ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমানতের সুদের হার হ্রাস এবং পুঁজিবাজার মন্দায় বিনিয়োগ বাড়ছে

৩৩ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১৪ এপ্রিল ২০১৬

৩৩ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি

রহিম শেখ ॥ সুদহার কমানোর পরও সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৩৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। আলোচ্য আট মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। যদিও অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। এদিকে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ধার করেই প্রয়োজনীয় খরচ মেটাচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে অব্যাহতভাবে আমানতের সুদের হার হ্রাস এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে একটু বেশি লাভের আশায় সবাই ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শুরুতেই সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৩৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। গেল আট মাসে নিট ১৯ হাজার ৮৯০ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে সরকার। যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। এ অবস্থায় অর্থবছরের বাকি চার মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি দ্বিগুণ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। কিন্তু বছর শেষে তা ২৮ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকায় ঠেকে। জানা গেছে, প্রতিদিন যে টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় তা থেকে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকেই নিট বিক্রি বলে হিসাব করা হয়। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। ওই মাসে সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার ১০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। জানুয়ারি মাসে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে সুদ-আসল পরিশোধের পর নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৮৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আর জানুয়ারিতে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল আরও একটু বেশি ৩ হাজার ২৯৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এক হাজার ৯৭৬ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। আগস্টে তা বেড়ে ২ হাজার ৬৯১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নবেম্বরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৫৪ কোটি, ২ হাজার ৩৫৩ কোটি এবং ২ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। অবশ্য ডিসেম্বরে তা কমে এক হাজার ৯৮০ কোটি টাকায় নেমে আসে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সাধারণ মানুষের বিনিয়োগের প্রায় সব পথই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আমানত জমা হচ্ছে। ফলে তারা বাধ্য হয়ে আমানতের সুদহার কমিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ মানেই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ। এ অবস্থায় কোন ধরনের ঝুঁকি না থাকায় বর্তমানে সঞ্চয়পত্রে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছেন গ্রাহকরা। সুদের হার কমানোর পরও এ খাতে বিনিয়োগ কমেনি এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকে সাধারণ মানুষ এখনও নিরাপদ মনে করছে। কেননা দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক বলা যাচ্ছে না। আবার শেয়ার বাজারের মন্দাভাবও কাটছে না। তাই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পরও বিনিয়োগ কমেনি। সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ঋণের ভার কমাতে গত বছরের ২৩ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার প্রায় ২ শতাংশ করে কমায় সরকার। তবে ওই সময়ের আগে যারা সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন, তারা আগের সুদেই মুনাফা পাচ্ছেন। ২৩ মের আগ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদ পরিবার ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনলে ১৩ দশমিক ৪৫ ও ১৩ দশমিক ২৬ শতাংশ হারে সুদ পাওয়া যেত। সুদের হার কমানোর পর এখন কেউ পাঁচ বছর মেয়াদী পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কিনলে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ হারে সুদ পাবেন। অর্থাৎ মে মাসের আগ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদী এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনলে প্রতি মাসে এক হাজার ৭০ টাকা মুনাফা পেতেন একজন গ্রাহক। সুদের হার কমায় এখন পাচ্ছেন ৯১২ টাকা। আর পাঁচ বছর মেয়াদী পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে। ৩ বছর মেয়াদী ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে সুদহার ঠিক করা হয়েছে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে তিন বছর মেয়াদী ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে সুদহার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ করা হয়েছে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গেল আট মাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র। এদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে বলে ব্যাংক থেকে সরকারকে একেবারেই ঋণ করতে হচ্ছে না। অর্থবছরের আট মাস শেষে ব্যাংকে সরকারের ঋণ ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে। ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখ পর্যন্ত ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের মোট পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। গত বছরের জুনের শেষে এর পরিমাণ ছিল এক লাখ পাঁচ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ আট মাসে ঋণ কমেছে ১২ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যেও অর্থবছর শেষে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ বর্তমানের মতো ঋণাত্মক ধারায় থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
×