ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুয়াজ্জিন হত্যার নেপথ্যে মসজিদের আর্থিক বিষয় থাকতে পারে

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৩ এপ্রিল ২০১৬

মুয়াজ্জিন হত্যার নেপথ্যে মসজিদের আর্থিক বিষয় থাকতে পারে

শংকর কুমার দে ॥ দেড় শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার ইসলামপুরের ঝব্বু খানম জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেন খুনের রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে। দীর্ঘ প্রায় আটাশ বছর ধরে মসজিদটির ইমামের দায়িত্ব পালনরত মুয়াজ্জিনকে কী কারণে হত্যা করা হয়েছে তার ক্লু খুঁজে পাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। ‘অর্থই অনর্থের মূল’ এমন প্রবাদবাক্যের মতো মসজিদের আর্থিক বিষয়টির কারণেই মুুয়াজ্জিন হত্যাকা-ের নেপথ্যের মোটিভ হতে পারে বলে তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্র জানান, হত্যাকা-ের তদন্ত করতে গিয়ে নেপথ্যে থাকা স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রের হাত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তাদের কেউ কেউ স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। বিশেষ করে ইসলামপন্থী কিছু দলের রাজনৈতিক নেতারাও মসজিদে খবরদারি করতে মুয়াজ্জিনকে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে হাত মেলানোর বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে খুব শীঘ্রই হত্যাকা-ে জড়িতদের খুঁজে বের করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশ্বাসী। সূত্র জানান, নবাবী আমলে তৈরি হলেও মসজিদের সম্পত্তি, আথিক লেনদেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছুরই দেখভাল করতেন নিহত মুয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেন। তবে মসজিদের আর্থিক বিষয়ে অনেক দুর্নীতির অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তদন্তের পর্যায়ে কয়েকটি বিষয়ে যে তথ্য পাওয়া গেছে তার মধ্যে মসজিদকেন্দ্রিক আর্থিক লেনদেনের পাশাপাশি মার্কেটের কর্তৃত্ব নিতেই স্থানীয় প্রভাবশালীদের চক্রান্তে মুয়াজ্জিনকে হত্যা করা হতে পারে। এছাড়াও জঙ্গী সম্পৃক্তাসহ আরও একাধিক বিষয়কে অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে। নিহত মুয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেনের ছেলে মাদ্রাসাছাত্র ইয়াসিন বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এজাহারে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে কয়েকদিন ধরে মানববন্ধন করেছে পরিবার ও বিভিন্ন সংগঠন। তার পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশকে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে মুয়াজ্জিন বিল্লালকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, নয় মাস আগেও একবার বাবার ওপর হামলা চালিয়েছিল খুনীরা। তখন তিনি সাত দিন হাসপাতালে থেকে সুস্থ হন। এর পর কোতোয়ালি থানায় জিডি করেন। পুলিশ জানায়, মুয়াজ্জিন বিল্লাল হত্যার ঘটনায় গত আট দিনে সন্দেহভাজন অন্তত অর্ধশতাধিক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের বক্তব্যে মসজিদের আর্থিক লেনদেন এবং মোয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেনের ব্যক্তিগত আয়-ব্যয়ের হিসাবে কিছু সন্দেহজনক তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে বিল্লাল হোসেনের তিনটি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৯৮৬ সালের একটি এ্যাকাউন্ট রয়েছে। প্রতিটি এ্যাকাউন্টে মাঝে মধ্যে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লেনদেন করেছেন বিল্লাল হোসেন। এছাড়া মসজিদের মার্কেট ও দানবাক্স থেকে মাসে অন্তত এক লাখ টাকা আয় হতো। ওই টাকার পুরোটাই মুয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেনের হেফাজতে থাকত। এভাবে প্রতিবছর মসজিদের আর্থিক উৎস থেকে মসজিদ ফান্ডে অনেক টাকা আসত। সেসব টাকা মুয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেন ছাড়া অন্য কেউ জানতেও পারতেন না। এ নিয়ে স্থানীয় প্রবাবশালীদের অনেকেই ইমামের ওপর কিছুটা নাখোশ ছিলেন। এছাড়া মুয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেনের এক বন্ধুর সঙ্গে (তিনিও হুজুর) ৫-৭ লাখ টাকার লেনদেন সংক্রান্ত বিরোধ চলছিল। এ ঘটনায় তাকে ও সংশ্লিষ্টদের খোঁজা হচ্ছে। মসজিদের আর্থিক বিষয়কে কেন্দ্র করে মুয়াজ্জিন বিল্লাল হত্যাকা-ের আগের অনেক তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এসবের কোন একটি কারণেই মুয়াজ্জিম বিল্লালকে হত্যা করা হতে পারে। এলাকাবাসীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ জানায়, ১৮৭৬ সালে ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্যরা ইসলামপুরের মসজিদটি নির্মাণ করেন। এক শ’ চল্লিশ বছরের পুরনো এই ঐতিহাসিক মসজিদটি এখন প্রভাবশালী অপরাধী চক্রের নজরে পড়েছে। নবাব পরিবারের একজন প্রতিনিধি মসজিদটি দেখভাল করলেও প্রভাবশালীদের কাছে তিনিও জিম্মি। তবে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে মসজিদটির ইমামের দায়িত্বের পাশাপাশি আর্থিক বিষয়গুলো দেখতেন মুয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেন। মসজিদের বিভিন্ন উৎস থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা আয় হলেও ২০০৫ সালে মসজিদটি একবার পুনর্নির্মাণ করা হয়। স্থানীয়রা মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়লেও মসজিদের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে তারা খুব একটা খোঁজখবর রাখতেন না। আর এই সুযোগ অনেকেই নেয় বলে তদন্তে তথ্য মিলেছে। পুলিশ জানায়, ছয়তলা ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে মসজিদ। নিচতলায় ১৭টি এবং আন্ডারগ্রাউন্ডে ১৩টি দোকান রয়েছে, যা ঝব্বু খানম জামে মসজিদ মার্কেট হিসেবেই পরিচিত। মসজিদের দেয়াল লাগোয়া রয়েছে ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ (মাদার তেরেসা) শিশু ভবন। উল্টোপাশে ‘শাহ ওমর গনি বোগদাদী জিন্দাপীর শাহ বাবার (রহ)’ একটি মাজারও রয়েছে। মসজিদের মুয়াজ্জিনের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকের ভাল সম্পর্ক ছিল। মুয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেন মূলত পীরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এ কারণে তিনি বিভিন্ন মাজারে গিয়ে ওয়াজ মাহফিলও করতেন। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মুয়াজ্জিন বেলাল হোসেন হত্যাকা-ে জড়িতদের সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তে মসজিদের আর্থিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সর্বোচ্চ ও প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এর আগেও একবার মসজিদের ভেতরে তার ওপর হামলা চালিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। কারও কারও মতে, সে সময় ৬৫ হাজার টাকা লুটে নেয় দুর্বৃত্তরা। মসজিদের দানবাক্স ভেঙ্গে ও তার কাছে থাকা প্রায় দুই লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও রয়েছে। তদন্তে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মুয়াজ্জিনকে তখন মারধর করে দানবাক্স ভেঙ্গে টাকা লুট করে নেয়ার ঘটনারও তদন্ত চলছে। প্রসঙ্গত, গত ৩ এপ্রিল রাতের কোন এক সময় দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে মুয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেনকে (৫৩) মসজিদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার মাঝের সিঁড়িতে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে বলে পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। মুয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেন মসজিদের তৃতীয় তলার পূর্ব পাশের একটি কক্ষে থাকতেন। পশ্চিম পাশের আরেকটি কক্ষে থাকতেন জুনিয়র মুয়াজ্জিন মোশারফ হোসেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, ঘটনার সময় মোশারফ নিজ কক্ষেই ঘুমিয়েছিলেন।
×