ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখী বাজার জমজমাট সারাদেশে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৩ এপ্রিল ২০১৬

বৈশাখী বাজার জমজমাট সারাদেশে

রহিম শেখ ॥ কাল পহেলা বৈশাখ। বাঙালী সংস্কৃতির অনন্য এক উৎসব। শুধু সংস্কৃতি নয়, এই উৎসবকে ঘিরে এখন পুরো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গতি বাড়ছে। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই বৈশাখ ঘিরে জমজমাট প্রস্তুতি চলছে। রাজধানীসহ সারাদেশের নগরীর বিপণিবিতান, মার্কেট, শপিংমল থেকে শুরু করে ফুটপাথ ছেয়ে গেছে বৈশাখী সামগ্রী ও রকমারি পোশাকে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেয়া হচ্ছে আকর্ষণীয় সব অফার। বসে নেই খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ীরাও। অস্বাভাবিক চাহিদার কারণে ইলিশের দাম এখন আকাশচুম্বী। বাংলার এই উৎসবকে ঘিরে অন্য সময়ের চেয়ে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা ওঠানোর পরিমাণও বেড়েছে। এ বছর বৈশাখী অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে নববর্ষের বোনাস। এ বোনাসের কয়েক শ’ কোটি টাকা আসবে বৈশাখের বাজারে, যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এসব কর্মকা- ঘিরে অর্থনীতির লেনদেন বাড়ছে কয়েকগুণ। আর্থিক বিবেচনায় লেনদেনের সম্ভাব্য পরিমাণ হবে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাজধানীর মার্কেট-বিপণিবিতানে চলছে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা। সারাদেশের অভিজাত শপিংমল থেকে শুরু করে ফুটপাথ ছেয়ে গেছে বৈশাখের পোশাকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর পোশাক বিক্রি গত বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বৈশাখ উপলক্ষে এবার শাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাকই বিক্রি হবে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার। এর সঙ্গে চুড়ি, মালা, দুল, মাটির তৈরি পণ্য, কুটিরশিল্পসহ নানা পণ্য বিক্রির টার্গেটও ছাড়িয়ে যাবে। এসব কাজে যত লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে তা হিসাব করা হলে এই অর্থনৈতিক কর্মকা-ের পরিমাণ সাত-আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। একাধিক ফ্যাশন হাউসের উদ্যোক্তারা জানান, সারাবছর তাদের যে ব্যবসা হয় তার অর্ধেকই হয় রোজার ঈদে। পহেলা বৈশাখে হয় প্রায় ২৫ শতাংশ। আর বাকিটা সারাবছর। তবে এবার বৈশাখী পণ্যের যে বেচাকেনা হয়েছে তাতে এখনই ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। শেষ সময় এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে তা ৩৫ শতাংশে এসে দাঁড়াবে। তথ্যমতে, রাজধানীসহ সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৫-৬ হাজার বুটিক ও ফ্যাশন হাউস রয়েছে। অধিকাংশ উদ্যোক্তার দাবি, অবরুদ্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বেশ কিছুদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছিল, যার প্রভাবে বেশকিছু ছোটখাটো ফ্যাশন হাউস এরই মধ্যে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। তবে লোকসানের মুখেও যেসব ফ্যাশন প্রতিষ্ঠান নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এবারের বৈশাখের বিক্রিতে তাদের ব্যবসা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তাদের দাবি, গত বছরের চেয়ে এবারের বৈশাখী পণ্য ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি বিক্রি হবে। এ বছর বৈশাখী অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবি সদস্য, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চাকরিজীবী এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নববর্ষের বোনাস। সরকার তাদের জন্য বাড়তি একটি নববর্ষ ভাতা নামে বোনাস দিচ্ছে। এ বোনাসের কয়েক শ’ কোটি টাকা আসবে বৈশাখের বাজারে, যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে পুরো জাতি উৎসবে মেতে ওঠে। অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক দিক রয়েছে। কারণ এতে দেশে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। তার মতে, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঠিক রাখতে পারলে এ উৎসব পুরোটাই ইতিবাচক। তবে এ সময় সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক রাখা যায় না। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, এ বছর সরকারী চাকরিজীবীরা বোনাস পাবেন। যদিও এ টাকার অঙ্কটি উল্লেখযোগ্য কোন ফিগার নয়। এর পরও বাড়তি টাকা আসায় কিছু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতিতেও কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। পহেলা বৈশাখের কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বর্ষবরণের এই উৎসবটি এক সময় ছিল শুধুই গ্রামাঞ্চলের উৎসব। এই উৎসবে এখন নগরের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। বৈশাখ উপলক্ষে তৈরি হওয়া শাড়ি, কুটির শিল্প কিংবা খেলনায় থাকছে গ্রামীণ ছোঁয়া। এসব পণ্যের বাজারজাতকরণে বড় ভূমিকা রাখছে বৈশাখ। এসব পণ্যের নগরকেন্দ্রিক বাজার গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে চুড়ি, মাটির তৈরি পণ্য, কুটির শিল্পসহ নানা পণ্য তো রয়েছেই। বড় বিষয় হলো, এসব কাজে অনেকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আবার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে গ্রামের মানুষের কাছে ভাল অর্থ যাচ্ছে। জানা গেছে, পহেলা বৈশাখকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি চাহিদা হচ্ছে ইলিশের। এক কেজি ইলিশের মূল্য এখন কত তা জানার আগ্রহের এখন শেষ নেই। গত ১৫ দিন ধরে ঢাকার বাজারে এই মাছের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বৈশাখে বাড়তি চাহিদাকে সামনে রেখে আগোরা, স্বপ্ন, মীনা বাজারসহ বিভিন্ন চেইন সুপার শপিংমল দিচ্ছে নানা ধরনের খাদ্যপণ্যের আকর্ষণীয় অফার। জানা গেছে, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে লেনদেন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলার সেই প্রাচীনকাল থেকেই। আজও পহেলা বৈশাখের উৎসব সফল করতে মৃৎশিল্পের বিশেষ কারুকাজ, সরা আঁকা, মিছরির মিষ্টি বানানো, খৈ তৈরি, কাপড় বোনা ইত্যাদি অর্থনৈতিক কাজ উৎসবমুখর পরিবেশে চলছে। উৎসুক জনতা শহরের পথে পথে বেড়ানো, মেলায় ঘোরাঘুরি, মিছরি-মুড়কি, শুকনা সন্দেশ কেনাকাটায় সবার অংশগ্রহণ হয় এক কাতার থেকে। এর জন্য নতুন মাত্রায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে হয়। নিয়োগ দিতে হয় অধিক শ্রমিক। বৈশাখ ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানের ফুল ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চাঙ্গা হয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন রাজধানীতে পাইকারি বাজারে ৩০-৩৫ লাখ টাকার ফুল কেনাবেচা হয়। আর বিশেষ বিশেষ দিবসে (যেমন পহেলা বৈশাখ) ৮-১০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। সেই হিসাবে বৈশাখ ঘিরে ৬০-৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট করেছে ফুল ব্যবসায়ী সমিতি। এদিকে, বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে দই-মিষ্টিসহ বেকারিজাত পণ্যের বেচাকেনারও ধুম পড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এক সময় বৈশাখের প্রথম দিনটিতে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা হালখাতা খুলে নতুন বছরটিকে স্বাগত জানাতেন। কালের আবর্তে সে রেওয়াজ প্রায় হারিয়ে গেলেও মিষ্টি দিয়ে দিনটি বরণ করতে ভোলেননি তারা। এছাড়া বৈশাখের দিন বিভিন্ন কর্পোরেট হাউসগুলো তাদের ক্লায়েন্টদের অফিসে মিষ্টি পাঠানোর নতুন রেওয়াজ চালু করেছে। পাশাপাশি শহুরে মানুষ এদিন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়িতেও মিষ্টিজাত পণ্য বিতরণ করছে। সুইটস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানান, স্বাভাবিক সময়ে একটা দোকানে প্রতিদিন যত মিষ্টি বিক্রি হয়, এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন তার তিনগুণ বিক্রি হয়। আর পহেলা বৈশাখের বিক্রি দ্বিগুণ। অন্যদিকে প্রতিবছরের মতো এবারও শুভেচ্ছা কার্ড ও বাংলা নববর্ষের ক্যালেন্ডার উপহার দিয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এতে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসাও জমে উঠেছে। এর সঙ্গে মাথায় পরার কাগজের টুপি এবং বিভিন্ন বৈশাখী বইমেলার জন্য বই ছাপিয়ে বিপুলসংখ্যক প্রতষ্ঠান নিজস্ব অর্থনীতি চাঙ্গা করেছে। সব মিলিয়ে মুদ্রণশিল্পে আনুমানিক ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার লেনদেন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বাংলা বর্ষকে বরণ করতে পার্কে-উদ্যানে, পাড়া-মহল্লায় ছোট-বড় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। সারাদেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালীরা এদিন প্রাণের উৎসবে মেতে উঠবেন। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলা বসে। বৈশাখী মেলা গ্রামবাংলার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। এসব মেলা একই সঙ্গে প্রয়োজনের এবং বিনোদনের। বৈশাখী মেলা গ্রামের অর্থনৈতিক জীবনকে সচল করে রাখে। হস্তনির্মিত নানা পণ্যসামগ্রী এসব মেলায় বেচাকেনা হয়। এদিকে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বসেছে বৈশাখী তাঁতবস্ত্রের মেলা। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ফ্যাশন হাউসগুলো নতুন নক্সার পোশাক বাজারে নিয়ে এসেছে। কেনাকাটায় বৈশাখী মূল্যছাড় দিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। পার্লার ও সোনার দোকানে ভিড় বাড়ছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের নতুন মিউজিক ভিডিও বাজারে এসেছে।
×