ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

পরিশ্রমী ফুটবলার আবু ইউসুফ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১৩ এপ্রিল ২০১৬

পরিশ্রমী ফুটবলার আবু ইউসুফ

শৃঙ্খলার প্রতি যার ছিল অগাধ সম্মান, যিনি ছিলেন ফুটবল মাঠে অবিচল। নিজের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। পরিশ্রম করতে যিনি কুণ্ঠিত বোধ করতেন না। নিজের পজিশন রক্ষণভাগকে ঠিক রেখে কখনও উপরে কখনও বা নিচে নেমে খেলেছেন অবলীলায়। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ট্যাকল করেই বল নিয়ে উপরে উঠে যেতে যার জুড়ি মেলা ভার ছিল। যিনি একটানা মাঠে খেলেছেন ঠিক একই ঢংয়ে। ক্লান্তি কখনই যাকে পরাজিত করতে পারেনি। মাঠে যিনি ছিলেন নিয়মানুবর্তী এবং দারুণ মনঃসংযোগী, তিনি বাংলাদেশের ফুটবলের রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরী মোহাম্মাদ আবু ইউসুফ। ঢাকার দর্শকরা তাকে চিনতেন বড় ইউসুফ নামে। ১৯৫৭ সালের ২৯ জুন ঢাকার বকশী বাজারে জন্ম ইউসুফের। বকশী বাজারের আলিয়া মাদ্রাসার মাঠেই ফুটবলের হাতে খড়ি। প্রতিভার বিকাশ ঘটে নবকুমার স্কুলের হয়ে আন্তঃস্কুল ফুটবলে অংশগ্রহণ করে। তার খেলা দিয়ে সেখানেই সবাইকে মাত করে দেন তিনি। তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে পাড়ার বড় ভাই খোরশেদ তাকে তৃতীয় বিভাগের দল স্টার অব বাংলাদেশ ক্লাবে। কিন্তু বয়সে বেশি ছোট হওয়াই তারা তাকে নেয়নি। পরে মাহুতটুলিতে নিয়ে গেলে তারাও তাকে একই অজুহাতে ফিরিয়ে দেন। পরে কোচ বজলুর রহমানের কামাল স্পোর্টিং ক্লাবে দেয়া হয়। কামাল স্পোর্টিয়ের হয়ে অসমাপ্ত দ্বিতীয় বিভাগের খেলাগুলো খেলেন। বজলুর রহমানের নিপুণ প্রশিক্ষণে ইউসুফ খুঁজে পায় তার নির্ধারিত ঠিকানা। আর থেমে থাকতে হয়নি। ফুটবলের সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর স্মৃতি বলেন ইউসুফ। তিনি বলেন, সে এক মজার ঘটনা। ছোট বেলায় আমার আব্বা ঢাকা ফুটবলের নিয়মিত দর্শক ছিলেন। কে কিভাবে গোল করলো, কিভাবে দল জিতল আব্বা এগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। বড় খেলাগুলোতে আব্বার জন্য টিকেট কাটতে আমি স্টেডিয়ামে আসতাম। সেই থেকেই আস্তে আস্তে ফুটবলের প্রতি একটা মোহ জন্মে যায়। তারপর স্কুল ফুটবল থেকেই বলতে পারেন ফুটবলের হাতে খড়ি। ফায়ার সার্ভিসের হয়ে ১৯৭৩ সালেই প্রথম বিভাগ ফুটবলের যাত্রা শুরু করেন মোহাম্মাদ ইউসুফ। পরের বছর যোগ দেন রহমতগঞ্জে এবং সেখানে খেলেন টানা ছয় বছর। ১৯৮০ সালে যোগ দেন মোহামেডানে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এই তিন বছর খেলেন সেখানে দাপটের সঙ্গে। এর মধ্যে ৮০ এবং ৮২ সালে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করে। ১৯৮৩ সালে ইউসুফ যোগ দেন ঢাকা আবাহনীতে। সেখানে খেলেন একটানা ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ৮৩, ৮৪ এবং ৮৫ সালে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নের গর্বিত দলের সদস্য ছিলেন মোহাম্মাদ আবু ইউসুফ। ৮৬ সালে আবাহনীর আরম ব্যান্ড পরেন তিনি। সেবার আবাহনী ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন এবং লিগ রানার্সআপ হবার গৌরব অর্জন করে। ১৯৮২ সালে ভারতের দুর্গাপুরে অনুষ্ঠিত আশিশ জাব্বার টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম কোন দলের এ সাফল্যের সদস্য ছিলেন তিনি। তাছাড়া ১৯৯০ সালে ভারতের নাগজি ট্রফিতে তার নেতৃত্বে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়। দীর্ঘ খেলোয়াড়ি জীবনে ইউসুফ বহু জয় পরাজয়ের সাক্ষী। তার ছিল দারুণ স্টেমিনা এবং আত্মবিশ্বাস। বিপক্ষ খেলোয়াড়কে নজরবন্দী করে রাখতে তিনি ছিলেন সর্বেসর্বা। ঢাকার মাঠে অনেক বছর খেলেছেন, কোন খেলাটির কথা মনে হলে আজও প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এমন অনেক খেলাই আছে। ১৯৮৬ সালে ফেডারেশন কাপের সেমিতে মোহামেডানের বিরুদ্ধে জয়ের ম্যাচটি আজও আমার মনে পড়ে। সে খেলায় এক পর্যায়ে মোহামেডান ৩-১ গোলে এগিয়ে ছিল পরে ৪-৪ গোলে ড্র হয়। টাইব্রেকারে আমরা জয়লাভ করে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করি। সে ম্যাচে প্রেমলালের হ্যাটট্রিক ছিল ম্যাচের আরেক বাড়তি পাওনা। যে ম্যাচটি আমায় আজও কাঁদায় সেটা ১৯৮৫ সালের ঢাকায় সাফ গেমস ফাইনাল। ভারতের সাথে নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে সমতা হলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। টাইব্রেকারে আমার শর্ট বাইরে যায় আর শেখ মহাম্মদ আসলামের শর্ট বারে লেগে প্রতিহত হয় ফলে আমরা চ্যাম্পিয়নশিপ হারাই। সে কষ্ট আজও ভুলতে পারি না। ইউসুফের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার হয় ১৯৭৫ সাল থেকে। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২১তম মারদেকা ফুটবলে প্রথম খেলেন। এরপর ১৯৭৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমস, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ দ্বিতীয় গ্রুপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, সিউলের নবম প্রেসিডেন্ট কাপ, কুয়েতের সপ্তম এশিয়ান কাপ, ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দল, ১৯৮২ সালে করাচিতে কায়েদে আজম স্মৃতি ফুটবল, ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলে, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে, ১৯৮৬ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলে এবং ১৯৮৭ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ নীল দলের হয়ে খেলেন। ফর্মে থাকা সত্ত্বেও ১৯৮৩ সালে তিনি জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন। ১৯৭৯ সালে সিউলে নবম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ দলের সহকারী অধিনায়ক এবং ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দলের অধিনায়ক ছিলেন। আত্মপ্রত্যয়ী এই ফুটবলার অসংখ্য সেরা ম্যাচ উপহার দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালে রহমতগঞ্জের হয়ে আসামের গৌহাটিতে বরদুলই ট্রফিতে কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে এবং ১৯৮৫ সালে ফেডারেশন কাপ ফুটবল এবং ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে তিনি প্রশংসনীয় ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। খেলোয়াড়ি জীবনে কোন খেলোয়াড়কে সমীহ করতেন? ইউসুফ বলেন, কাজি সালাউদ্দিন ভাই এবং এনায়েত ভাই। তাদের ড্রিবলিং, গতি, ছন্দ আর শূটিং ছিল দেখার মতো। ক্লাব ফুটবলে অনেক জয় পরাজয়ের সাক্ষী আপনি। কোন খেলাটি আপনাকে আজও পীড়া দেয়। তিনি জানান, ১৯৮৬ সালের মোহামেডান আবাহনীর লীগ ম্যাচ। ক্লাব অফিশিয়ালরা হুট করে মোহামেডানের সঙ্গে খেলার কিছুদিন আগে ভারতের মনোরঞ্জন ভাস্কর আর চিমাকে নিয়ে আসেন। তাদের মাঠে নামিয়ে দিলে খেলা বুঝে উঠার আগেই আমরা পিছিয়ে পড়ি। সেই ম্যাচ দলীয় সমঝোতা না হওয়াই আমরা ২-০ গোলে হেরে যাই। অথচ ওই ম্যাচ জিতলে আমরা পরপর চার বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করতাম। সেটা মনে হলে একটু খারাপই লাগে। খেলোয়াড়রা আপনাকে অন্য একটি নামে ডাকত, জানেন? হাসি দিয়ে ইউসুফ বলেন, খেলোয়াড়রা আমাকে বুড়ো বলে ডাকত.... হাহ হাহ হাহ। খেলোয়াড়ি জীবনে মজার অভিজ্ঞতা জানিয়ে ইউসুফ বলেন, ১৯৭৫-৭৬ সালের ঘটনা। টঙ্গীর একটা কারখানায় আমাকে খেলোয়াড় হিসেবে চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। কোন খেলা নেই। মাঝে মাঝে গিয়ে শ্রমিকদের সাথে খেলা নিয়ে আলাপ আলোচনা করে চলে আসতাম। বেতনের সময় হলে বেতন দিত। কয়েক মাস পর আমার কাছে বিষয়টা খুব খারাপ লাগতে লাগল। খেলা বা কোন কাজ নেই অথচ আমাকে কেন রেখেছে। আমি ম্যানেজারকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম বিষয়টা। তিনি আমায় জানালেন আমাকে শুধু শুধু বসিয়ে টাকা দেয় না। এটার একটা কারণ আছে। উনি জানালেন কারখানার শ্রমিকরা ঢাকার ফুটবল খেলার খবর রাখেন নিয়মিত এবং ভাল ভাল খেলোয়াড়দের সবার নাম জানে তারা। তারা আপনাকে দেখে উৎসাহিত হয়। তারা খেলাধুলা নিয়ে আলাপ করে। এতে করে তাদের কাজের স্পৃহা বেড়ে যায় বহু গুণে। এই ঘটনা শোনার পর আমার মনে যে আনন্দ হলো তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। ফুটবলে কষ্ট প্রসঙ্গে ইউসুফ বলেন, ১৯৮২ সালের কথা। তখন আমি ঢাকা মোহামেডানে। সেবার লীগ চ্যাম্পিয়নসহ ভারতের আশিশ জাব্বারে চ্যাম্পিয়ন হই। আমি হাঁটুতে আঘাত পাই এবং আমার হাঁটুর অপারেশন হয়। মোহামেডান অফিসিয়ালেরা আমাকে দলবদলের সময় গুরুত্ব দিলেন না। হাঁটুর অপারেশন হলে সাধারণত মাঠে ভালভাবে ফিরে আসা যায় না। তদুপরি আবাহনী আমাকে অফার করে। আমি মনে কষ্ট নিয়েই ঢাকা আবাহনীতে যোগ দেই। দীর্ঘদিন মাঠে থেকে আমি প্রমাণ করেছিলাম মনের জোর থাকলে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। ৯২-৯৩ সালে ভিক্টোরিয়াতে এক বছর খেলি। পরের বার আবাহনীতে কোচ হিসেবে নেবে এমন প্রতিশ্রুতি দিলে আমি আবাহনীতে চলে আসি। তখন কোচ ছিলেন ইরাকের সামির সাকির। সে বার আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়। আমি অবসর নেই। আমাকে কোচ করার কথা থাকলেও আমাকে না জানিয়েই আবাহনী টিম ভারতের একটা টুর্নামেন্টে খেলতে যায়। আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করেনি। তখন বুঝতে পারি আবাহনীর কোচের দায়িত্ব আর পাচ্ছি না। আমি এই আচরণে খুব কষ্ট পাই। ওই বছরেই মোহামেডান আমাকে কোচের দায়িত্ব দেয়। আমার দায়িত্বে মোহামেডান ঐ বছর দুইটা ট্রফি পায়। লীগের নাইজেরিয়ান কোচ কাদেরি ইখানা এসে মোহামেডানে মুল কোচের দায়িত্ব পালন করেন। তার দায়িত্বে মোহামেডান বেস কিছু পয়েন্ট নষ্ট করে। পরে আবার আমাকে মূল দায়িত্ব দেয়া হয়। শেষ ম্যাচে আবাহনীর সাথে হেরে চ্যাম্পিয়নশিপ হারায় মোহামেডান। সব দোষ পড়ে আমার ঘাড়ে। এ বিষয়গুলো আমাকে খুব পীড়া দেয়। তথাপি আমি এগুলোকে খেলাধুলার একটা অংশ হিসেবেই মেনে নেই। দেশের ফুটবলের জাগরণ প্রসঙ্গে ইউসুফ জানান, শুধু ঢাকার মাঠে ফুটবল গড়ালেই ফুটবলের উন্নতি হবে না। নিয়মিত স্কুল পর্যায়ে এবং জেলা শহরে ফুটবল চালু করতে হবে। বয়স ভিত্তিক দল থাকতে হবে। সৎ এবং যোগ্য লোকদের অধীনে ফুটবলকে রাখতে হবে। বয়সভিত্তিক প্রতিটা দলের জন্য ভাল মানের দেশী-বিদেশী কোচদের নিয়োগ দিতে হবে এবং সেটা হতে হবে দীর্ঘমেয়াদী, এমনটাই জানালেন এক সময়ের রক্ষণভাগের খেলোয়াড় মোহাম্মাদ আবু ইউসুফ। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে জর্ডানের কাছে ৮-০ গোলে পরাজয় এবং সাফ ব্যর্থতা প্রসঙ্গে ইউসুফ বলেন, এটা আমি মনে করি অনেকটাই স্বাভাবিক ফলাফল। কারন জর্ডানকে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বের দল বললেও ভুল হবে না। গতবার তারা অল্পের জন্য চূড়ান্ত পর্বে যেতে পারেনি। তবে সাফ ফুটবলে এখনও আমাদের এই ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। এখনও সাফের গ-িই আমরা ভালভাবে পার করতে পারছি না। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এদের সাথে নিয়মিত হারছি। খেলতে গেলে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগী। কোন পরিবর্তন নেই। দিন দিন মানসিকভাবেও যেন আমরা পিছিয়ে পড়ছি। মোহাম্মাদ আবু ইউসুফের স্ত্রী মারা গেছেন ২০১৫ সালে। আবু সুফিয়ান এবং আবু জাফর দুই ছেলেই ডাক্তার। বর্তমানে থাকেন কেরানীগঞ্জে। এখন আর কোন ক্লাবের সাথে যুক্ত নেই তিনি। খেলোয়াড়ি জীবনে কোন পুরস্কার পাননি ইউসুফ তবে সেরা কোচের পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির (বিএসপিএ) পক্ষ থেকে।
×