ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ চান কূটনীতিকরা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৩ এপ্রিল ২০১৬

ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ চান কূটনীতিকরা

তৌহিদুর রহমান ॥ একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশকে ‘কঠিন পদক্ষেপ’ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। এসব ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের দাবিতে তারা ধীরে ধীরে সরব হচ্ছেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সরকারের প্রতিও তাগিদ দিয়েছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। ব্লগার হত্যার ঘটনাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ‘চরম আঘাত’ বলে মনে করছেন তারা। কূটনীতিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও লেখক-ব্লগার হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে। সোমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে আবারও ব্লগার হত্যার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিদেশী কূটনীতিকরা বলছেন, ব্লগার হত্যার অর্থ হলো মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত। ব্লগারদের হত্যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমনভাবে হত্যা মতপ্রকাশ ও মানবাধিকারের প্রতি চরম আঘাত। লেখক-ব্লগার-প্রকাশক নাজিমুদ্দিন সামাদ, অভিজিৎ রায়, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, রাজীব হায়দার, ফয়সাল আরেফিন দীপন প্রমুখ হত্যার ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে তারা। এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। ব্লগার নাজিমুদ্দিন নিহতের ঘটনায় দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য। এছাড়া একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ফ্রিডম হাউস, যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন, মানবাধিকার সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, পেন ইন্টারন্যাশনাল, কানাডাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইফেক্স। নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যার পর ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট ওয়াটকিন্স এই হত্যাকা-ের পূর্ণ তদন্ত দাবি করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে আগেকার হত্যাকা-গুলোর তদন্তও দ্রুত শেষ করে ওইসব ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার কথা পুনর্ব্যক্ত করে সংস্থাটি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জোট জাতিসংঘের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, এ ধরনের আক্রমণ বাংলাদেশের সমাজে অসহনশীলতার ধারাবাহিকতারই অংশ। এসব বন্ধে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এদিকে সোমবার আবারও ব্লগার হত্যার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমুখপাত্র মার্ক টোনার বলেছেন, বাংলাদেশে অতীতেও ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক ব্লগার হত্যার বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। ব্লগারদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারকে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্লগার হত্যার ঘটনা পুরোপুরিভাবে তদন্ত ও তাদের পরিবারকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান তিনি। মার্ক টোনার আরও বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআই ইতোমধ্যেই ব্লগার হত্যার বিষয়ে তদন্তে সহযোগিতা করছে। ব্লগারদের ওপর হামলার ঘটনায় ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করে তাদের সুষ্ঠু বিচারের আওতায় আনার জন্য গত সপ্তাহেও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের ব্লগার নাজিমুদ্দিন সামাদ নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। লেখক ও ব্লগারদের ওপর সাম্প্রতিক ধারাবাহিক হামলার সর্বশেষ ঘটনা এটি। তারা আশা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অপরাধীদের সুষ্ঠু বিচারের আওতায় আনবে। এছাড়া সকল বাংলাদেশী কোন ধরনের সহিংসতা ও ভয়ভীতি ছাড়াই তাদের শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন, যা সার্বজনীন মানবাধিকারে সংরক্ষিত। এর আগে ব্লগার হত্যার ঘটনায় খুনীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা- ইউনেস্কো। তারা বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অটুট রাখতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। সংস্থাটি বলেছে, ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে কিংবা নিজে থেকেই নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন করা কখনই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। মুক্তচিন্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে ব্লগার হত্যাকা-ের ঘটনায় জড়িত সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত গুরুত্বের সঙ্গে এই হত্যাকা-ের দ্রুত বিচার করা। এদিকে বিভিন্ন সময়ে জঙ্গী হামলা ও হুমকির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তমনা ব্লগার, লেখকদের যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দিতে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির কাছে সুপারিশ করে ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম-ইউএসসিআইআরএফ। গত ২৫ জানুয়ারি ইউএসসিআইআরএফ-এর পক্ষ থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, ২০১৫ সালে লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ ও নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় এবং প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন খুন হয়েছেন তাদের লেখা ও বিশ্বাসের কারণে। আরও অনেককে হুমকি দিয়ে হিট লিস্ট প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশে যে ব্লগাররা ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন, তাদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক লেখককে আশ্রয় দিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানায় ফেডারেল সরকারের স্বাধীন কমিশন ইউএসসিআইআরএফ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ব্লগারদের আশ্রয়ের বিষয়টি এখন বিবেচনাধীন রয়েছে। ব্লগার হত্যার ঘটনায় কূটনীতিকদের পাশাপাশি সরব হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংস্থা ফ্রিডম হাউস বলেছে, বাংলাদেশে এভাবে একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন। ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি আনতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ফ্রিডম হাউস। এছাড়া কানাডা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইফেক্স ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশের ব্লগারদের হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে। আইফেক্স বলেছে, বাংলাদেশে একের পর ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগাররা হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছেন। ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান ও অনন্ত বিজয়ের খুনীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। গত ৬ এপ্রিল ব্লগার নাজিমকে ঢাকার সূত্রাপুরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সিলেটে গণজাগরণ আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে কাজ করা নাজিম ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনলাইনে লেখালেখিতেও সক্রিয় ছিলেন। এর আগে ব্লগার-লেখক-প্রকাশক হত্যার ঘটনাগুলোর মতো একই কায়দায় খুন করা হয় নাজিমকে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সাল থেকে এই পর্যন্ত বাংলাদেশে ছয় জন অনলাইন এ্যাকটিভিস্ট, ব্লগার, লেখক ও প্রকাশককে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ ব্লগার নাজিমুদ্দিনকে হত্যা করা হয়। এর আগে গত বছর ১২ মে সিলেটে বাসার সামনে খুন হন ব্লগার ও লেখক অনন্ত বিজয় দাশ। তিনি মুক্তমনা ব্লগে বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতেন। এছাড়া গত বছর ৩০ মার্চ ঢাকার তেজগাঁওয়ে নিজের বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়া পথে দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে খুন হন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান। গত বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি অমর একুশের বইমেলা থেকে বের হওয়ার পরে খুন হন ব্লগার-লেখক অভিজিৎ রায়। এসময় মারত্মক আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।
×