ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৈসাবি উদযাপন শুরু

নববর্ষের শুভ কামনায় নদীতে ফুল ভাসাল পাহাড়ী তরুণ-তরুণী

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৩ এপ্রিল ২০১৬

নববর্ষের শুভ কামনায় নদীতে ফুল ভাসাল পাহাড়ী তরুণ-তরুণী

নিজস্ব সংবাদদাতা, খাগড়াছড়ি/ রাঙ্গামাটি/ বান্দরবান, ১২ এপ্রিল ॥ নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর তিন দিনব্যাপী প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। মঙ্গলবার ভোরে চেঙ্গী, ফেনী ও মাইনী নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব বৈসাবি। পাহাড়ের কিশোর-কিশোরী ও ছোট ছোট ছেলেমেয়ে কলাপাতায় করে ফুল তুলে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে নদী-খালে ভাসিয়ে পুরনো বছরের গ্লানি মুছে নতুন বছরের শুভ কামনায় নিজেদের পবিত্রতা কামনা করে। মঙ্গলবার ছিল চাকমাদের ফুল বিজু আর ত্রিপুরাদের হারিবৈসু। এর মধ্য দিয়ে পাহাড়ে বর্ষবরণ ও বর্ষ বিদায়ের তিন দিনব্যাপী প্রাণের বৈসাবি শুরু হলো। বর্ষবরণ উৎসবকে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক বলে আখ্যা দিলেও গোটা পার্বত্য এলাকায় তা বৈসাবি নামেই পরিচিত। বাংলা বছরের শেষ দু’দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন- এই তিন দিন মিলেই মূলত বর্ষবরণ উৎসব পালিত হয়। চাকমা সম্প্রদায় বুধবার মূল বিঝু আর পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে। ওই দিন ঘরে ঘরে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। সেই সঙ্গে সব বয়সী মানুষ নদী, খাল অথবা ঝর্ণায় গঙ্গা দেবীর পূজা আরাধনা করবেন। মঙ্গলবার ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সী আদিবাসীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে ফুল সংগ্রহ করে চেঙ্গী নদী ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন খালে বুদ্ধকে স্মরণ করে ফুল ভাসিয়ে দেয়। তারা গঙ্গা দেবীর পূজা করে। উৎসবের প্রথম দিনে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা আদিবাসীরা ফুল দিয়ে ঘর সাজিয়েছে। এ উপলক্ষে সকালে পানখাইয়াপাড়ায় আয়োজন করা হয় মারমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা প্রতিযোগিতা। পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন। দুপুরে খাগড়াপুরে শুরু হয় ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী গরাইয়া নৃত্য উৎসব। ত্রিপুরা সম্প্রদায় হারিবৈসু, বিযুমা, বিসি কাতাল এবং মারমারা পেইংচোয়ে, আক্যে ও আদাদা এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাই উৎসবে ঐতিহ্যবাহী জলকেলি বা পানি উৎসব করবে। রাঙ্গামাটিতে বৈসাবি উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু ॥ কাপ্তাই হ্রদের জলে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে রাঙ্গামাটিতে তিন দিনব্যাপী বৈসাবি (বাংলা বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ) উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছে উপজাতিরা। মঙ্গলবার সকালে শহরের গর্জনতলী এলাকায় নানা বয়সের নারী-পুরুষকে নিয়ে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জলে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে তাদের রীতি অনুযায়ী প্রণাম করে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। ভোর থেকেই বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ তাদের নিজস্ব পোষাকে সজ্জিত হয়ে ফুল ভাসাতে আসে কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে। ফুল ভাসনোর অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য স্মৃতি বিকাশ ত্রিপুরা। এ ছাড়া রাজবাড়ী ঘাটে ফুল বিজু পালন করা হয়। ফুল ভাসানোর পর ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বয়স্কদের মধ্যে কাপড় বিতরণ করা হয়। পরে সেখানে ত্রিপুরা সম্প্রদায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে। এ ছাড়াও সকাল থেকে পাহাড়ী গৃহিণীরা নিমপাতা ও রং বেরঙর ফুল দিয়ে ঘর সাজান। দিনভর চলে নানা আনুষ্ঠানিকতা ও অতিথি আপ্যায়ন। বুধবার হবে মূল বিজু। এদিন ঘরে ঘরে পাঁচন রান্না করা হবে। ঐতিহ্যবাহী এই পাঁচন (মিশ্রিত সবজি) সবার প্রিয় খাবার। এদিকে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পহেলা বৈশাখ উৎসব পালন করার জন্য ব্যাপক আয়োজন করেছে । উৎসবের মধ্যে রয়েছে আনন্দ র‌্যালি, পান্তা উৎসব ও ডিসি অফিস প্রাঙ্গণে মেলা ইত্যাদি। বান্দরবানে সাংগ্রাই শুরু ॥ বান্দরবান পার্বত্য জেলায় আদিবাসী ঐতিহ্যের সাজে বর্ণিল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে মারমা আদিবাসীদের পাঁচ দিনব্যাপী বর্ষবরণ উৎসব সাংগ্রাই শুরু হয়েছে। এ উপলক্ষে মঙ্গলবার সকালে বান্দরবান শহরের রাজারমাঠ থেকে বর্ণিল শোভাযাত্রা বের করা হয়, পরে শোভাযাত্রাটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে রাজার মাঠে শেষ হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি। এ সময় শত শত আদিবাসী তরুণ-তরুণী তাদের ঐতিহ্য অনুসারে বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিধান করে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপন কমিটি সূত্রে জানা যায়, ১৩ এপ্রিল দুপুরে উজানীপাড়ার পার্শ্ববর্তী সাঙ্গু নদীতে বুদ্ধ মূর্তি¯œান, ১৫ ও ১৬ এপ্রিল পুরনো রাজার মাঠে মারমা আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের জলকেলি, সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত রয়েছে মন্দিরে মন্দিরে ধর্ম দেশনা শ্রবণ, বিশেষ প্রার্থনাসহ ছোয়াইং দান অনুষ্ঠান। উৎসব ঘিরে পাহাড়ে পর্যটকদের আগমন বাড়ার কারণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। মঙ্গলবার বিকেলে তংচঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার উদ্যোগে বান্দরবানের রেইছায় সাতকমলপাড়ায় বিষু উৎসব উদযাপন করা হয়। এ সময় আদিবাসী তংচঙ্গ্যারা মেতে ওঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও তাদের ঐতিহ্যবাহী ঘিলাখেলা প্রতিযোগিতায়।
×