ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কমিয়েছে প্রযুুক্তির ব্যবহার, মিশন কার্যক্রম চালাচ্ছে সাঙ্কেতিক ভাষায়

আনসারুল্লাহ বাংলাটিম নতুন কৌশলে অপতৎপরতা চালাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ১৪ এপ্রিল ২০১৬

আনসারুল্লাহ বাংলাটিম নতুন কৌশলে অপতৎপরতা চালাচ্ছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জেএমবির মতো পুরনো কায়দায় তৎপরতা চালাচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলাটিম। প্রযুক্তি ব্যবহার না করে সরাসরি দেখা সাক্ষাতের মাধ্যমে জঙ্গী সংগঠনটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। মোবাইল ফোনে আলাপ আলোচনা করছে সাংকেতিক ভাষায়। জঙ্গী সংগঠনটির সদস্যরা আগের মতো গ্রেফতার হওয়ার পর আর অবলীলায় সব কিছু স্বীকার করছে না। আগে কাউকে হত্যার আগে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে পূর্বাভাস দেয়া হতো। এখন আর সেটিও করছে না। এসবই তাদের নতুন কৌশল। প্রযুক্তি ব্যবহার না করায় এবং সাংকেতিক ভাষায় আলাপ-আলোচনা হওয়ায় সম্প্রতি বেশ কয়েকজন লেখক ও প্রকাশক হত্যা এবং হত্যাচেষ্টার ঘটনার কিনারা হয়নি। পুরনো কৌশল অবলম্বন করে নাজিমউদ্দিন সামাদকে হত্যা করা হতে পারে বলে তদন্তকারীদের ধারণা। ব্লগার ও প্রকাশক হত্যার তদন্ত সংস্থা সূত্রে আরও জানা গেছে, গোড়ার দিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেখা সাক্ষাত ও চিঠিপত্রের মাধ্যমে নানা পরিকল্পনার তথ্য আদান প্রদান করত নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি। জঙ্গী সংগঠনটির এমন কৌশল এখনও রয়েছে। বিগত বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে সরকারের মদদ থাকায় জঙ্গী সংগঠনটি ব্যাপকহারে প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসে। সর্বশেষ নিষিদ্ধ হওয়ার পরও তাদের অনেকেই প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল। যারা প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের অনেকেই পরবর্তীতে গ্রেফতার হয়েছে। এরপর থেকেই জঙ্গী সংগঠনটির কারাবন্দী শীর্ষ নেতারা সদস্যদের প্রযুক্তি ব্যবহার কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন। প্রযুক্তির ব্যবহার করলেও সাংকেতিক ভাষা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী যারা প্রযুক্তির ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে, তাদের অনেকেই এখনও গ্রেফতারের বাইরে রয়েছে। শুধু জেএমবি নয়, দীর্ঘ সময় এমন কৌশলের সঙ্গে যুক্ত ছিল নিষিদ্ধ আরেক জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি)। এখনও হুজির তৎপরতা রয়েছে। তবে আগের মতো ব্যাপক নয়। এখন হুজির অধিকাংশ সদস্যই অন্যান্য জঙ্গী সংগঠন ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে গঠিত একটি বিশেষ ইসলামী দলের সঙ্গে ভিড়ে গেছে। সূত্র বলছে, জেএমবি ও নিষিদ্ধ আরেক জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের অনেক সদস্য বর্তমানে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে রয়েছে। তারাই আনসারুল্লাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এক সময় প্রযুক্তির সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত ছিল। কিন্তু ব্লগার প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যার পর কৌশল পাল্টায় জঙ্গী সংগঠনটি। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক প্রকৌশলী রাজীবকে রাত সাড়ে আটটায় রাজধানীর পলœবী থানাধীন পলাশনগরের ৫৬/৩ নম্বর নিজ বাড়ির সামনেই ছুরিকাঘাতে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত আটটার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে রাজীবের জানাজা আদায়কারী ইমামকে হত্যার হুমকিদাতা ছাত্রশিবিরের সাবেক কর্মী শফিউর রহমান ফারাবীকে গ্রেফতার করে হাটহাজারী থানা পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ফারাবী প্রথমে ছাত্রশিবির ও পরে হিযবুত তাহরীরে যোগ দিয়েছিল। ২০১০ সালে ফারাবী হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় গ্রেফতার হয়েছিল। ফারাবীর তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ১ মার্চ রাজীব হত্যার দায়ে রাজধানীর বনানীর বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ছাত্র ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক (২৩), এহসান রেজা ওরফে রুম্মন (২৩), নাইম শিকদার ওরফে ইরাদ (১৯) ও নাফিস ইমতিয়াজ (২২) ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতরা অবলীলায় রাজীব হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। ওই বছরের ৯ এপ্রিল বেলা সোয়া এগারোটার দিকে বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলের ২২৪ নম্বর কক্ষের যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের আবাসিক ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী আরিফ রায়হান দীপকে ডেকে নিয়ে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে আহত করে বুয়েটেরই আরেক ছাত্র মেজবাহ উদ্দিন। পরবর্তীতে দীপ স্কয়ার হাসপাতালে মারা যায়। এ ঘটনায় ওই বছরের ১৭ এপ্রিল বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মেজবাহ উদ্দিন মেজবাহ গ্রেফতার হয়ে আদালতে হত্যার দায় অবলীলায় স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়। মেজবাহ আদালতকে রাজীবের হত্যাকারীদের মতো ইমানী দায়িত্ব পালন করতেই দীপকে হত্যা করেছে বলে জানায়। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ডিবি সূত্র জানায়, পর পর এমন দুটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম সাংগঠনিকভাবে তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। এরপর যত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য গ্রেফতার হয়েছে তারা এর আগে গ্রেফতার হওয়াদের মতো অবলীলায় সত্য প্রকাশ করেনি। এমনকি তাদের নাম ঠিকানা পর্যন্ত ভুল বলার রেকর্ড আছে। দলের অন্যান্য সদস্যকে রক্ষা করা এবং সংগঠনটির ভেতরের খবর প্রকাশ যাতে না হয় এজন্য আনসারুল্লাহ কৌশল পাল্টায়। তারা আগের মতো প্রযুক্তিরও ব্যবহার করে না। গ্রেফতার এড়িয়ে সংগঠনের তৎপরতা টিকিয়ে রাখতে জঙ্গী সংগঠনটি সিøপার সেল তৈরি করে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মগজ ধোলাই করার পর ৪ থেকে ৫ জন করে একেকটি সিøপার সেল গঠন করে। সেলের প্রত্যেকের সাংকেতিক নাম দেয়া হয়। কেউ কারও কাছে ব্যক্তিগত বিষয়াদি জানতে চাইতে পারবে না বলে অঙ্গীকার করায়। মোবাইল ফোনে আলাপ-আলোচনা বা কোন পরিকল্পনার তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সাংকেতিক ভাষার ব্যবহার শুরু করে। তদন্ত সংস্থার একাধিক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করায় এবং প্রযুক্তির ব্যবহার কম করায় নানা ঝামেলা হচ্ছে। নাজিমউদ্দিন সামাদ হত্যার বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জনকণ্ঠকে বলেন, হত্যাকা-ের ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি। তদন্তে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয়নি। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে। হত্যাকারীদের গ্রেফতারে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নানামুখী তৎপরতা চলছে।
×