ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : মানস ঘোষ;###;অনুবাদ : এনামুল হক

দুর্ভাগ্য তাড়া করে চলেছে মমতা ব্যানার্জীকে

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

দুর্ভাগ্য তাড়া করে চলেছে  মমতা ব্যানার্জীকে

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জী ও তার দলকে দুর্ভাগ্য সর্বক্ষণ তাড়া করে চলেছে। তাকে ও তার বিশ্বস্ত সহকর্মীদের জড়িয়ে একের পর এক স্ক্যান্ডাল ও অন্যান্য চাঞ্চল্যকর কাহিনী নিয়মিত বিরতিতে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। এতে করে সততা ও ন্যায়পরতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে মমতার ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তার দলের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের যে সম্ভাবনা ছিল এর ফলে তা ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে চলেছে। কাজেই ২০৬ আসন নিয়ে ২০১১ সালের মতো নির্বাচনী ফলের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর সম্ভাবনা তার তৃণমূল কংগ্রেসের নেই কিংবা সামান্যই আছে। পক্ষান্তরে তার দল যে বেশকিছু আসনে হারবে সেটা অবধারিত। এতে করে বিধানসভায় সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা তার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। এমন সব সম্ভাবনার কারণে ইদানীং মমমতার কণ্ঠে নরম ও আপোসকামী সুর শোনা যাচ্ছে। এই নির্বাচনী লড়াইয়ে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট ঐতিহাসিক নির্বাচনী জোট গঠনের মধ্য দিয়ে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। পশ্চিমবঙ্গ ও জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যত নির্ধারণে এই জোট ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট স্বাধীনতার পর থেকেই এই রাজ্যে একে অপরের জাত শত্রু ছিল। কিন্তু মমতার দমনপীড়ন নীতির কারণে তারা একত্রিত হতে বাধ্য হয়েছে। মমতার লক্ষ্য হলো মারো-ধরো কৌশলের আশ্রয় নিয়ে এই দুটি দলকে সাংগঠনিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া, যাতে করে রাজ্যে কোন ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতার অস্তিত্ব না থাকে। মমতার এই দমনমূলক নীতির আসল ধাক্কাটা যাদের উপর দিয়ে গেছে তারা হলো এই দুটি বিরোধীদলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও সমর্থকবৃন্দ। এরা নিজেদের তথা দলের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিজ নিজ দলের নেতৃত্বকে জোট গঠনে বাধ্য করেছে। তাদের অন্য লক্ষ্য ছিল এই যে, এ দুটি দল যাতে নির্বাচনে জনে জনে ভিত্তিতে তৃণমূল কংগ্রেসের মোকাবেলা করতে পারে। কারণ বিরোধী শিবিরে ভোটের বিভাজন মমতাকে সর্বদাই নির্বাচনে সুবিধা এনে দিয়েছে। সেই সুবিধা তারা তাঁকে এবারের নির্বাচনে দিতে চায়নি। নিজেদের ভোগের ভাগ একত্রিত করলে এই দুটি দল শুধু যে তৃণমূল কংগ্রেসের সমান পর্যায়ে এসে দাঁড়াবে তাই নয়, উপরন্তু বাড়তি কিছু সুবিধাও লাভ করবে। কেননা গত পাঁচ বছরে মমতার স্বৈরাচারী শাসনের কারণে তার বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী মনোভাব প্রবল আকারে বিরাজ করছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, কংগ্রেস ও বামদলগুলোর নেতারা এই নির্বাচনে মমতার বিরুদ্ধে একটা যুক্তফ্রন্ট দাঁড় করাবার জন্য ঐকান্তিকভাবে কাজ করে চলেছেন। যৌথ নির্বাচনী প্রচারের মধ্য দিয়ে তারা এমন এক রাজনৈতিক রসায়ন গড়ে তুলেছেন যাতে করে ৩০ শতাংশ বাম ভোট কংগ্রেসের পক্ষে এবং প্রায় ১০ শতাংশ কংগ্রেসী ভোট বাম দলগুলোর পক্ষে পাওয়া সুনিশ্চিত হয়। আর সেটাই যদি ঘটে তাহলে রাজ্যের নির্বাচনের ইতিহাসে তা এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। বাম প্রার্থীদের বিজয় সুনিশ্চিত করার জন্য সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী কংগ্রেস ভোটারদের যেভাবে উপদেশ-নির্দেশ দিয়েছেন তাতে কংগ্রেস-বাম জোটের হাতে বাড়তি শক্তি এসে যোগ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজ্য নির্বাচনী প্রচার শুরু করার পর বিজেপির নির্বাচনী সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে। সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে মমতার সংশ্লিতার অভিযোগ এনে এবং সম্প্রতি কলকাতায় বিবেকানন্দ ফ্লাইওভার ধসে পড়ার ঘটনাকে তাঁর ‘জালিয়াতি কার্যকলাপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মোদি যেভাবে মমতার শাণিত সমালোচনা করেছেন তাতে নির্বাচনী লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য স্থবির রাজ্য বিজেপির মধ্যেও নতুন করে প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসকে তিনি ‘সন্ত্রাস’, ‘মৃত্যু’ ও ‘দুর্নীতির’ প্রতিশব্দ হিসেবে যেভাবে চিত্রিত করেছেন তাতে তার এই কথাগুলো মিডিয়া ও বিরোধী শিবিরে রাতারাতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রবচনে পরিণত হয়েছে। আশ্চর্যের কিছু নেই যে, বিজেপি এই নির্বাচনে ভাল ফল করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে চলেছে এবং প্রধানত কলকাতা ও এর আশপাশের এলাকায় তৃণমূলের কাছ থেকে পাঁচ কি ছয়টি আসন ছিনিয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী চ্যালেঞ্জকে এত গুরুত্বসহকারে মোকাবেলা করতে কংগ্রেস-বামজোট ও বিজেপিকে একটা বিষয় বেশ সাহায্য করেছে। যেটা হলো শাসকদলের লাগামহীন দুর্নীতির পীড়াদায়ক রেকর্ড। তাছাড়া নারদা টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সচিত্র পরিবেশনাও তাদের জন্য সহায়ক হয়েছে। সেই সচিত্র প্রতিবেদনে মমতার ৩ সিনিয়র মন্ত্রী ও দলের ৭ জন এমপি এবং তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ একজন পুলিশের এডিজির লাখ লাখ রুপির ঘুষ গ্রহণের দৃশ্য পরিবেশিত হয়েছে। টিভির এই সচিত্র প্রতিবেদনটি অবজ্ঞাভরে উড়িয়ে দিতে মমতা যেরূপ দুর্বিনীত ও নির্লজ্জভাবে চেষ্টা চালিয়েছিলেন সেটাও তাঁর বিরোধীদের হাতে বাড়তি অস্ত্র হিসেবে যোগ হয়েছে। এসব কিছুই বিরোধী শিবিরের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে গতিবেগ সঞ্চার করেছে। টিভির ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সচিত্র পরিবেশনা মমতার রাজনৈতিক ও ব্যক্তি ভাবমূর্তি দারুণ খর্ব হয়েছে। সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপনকারী একজন সৎ নেত্রী হিসেবে তাঁর যে বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল সব ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ফলে তাঁর কার্যকলাপে সম্পাদিত যাবতীয় ভাল কাজ অন্তসারশূন্য হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। তবে বিবেকানন্দ সড়কের ফ্লাইওভার ধসে পড়ার ভয়াবহ ঘটনাই নবজাগ্রত বাংলার স্থপতি হিসেবে মমতার ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে। মমতারাজের সময় যে বল্গাহীন দুনীতির তা-ব চলছিল ফ্লাইওভার ধসের মধ্য দিয়ে সেটার উপরই এখন সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে। ঘটনাটি এই নির্বাচনে তাঁর যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। নির্মম পরিহাসের ব্যাপার হলো মমতা ফ্লাইওভার (রাজ্যে এখন কয়েক ডজন ফ্লাইওভার নির্মাণাধীন) নির্মাণকে তাঁর সরকারের উন্নয়ন রাজনীতির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। বিরোধীদল ও জনসাধারণ উভয়েই আজ তৃণমূল কংগ্রেসকে প্রকাশ্যে এই প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছে যে, কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে মমতার নিবিড় তত্ত্বাবধানে নির্মিত ফ্লাইওভার যদি নানাবিধ অন্যায় ও অসৎ কার্যকলাপের কারণে ধসে পড়তে পারে তাহলে যেখানে সরকারের কোন তত্ত্বাবধান নেই বা থাকলেও আছে যৎসামান্য সেখানে নির্মিত এ ধরনের অন্যান্য ফ্লাইওভারের অবস্থা কি হতে পারে। অনেকের আশঙ্কা এমন ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি রাজ্যের অন্যান্য স্থানেও ঘটবে। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। এই ফ্লাইওভার নির্মাণের সঙ্গে দুর্নীতির এমন এক নেটওয়ার্ক যুক্ত, এতে এত গুরুতর অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে এবং নিরাপত্তার বিষয়টিও নৈতিক রীতিনীতিকে এমন ইচ্ছাকৃতভাবে পদদলিত করা হয়েছে যে, মমতার ঘটিষ্ঠতম ও সবচেয়ে আস্থাভাজন সহকর্মীরাও পর্যন্ত এখন ফ্লাইওভার নির্মাণ সংক্রান্ত যাবতীয় গোপন তথ্য জনসমক্ষে ফাঁস করে দিচ্ছেন। যেমন, একজন এমপি এবং তাঁর কেবিনেটের এক মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন যে, তাঁরা ফ্লাইওভারের নক্সায় গুরুতর ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা তাঁকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু মমতা তাদের হুঁশিয়ারিকে আমলে নেননি। লোকে এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, মমতা জেনে-শুনেই কালো তালিকাভুক্ত হায়দরাবাদভিত্তিক কোম্পানি আইআরভিসিএলকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন এবং ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কেননা, তাহলে বেশি ব্যয় দেখিয়ে সস্তা শ্রম ও নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের জন্য তাঁর দলের মনোনীত সাব-কন্ট্রাক্টরদের নিতে এই কোম্পানিকে চাপ দিয়ে বাধ্য করা যাবে। এর বিনিময়ে তিনি ফ্লাইওভারের নক্সায় ত্রুটি দেখেও দেখবেন না এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে না পারার জন্য কোম্পানির বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থাও নেবেন না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোম্পানিটি নির্মাণ কাজের শেষ সময়সীমা একটানা ৯ বার পেরিয়ে যাওয়ার পরও তিনি এর বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে রাজি হননি। রেলমন্ত্রী থাকাকালে মমতা কাশ্মীরে একটা রেলওয়ে টানেল তৈরি করার জন্য এই কোম্পানিকে অতি লাভজনক কনট্রাক্ট প্রদান করেছিলেন। অবাক হবার কিছু নেই, ফ্লাইওভার ধসে পড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক ফেনিয়ে উঠেছে তা এখন দুর্ভাগ্যের প্রতীক হয়ে মমতার গলায় প্রবাদকাহিনীর সেই মৃত এলবাট্রসের মতো শোভা পাচ্ছে। তবে নির্বাচনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তাঁর জন্য পরিস্থিতির এত অবনতি হবার কারণ তাঁর কিছু বিশ্বস্ত সহকর্মী দোষ কুণ্ঠিত হয়ে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে বরং ফ্লাইওভার নির্মাণে সংঘটিত অনিয়ম ও দুনীতির পক্ষে অকুণ্ঠচিত্তে সাফাই গাইছেন। তারা রাজ্যের সকল ফ্লাইওভার ও অন্যান্য সরকারী প্রকল্প নির্মাণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন, এর পক্ষে ওকালতি করছেন এবং এর যৌক্তিকতা প্রদর্শন করছেন। তারা এই সিন্ডিকেট রাজের মধ্যে কোন অন্যায় দেখছেন না। কারণ বেকার যুবকরা সিন্ডিকেট গঠন করে চাঁদাবাজির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে। মমতার ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন সল্টলেকের মেয়র সব্যসাচী দত্তের মতো মানুষ যিনি সল্টলেক ও পার্শ্ববর্তী রাজারহাট এলাকায় মমতার পয়েন্টম্যান ও ওই এলাকার ‘এমএলএ’ তিনি সগর্বে বলেছেন যে, সিন্ডিকেটগুলো তার সমুদয় নির্বাচনী ব্যয় বহন করছে, যার পরিমাণ প্রায় ৬০ লাখ রুপি। তৃণমূলের অন্যান্য প্রার্থীর জন্যও তারা একই কাজ করছে। সব্যসাচী বলেন, ‘সিন্ডিকেটের ২৫ হাজার সদস্য আমার দৃঢ় সমর্থক। আমার বিপুল বিজয় সুনিশ্চিত করার জন্য তারা সবকিছুই করবে। এসব সিন্ডিকেট সদস্যের কারণেই তৃণমূল কংগ্রেসপ্রার্থী হিসেবে আমি অজেয়। আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।’ আস্ফালনের সুরে তিনি আরও বলেন, ‘সিন্ডিকেটগুলো এই নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক ভোটের ব্যবধানে আমার বিজয় সুনিশ্চিত করে তুলছে।’ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের মাথা মোটা হয়ে গেছে। তারা ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে ভেদাভেদ করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। মমতা সব্যসাচীকে তার ক্ষতিকর উক্তির জন্য ভর্ৎসনা করার সাহস পাননি এই আশঙ্কায় যে, তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিলে দলের নির্বাচনী সম্ভাবনার আরও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তিনি ভীমরুলের চাকে নাড়া দিতে চান না পাছে তৃণমূল রাজনীতিক, পাড়ার মহল্লার গু-া ও বড় বড় নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার অশুভ আঁতাত আরও প্রকাশ হয়ে পড়বে। সিন্ডিকেট চক্র তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারে ব্যয়িত অর্থের সিংহভাগ যুগিয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা নির্বাচনের দিন ভোটারদের সন্ত্রস্ত করার জন্য তারা লোকবল ও পেশিশক্তি যোগায়, যাতে করে ভোটাররা বাড়িতেই থাকে এবং সেই সুযোগে তারা ভোটকেন্দ্র এবং ইভিএমগুলো দখলে নিয়ে ব্যাপক আকারে ভোট কারচুপিতে লিপ্ত হতে পারে। ক্ষমতাসীন দলে সিন্ডিকেট রাজের প্রসার কত ব্যাপকতা লাভ করেছে তা এই বাস্তবতা থেকে পরিমাপ করা যেতে পারে যে, দলটি এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ক্রোড়পতিকে দাঁড় করিয়েছে। পাঁচ বছর আগে এসব ক্রোড়পতির সম্পদের মোট পরিমাণ কয়েক হাজার রুপিও ছিল না। এবারের নির্বাচনে মমতার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ঝুঁকি এত বেশি যে, দল ঠিক রাখতে এ নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জেতার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি হীন উপায় অবলম্বনেও ইতস্তত করছেন না এবং সেজন্যই সিন্ডিকেট চক্র তার প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে এসেছে। সে কারণেই তিনি এই সিন্ডিকেট রাজের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। কেননা, তিনি জানেন, যে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানব তিনি তৈরি করেছেন তার বিরুদ্ধে কোনরকম সমালোচনা করা হলেই সেই দানব তাঁকে গ্রাস করে ফেলবে। আর সেজন্যই তিনি সিন্ডিকেট রাজের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা সম্পর্কে কোনরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। বরং তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের ভোট প্রদান সংক্রান্ত নির্দেশমালার বিরুদ্ধে তার সমালোচনা কেন্দ্রীভূত করে তুলছেন এবং ভোটারদের এই বলে হুমকি দিচ্ছেন যে, তারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পরিণতি খারাপ হবে। ইতোমধ্যে তাঁর দলীয় গু-ারা যেসব জায়গায় নির্বাচনে বিরোধী দলের বেশ ভাল করার আশা আছে সেখানে বিরোধী নেতৃবৃন্দের উপর হামলা চালিয়েছে এবং তাদের সভাসমাবেশ ও মিছিল বানচাল করে দিচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের বীরভূম জেলা শাখার সম্পাদক অনুব্রত ম-ল নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত করে বসেছেন এবং বলেছেন যে, নির্বাচনের দিন তাঁর জেলায় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ নয়, বরং তাঁরই নির্দেশ চলবে। এমনকি তিনি ভোটের দুদিন আগে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিরুদ্ধে তাঁর এমন আয়ুর্বেদিক দাবাই প্রয়োগের হুমকি দিয়েছেন যে, তার ফলে বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টরা নিজ নিজ ঘরেই আটকা থাকবেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় অনুব্রতের এই দাবাইয়ের বদৌলতে তৃণমূল কংগ্রেস জেলায় লোকসভার যতগুলো আসন ছিল তার প্রায় সবই বাগিয়ে নিতে পেরেছিল। ভোটের দিন ব্যবহারের জন্য ইতোমধ্যে জেলার তৃণমূল গু-ারা বিপুল পরিমাণ দেশী বোমা এবং অস্ত্র ও গুলিগোলা মজুত করতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গের ইসির সাবেক বিশেষ নির্বাচন পর্যবেক্ষক কে জে রাওয়ের পর্যবেক্ষণে এটাই বেরিয়ে এসেছে। সম্প্রতি রাও নিজে বীরভূম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা দুটি সফর করে বিষয়টি প্রধান নির্বাচন কমিশনার মি. জায়েদীকে টেলিফোনে জানিয়েছেন। তবে তাতে কাজ হয়নি। কে জে রাও আশঙ্কা করছেন যে, দক্ষিণবঙ্গের ছয়টি জেলায় (যেখানে আসন সংখ্যা ১০০-এরও বেশি এবং যেখানে তৃণমূল কংগ্রেস সাংগঠনিক দিক দিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী) নির্বাচনের আগে ইসি যদি সকলের জন্য সমান সুবিধার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে না পারে তাহলে ভোটের দিন শাসকদল অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। ইতোমধ্যে মমতার তৃণমূল সরকার নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও তদারক করার জন্য ইসির পাঠানো কয়েকডজন নির্বাচন পর্যবেক্ষককে ‘ম্যানেজ’ করে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। এখানে আগের নির্বাচনগুলোতেও ভোট পর্যবেক্ষকরা ভোটের দিন অদৃশ্য হয়ে যায় এবং টেলিফোনে যোগাযোগ করেও তাদের পাওয়া যায়নি। নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ে অতি স্পর্শকাতর মাওবাদী এলাকায় কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ফোর্সও রহস্যজনকভাবে লাপাত্তা ছিল। তাদের স্থানীয় বাজারগুলোতে ঘুরে বেড়িয়ে বাজার করতে কিংবা পার্কের ও ময়দানের শেডগুলোতে অলসভাবে বসে থাকতে অথবা স্থানীয় পুলিশকে গাইড হিসেবে নিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। যেসব এলাকার পোলিং বুথ থেকে ভোটের শেষ মুহূর্তে ভোটারদের সহসা জোয়ার সৃষ্টি হবার খবর এসেছিল সেখানকার অনেক পোলিং বুথে প্রহরার দায়িত্বে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল না, ছিল রাজ্য পুলিশ। প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনের সবচেয়ে দুঃখজনক দিকটা ছিল রাজ্যের প্রধান নির্বাচন অফিসার সুনীল গুপ্তের ভোটের দিনের আচরণ। এতে এই নির্বাচনে তাঁর নিরপেক্ষ ভূমিকা সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। কারণ প্রথম পর্যায়ের ভোটাভুটি শেষ হবার ৪৮ ঘণ্টা পর প্রধান নির্বাচন অফিসারের কার্যালয় থেকে ঘোষণা করা হয় যে, ৪ এপ্রিল বিধান সভার যে ১৮টি নির্বাচনী এলাকায় ভোটাভুটি হয়েছে সেখানে গড় ভোটদাতা বেড়েছে সাড়ে তিন শতাংশ। গোপীবল্লভপুর, মেদিনীপুর ও তালদাংগ্রাম ভোটদাতার সংখ্যা অবিশ্বাস্যহারে বেড়েছেÑ ৫ থেকে ৮ শতাংশ। এসব আসনের অনেক পোলিং বুথে ৯৯ শতাংশ, এমনকি ১০০ শতাংশ ভোট পড়ার খবরও পাওয়া যায় যা অতিমাত্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন রাজ্যের সাবেক নির্বাচন কমিশনার মিসেস মীরা গুপ্তা ও মি. উপাধ্যায়। একটি দলের পক্ষে ১ থেকে ২ শতাংশ বেশি ভোট পড়লেই তা প্রতিপক্ষদের সর্বনাশ ঘটিয়ে দিতে পারে। সিন্ডিকেট সম্পর্কে সব্যসাচী দত্ত যেসব বক্তব্য রেখেছিলেন তাতে সকল নির্বাচনীবিধি, রীতিনীতি এবং নৈতিকতা লঙ্ঘিত হয়েছে। অথচ তাঁর বক্তব্য আমলে নিয়ে তদনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ইসির ব্যর্থতা থেকে অনেক ভোটারের মনে প্রশ্ন জেগেছে যে, ভয়ভীতি ও আনুকূল্যের উর্ধে থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে অঙ্গীকার মি. জায়েদী করেছিলেন সেই অঙ্গীকার রক্ষায় তিনি আন্তরিক কিনা। রাজ্যের ভোটারদের কাছে তার দেয়া অঙ্গীকারের প্রকৃত পরীক্ষা আগামী দু’সপ্তাহে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে পরিচালিত হবে। কারণ এ সময় তিনটি ভোটপর্বের মধ্য দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের ৬টি জেলায় শতাধিক আসনের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণে ইসি বিপুল প্রতিকূলতার সম্মুখীন। কারণ এসব জেলার বেশিরভাগ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যারা রিটার্নিং অফিসার হিসেবেও কাজ করছেন তাদের ব্যক্তিগত আনুগত্য মমতার প্রতি। বিরোধী দলগুলোর তুলনায় শাসক দলটিকে সুবিধাজনক অবস্থায় রাখতে ইতোমধ্যেই তারা প্রকাশ্যে ও গোপনে নানাভাবে তৃণমূলকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু মমতার দুর্ভাগ্য, এতকিছুতেও তাঁর প্রবোধ পাওয়ার কারণ ঘটেনি। তিনি আগে থেকেই জানেন যে, উত্তরবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসবিরোধী এক জোয়ার বয়ে চলেছে। তাঁর স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে ভাল-মন্দ যেভাবে হোক, ছলে-বলে-কৌশলে হোকÑ এই আন্দোলনকে দক্ষিণ দিকে যেতে না দেয়া। এক্ষেত্রে তিনি কতটা সফল হবেন তার ওপর নির্ভর করবে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল। লেখক : ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক
×