। মেঘ নিয়ে স্যারকে সুন্দর খেলা করতে দেখেছি। পুরো বাংলা খুঁজে পাই আমি স্যারের ছবিতে। বাংলা অক্ষরের ব্যবহার স্বাধীনতাযুদ্ধ, ছয় দফা পুরো আমাদের ইতিহাস তুলে এনেছেন লিখে ফেলেছেন। স্যারের কাজ অনুকরণ করা খুব কঠিন, কারণ খুব ইউনিকতা। তার তুলির টান বা পিগমেন্টের বলিষ্ঠতা ও রঙের মায়াবী আলিঙ্গন একের পর এক পরতে পরতে। তাঁর পেইন্টিং একবারে নিজের, পৃথিবীর কারও সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই বাঙাল শিল্পী আমার গুরু শিল্পী হাশেম খান। লেখক : অধ্যাপক, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×