ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষবরণের অর্ঘ্য

চৈত্র শেষের দাবদাহে প্রকৃতি সেজেছে আগুনে রঙের কৃষ্ণচূড়ায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৩ এপ্রিল ২০১৬

চৈত্র শেষের দাবদাহে প্রকৃতি সেজেছে আগুনে রঙের কৃষ্ণচূড়ায়

সমুদ্র হক ॥ চৈত্র শেষের দাবদাহে শহর-গ্রামে প্রকৃতি সেজেছে আগুন রঙের কৃষ্ণচূড়ায়। ডেকে এনেছে বৈশাখ। বসন্ত শেষে ও গ্রীষ্মের শুরুতে ফোটা ফুল কৃষ্ণচূড়া বাঙালী সংস্কৃতি এবং কাব্যচর্চায় এতটাই জনপ্রিয় যে বর্ষবরণের বৈশাখকেই রাঙিয়ে দেয়। প্রকৃতি কৃষ্ণচূড়া ফুটিয়ে দেশজুড়ে নববর্ষের লাল আভায় ভরিয়ে দিয়েছে। মনে হবে গোটা দেশই কৃষ্ণচূড়ার শহর ও গ্রাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘গন্ধে উদাস হওয়ার মতো উড়ে/ তোমার উত্তরী কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরি...’। এই সময়টায় দেশের যে কোন শহর ও গ্রামে গেলে কৃষ্ণচূড়াকে চোখে পড়বেই। এই কিছু আগেই ফুটেছে পলাশ। এই দুই ফুলকে নিয়ে আছে গান ‘পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া আগুন জ্বালে......রঙে রঙে রং মশাল জ্বালে। আমি কস্তুরি যে নিজের গন্ধে নিজেই ভুলি...’। আকাশপানে বেড়ে ওঠা কৃষ্ণচূড়ার শাখা-প্রশাখা দূর থেকেই জানান দেয় আগুনের ফুলকি। চরা চৈত্রে ঘামে দরদর শরীর নিয়েই পথিক হেঁটে যায় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচ দিয়ে। এই ছায়ায় স্বস্তি পায় কিছুটা। চিরহরিৎ বক্ষ লাল কৃষ্ণচূড়ার ফোটার আগে কলি দেখতে অনেকটা মোহরের মতো দেখায়। এর আরেক নাম গুলমোহর। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ রফির কণ্ঠের একটি গান ‘গুলমোহরের ফুল ঝরে যায় ডাল ডালে শাখায় শাখায়...’। ফোটার পর কৃষ্ণচূড়াকে দেখে কোন গীতিকারের লেখা গান রফির কণ্ঠে গীত হয়েছে এভাবে “...আকাশ অনেক রঙে রাঙানো মাটিতে ফুলের মেলা সাজানো...কৃষ্ণচূড়া আর দোপাটি মেলে দিল...’। আমাদের কাব্যে সাহিত্যে জীবনের চলার পথে ভাব বিনিময়ে প্রণয়ে কৃষ্ণচূড়া অনেক বড় আসন করে নিয়েছে। বসন্ত শেষে চৈত্রের দাহজ্বালা রোদের ভরদুপুরে প্রণয় মধুর জীবনে একজোড়া কপোতকপোতি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচের শীতল ছায়ায় কী অপার মধুময়তার ভুবন তৈরি করে। এমনই ক্ষণে কেউ নস্টালজিক হয়ে তার স্মৃতির পাতায় ধরা দিতে পারে পুরনো দিনের ছায়াছবি হারানো সুরের সেই দৃশ্য- যে কৃষ্ণচূড়ার নিচে সুচিত্রার কোলে উত্তম মাথা রেখে সুচিত্রার ঠোঁটে বাজছে গীতা দত্তের গাওয়া সেই অমর গান ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার, কানে কানে শুধু একবার বলো তুমি যে আমার...’। বসন্তের একেবারে শেষের বেলার এই প্রকৃতি হয়তো কৃষ্ণচূড়াকে বলছে গানের সেই কথা। যে কৃষ্ণচূড়াকে নিয়ে এত কথা তাকে আমরা লাল রঙেই দেখতে অভ্যস্ত। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া তিনটি রঙের হয়। লাল হলুদ ও সাদা। হলদে রঙের কৃষ্ণচূড়া তবু চোখে পড়ে। সাদা রঙের কৃষ্ণচূড়ার দেখা মেলে কালেভদ্রে। এই তিন রঙের কৃষ্ণচূড়ার গাছ উঁচু। অনেকটা জায়গা জুড়ে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটায়। তিন রঙেরই ফুল ফোটে প্রায় একই সময়ে। ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে দৃষ্টি পড়লে দেখা মেলে হলদে কৃষ্ণচূড়ার। মূল ভবনের সামনে ও পেছনে হলুদ কৃষ্ণচূড়ার দু’টি বৃক্ষ আছে। হলদে প্রজাতির কৃষ্ণচূড়ার গাছ অনেক জায়গাতেই আছে। তবে সাদা রঙের কৃষ্ণচূড়া অতি দুষ্পাপ্য। অনেকেই রাধাচূড়াকে ভুল করে কৃষ্ণচূড়া বলে। কৃষ্ণচূড়া গাছের ইংরেজী নাম ফ্লেম ট্রি। বৈজ্ঞানিক নাম ডিলোনিক্স রিগিয়া। ফ্যাভেসিয়ে পরিবারভুক্ত। অনেক উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর মতে ডিলোনিক্স ইলাদা প্রজাতির কৃষ্ণচূড়া সাদা হয়ে ফোটে। বাসি হলেই রং হলুদ হয়ে যায়। এই মতে হলুদ প্রজাতির কৃষ্ণচূড়ার প্রথম রূপ সাদা কৃষ্ণচূড়া। এই তত্ত্ব মানতে রাজি নয় উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর আরেক দল। তাদের কথা- সাদা কৃষ্ণচূড়া অবশ্যই আছে। হতে পারে সাদা রূপ হলদে হয়ে যায়। সাদা কৃষ্ণচূড়া সাদা হয়েই ফোটে ওই রঙেই ঝরে যায়। বিজ্ঞানীদের মতপার্থক্য যতই থাক সাধারণ মানুষ যাকে আমরা আম পাবলিক বলি তারা কৃষ্ণচূড়া সাদা হলদে না লাল তা বোঝার চেষ্টা করি না। উঁচু গাছের শাখা-প্রশাখায় লাল কৃষ্ণচূড়া দেখি বেশি। বসন্ত শেষে ও গ্রীষ্মে রোদের দাহের মধ্যেও আনন্দ দেয় কৃষ্ণচূড়া। এই আনন্দেই বৈশাখ এসে নববর্ষের আনন্দকে পূর্ণতা দেয়। নববর্ষের অর্ঘ্য হয়ে ওঠে কৃষ্ণচূড়া।
×