রহিম শেখ ॥ আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। দিনটিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বরণ করবেন হালখাতা উৎসবের মাধ্যমে। এজন্য প্রস্তুতিও শতভাগ। ঐতিহ্যগতভাবেই পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্যের এই উৎসবটি। বিশেষত বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে যুক্ত হয়েছে কম্পিউটার ও হিসাব-নিকাশের সফটওয়্যার। আর এসবের ক্রমবিস্তারের মধ্য দিয়ে বিদায় নিতে শুরু করেছে ক্রেতা-বিক্রেতার বন্ধনসূত্র দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত লাল কাপড়ে মোড়ানো ‘হালখাতা’। তারপরও পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজারের সোনার দোকান, শ্যামবাজারের বিভিন্ন আড়ত, ইসলামপুরের কাপড়ের দোকান, বাবুবাজার এলাকার চালের আড়ত ও নবাবপুর এলাকায় হালখাতার আয়োজন বেশি হয়। চৈত্র মাসের শুরু থেকেই পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাদের নিয়মিত খুচরা বিক্রেতাদের নিমন্ত্রণ জানানোর কাজ শুরু করেন। এজন্য নিমন্ত্রণপত্রও ছাপানো হয়েছে।
জানা গেছে, পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেন ঐতিহ্যগতভাবে। এই উৎসবকে ব্যবসায়ীরা বরণ করেন ‘হালখাতা’র মধ্য দিয়ে। খুচরা ও পাইকারি ক্রেতাদের মিষ্টি অপ্যায়নের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখকে স্বাগত জানাবেন ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে দোকানের সামনে টানানো হয়েছে শুভ হালখাতার ব্যানার। দোকানও সজ্জিত করা হয়েছে নতুন বিন্যাসে। গ্রামাঞ্চলে হালখাতার প্রথা পালিত হয় আরও সাড়ম্বরে। চৈত্র মাসের শুরু থেকেই ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের নিমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেছেন। কেউ ছাপানো নিমন্ত্রণপত্রে, কেউ মোবাইল ফোনে। অধিকাংশ ব্যবসায়ী জানালেন, এটা এখন নিয়ম রক্ষার জন্যই করা। জাঁকজমক আর উদ্দীপনা অনেকটাই কমে গেছে নানা বাস্তবতায়। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে হালখাতার রেওয়াজও। কোন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ‘ফাইলের’ প্রচলন হয়েছে। প্রযুক্তি হাতে লেখা খাতা থেকে অনেককে নিষ্কৃতি দিয়েছে। বিশেষত বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে যুক্ত হয়েছে কম্পিউটার ও হিসাব-নিকাশের সফটওয়্যার। আর এসবের ক্রমবিস্তারের মধ্য দিয়ে বিদায় নিতে শুরু করেছে ক্রেতা-বিক্রেতার বন্ধনসূত্র দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত লাল কাপড়ে মোড়ানো হালখাতা। আগে ব্যবসায়ীরা মুখের কথায় বিশ্বাস করে লাখ লাখ টাকা বাকি দিতেন। এ খাতাতেই তা লিখে রাখা হতো। এসবের বেশিরভাগই উসুল হতো হালখাতার দিনে। তবে এখন নানা ঘাটে পোড় খেতে খেতে ব্যবসায়ীদের অনেকেই তাদের এ ধরনের লেনদেন করে থাকেন ব্যাংকের মাধ্যমে।
বুধবার সরেজমিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মতিঝিলের সোনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঘুরে জানা গেছে, ব্যবসাকেন্দ্রে চলছে ধোয়ামোছার কাজ। কাগজ, বোর্ড, রংতুলিসহ বিভিন্নভাবে সাজানো হয়েছে দোকানপাট। নারিন্দার বাসিন্দা মাছুদ জাবেদ জানান, মতিঝিলের আমিন জুয়েলার্স আমাদের প্রতি পহেলা বৈশাখে দাওয়াত দেয়। আমরাও সেখানে যাই। কারণ আমরা এক সময় তাদের দোকান থেকে সোনা নিয়েছিলাম। আর সেজন্য তারা আমাদের বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দেয়। মিষ্টিমুখ করায়। হালখাতার বিষয় নিয়ে কথা হয় পুরান ঢাকার প্রবীণ ব্যবসায়ী নির্মল দত্তের সঙ্গে। ব্যবসায়ী নির্মল দত্ত জনকণ্ঠকে জানান, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আগের মতো আর হালখাতা আয়োজন হয় না। স্বল্প আয়োজনে ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য একটি নতুন খাতা ব্যবহার শুরু করি। তিনি আরও জানান, ক্রেতাদের মধ্যেও আর আগের মতো এ আয়োজনে সাড়া পাওয়া যায় না। তাদের আমন্ত্রণ জানানো হলে তারা বলেন, ব্যস্ততার জন্য আসতে পাচ্ছি না। যদি দোকানের পাওনা দেয়া জরুরী হয় তাহলে মোবাইলে বিকাশ করে দেয়ার কথা বলেন তারা। ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী মোঃ আমজাদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের এখানে এখন আর বড় পরিসরে হালখাতার আয়োজন করা হয় না। তারপরও বছরের প্রথম দিন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা হালখাতা করেন। মুসলমান ব্যবসায়ীদের থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীরা হালখাতা উদযাপন বেশি করেন।
শাঁখারিবাজারে মুক্তা জুয়েলার্সের স্বত্ব¡াধিকারী বিনয় সরকার বলেন, পহেলা বৈশাখ আসার সপ্তাহখানেক আগে থেকেই ধুয়েমুছে ফুল দিয়ে দোকান সাজানোর কাজ শুরু হয়। নববর্ষের দিন গণেশ পূজার মাধ্যমে দেবতাকে অঞ্জলি দেয়া হয়। আগে থেকেই মিষ্টির অর্ডার দিয়ে রাখি। ওইদিন যেসব ক্রেতা স্বর্ণ-অলঙ্কার কেনেন তাদের জন্য ব্যাগ, নাকফুল, ক্যালেন্ডারসহ বিভিন্ন উপহার রাখা হয়। তবে আগের মতো আর হালখাতা জমে না। তাও করতে হয়। তবে কিছুটা ভিন্নতা দেখা গেছে পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে। সেখানকার আদা, পেঁয়াজ ও রসুন আড়তদাররা জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে হালখাতা করবেন। তবে তারা দাওয়াতের কাজ সারবেন এই বৈশাখেই। জ্যৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত একেক দোকানে একেক দিন হালখাতা হবে। অবশ্য সেখানকার পাইকারি পান দোকানদাররা চৈত্রসংক্রান্তিতে হালখাতা পালন করেবেন। প্রসঙ্গত, মূলত সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল থেকেই ‘হালখাতা’ উদযাপন হয়ে আসছে পহেলা বৈশাখের আচারালঙ্কার হিসেবে। হালখাতা মানে সারা বছরের বেচাকেনার হিসাব-নিকাশ, নগদ বাকির তালাশ আর বাকির অঙ্ক কমিয়ে আনার প্রয়াস। যদিও নতুন বছরের শুরু, শুরু নতুন একটি লাল খাতা খোলার, হিসাব-নিকাশ হালনাগাদ করার- কিন্তু দোকানগুলোতে এখন আর আগের মতো এ চিত্রের দেখা মেলে না।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: