ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাসযোগ্য নগরের সন্ধানে

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ১৪ এপ্রিল ২০১৬

বাসযোগ্য নগরের সন্ধানে

সেই কবেকার আবেদন, এখনও শোনা যায়, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লহ হে নগর।’ অরণ্যের আবাহনে, প্রকৃতির ছায়াবন্ধনে মানুষের বেড়ে ওঠা, বসবাসের দিন ফুরিয়েছে। অরণ্য আজ উজাড়ের পথে। আর নগরÑ সে তো কোলাহলে পূর্ণ, কংক্রিটের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা প্রাণহীন নিসর্গ। নগরজীবন মানুষের জন্য পরম আস্বাদ হয়ে আসে, যদি তাতে থাকা প্রকৃতির আবরণ। কিন্তু নগরজীবনে প্রকৃতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। নগরবাসীর বসবাসের আয়োজনগুলোও নয় পূর্ণতার ছোঁয়া লাগানো বরং ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’ বলে আবাসিক ভবনজুড়ে বাণিজ্য ভবনের প্রসার ঘটানো চলছে। রাজধানী ঢাকা তার আবাসিক চরিত্র হারিয়ে পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক নগরীতে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলোর বিধান না রেখেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে ঢাকা এবং তার নগরায়ন হচ্ছে জঞ্জালপূর্ণতায়। তিলোত্তমা নগরীর স্বপ্ন যারা দেখেন বা দেখান, তারা আসলেই স্বপ্নরাজ্যে বসবাস করেন। বাস্তবতা হচ্ছে, বসবাসের অযোগ্য হিসেবে বিশ্বের মধ্যে প্রথম সারির তালিকায় রয়েছে একদা পরিচ্ছন্ন আর ঐতিহ্য সম্পদ ঢাকা নগরী। চার শ’ বছর আগে প্রাদেশিক রাজধানী শহর হিসেবে খ্যাত ঢাকা এখন শিল্প, বাণিজ্য, প্রশাসনিক ও শিক্ষার শহর হিসেবেও খ্যাত। চার শ’ বছর আগেও ছিল রাজধানী। তখন থেকেই নগরীর গোড়াপত্তন ও বিকাশকাল শুরু। নগরীর পুরনো অংশ তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেনি। ঘিঞ্জি অবস্থা আর অধিক লোকসংখ্যার বসবাসের কারণে পুরনো ঢাকা আধুনিকতার স্পর্শে রঞ্জিত হয়ে উঠতে পারছে না। ১৬১০ সালে মুঘল আমলের সুবাহ বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকা মর্যাদা পায়। গত ৪শ’ বছর ধরে শহরটির বিস্তৃত ঘটেছে অনেক। বুড়িগঙ্গার তীর ধরে গড়ে ওঠা শহরটির স্ফীতি এখনও অনেক দূর গড়িয়েছে। একাত্তর সালে বাংলাদেশের রাজধানীতে পরিণত ঢাকায় আজ প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। রাস্তাঘাটে মানুষ আর মানুষ। চোখ যায় যত দূর, দেখা যায় সবখানেই হাটবাজার, এমনকি ফুটপাথ ও প্রধান সড়কজুড়ে আর বিপণি বিতানে সয়লাব। আবাসিক ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কারখানা পর্যন্ত চলছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, কোচিং সেন্টার, দোকানপাটের অগুনতি হারে প্রতিদিনই বাড়ছে রাজধানীতে। বাসা-বাড়িতে বিষাক্ত রাসায়নিক গুদাম, চামড়ার কারখানা, বর্জ্যরে ডিপো, হোটেল, রেস্তরাঁ অলিগলিজুড়ে। যেখানে সেখানে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন। তদুপরি যানবাহন সঙ্কট, যানজট, খানা-খন্দেপূর্ণ রাস্তা, শব্দদূষণ, বায়দূষণে পূর্ণ ঢাকা। নগরীতে গড়ে ওঠা অবকাঠামোর ৭৩ শতাংশ পুরোপুরি অপরিকল্পিত। ৬ ভাগেরও কম রাস্তাঘাট অথচ প্রয়োজন মোট ভূমির ২৫ ভাগ সড়ক। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও রাজধানী উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাহীন অবস্থা ঢাকাকে করে তুলেছে বসবাসের অযোগ্য। সড়ক দখল করে ভবন নির্মাণ হয় যে শহরে, সেখানে কোন কর্তৃপক্ষ রয়েছে কি-না, সে নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে। ঢাকাকে ঢেলে সাজানোর মতো অবস্থাটা আর নেই। ভুলে আর অবহেলায় ভরা ঢাকা ক্রমশ নরকের দিকে ধাবিত হচ্ছে যেন। সবচে’ বিস্ময়কর যে, আবাসিক ভবনের অনুমতি নিয়ে ভবন নির্মাণ করে বাণিজিকীকরণ করা হয়েছে। এক সময়ের আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত এলাকাগুলো বাণিজ্যিক এলাকায় পরিবর্তিত হয়েছে। মোদ্দাকথা, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠায় এবং শহরের উন্নয়নে কার্যকর কোন নীতি না থাকায় ঢাকা শহরে নিত্যদিনের ভোগান্তি বাড়ছে। অনেক দেরিতে হলেও ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক ভবন সরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, ঢাকাকে বাসযোগ্য করার প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠিত সব বাণিজ্যিক স্থাপনা সরিয়ে নেয়া হবে। নগরীর যানজট নিরসনে ফুটপাথসহ সরকারী জমির অবৈধ দখল মুক্তির পাশাপাশি আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ভবনের অবস্থানকে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করেছে মন্ত্রিপরিষদ। তবে এ সময়ের মধ্যে লক্ষ্যার্জন করতে হলে নগরবাসীর প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং কার্যকর নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী। বাণিজ্যিক এলাকা ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোর নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থাসহ বিল্ডিং কোড মেনে চলার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া জরুরী। অর্ধশতাধিক বছরে পরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা বিশ্বখ্যাত নগরায়ন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এটুকু উদ্যোগই নয় যথেষ্ট। কেবল আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক ভবন সরিয়ে তিলোত্তমা নয়, স্বাভাবিক বসবাসের উপযোগী করা সহজসাধ্য নয়। অবশ্য বাসযোগ্য, নগরী গড়ে তুলতে এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জনগণের জন্য বাস উপযোগী নগর গড়ে তোলার কাজটি যথাযথভাবে নিষ্পন্ন হোকÑ এটাই প্রত্যাশা।
×