ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

নববর্ষের বিরোধীরা দেশের শত্রু

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১৩ এপ্রিল ২০১৬

নববর্ষের বিরোধীরা দেশের শত্রু

পুরাণে বর্ণিত মানব ও দানবের লড়াইয়ের মতই বাঙালীদের তার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শত্রু উগ্র মৌলবাদী শক্তির বিপক্ষে সেই ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানী আমল পার হয়ে এখন স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রাচীন লড়াইটি চালিয়ে যেতে হচ্ছে। বস্তুত এটিই মানুষের সভ্যতার পথে আদি লড়াই- সুর ও অসুরের লড়াই, মানব ও দানবের লড়াই। এই সেদিন ওলামা লীগ নামে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠীর বাঙালী সংস্কৃতির মূল ভিত্তি- বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন বন্ধের চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ বিজ্ঞপ্তি পাঠ করে সঙ্গে সঙ্গেই আবারও সেই পুরনো অন্ধকারের শক্তির দ্বারা বারবার সূচিত হওয়া চিরকালীন মানব ও দানবের লড়াইয়ের পুনঃসূচনা বলে মনে হলো। এই স্বল্প পরিচিত দলটির নেপথ্যে যে একটি বা একাধিক বড় দল রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতনমহল নিশ্চিত। কতগুলো সংঘটিত অপতৎপরতা এবং বিএনপির নেতা-নেত্রীদের কয়েকটি ঘোষণাকে একসূত্রে গাঁথা বলেই মনে হয়, যেমন- ১. শিশু অপহরণ ও হত্যা আকস্মিক বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা। ২. নারী ধর্ষণ ও হত্যা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে যাওয়া। ৩. জাপানী ধর্মীয় যাজক, বিদেশী কর্মকর্তা হত্যা, যা বাংলাদেশে এই প্রথম পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হয়। ৪. পরপর প্রায় দশজন মুক্তমনা, উদার, ধর্মকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যাকারী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তরুণ, কবি, শিক্ষক, প্রকাশককে জঙ্গী হত্যাকারীরা একই কৌশলে হত্যা ও হত্যার চেষ্টা করা। ৫. স্থানীয় নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধপন্থী দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ত্রিশের বেশি ব্যক্তির মৃত্যু। এ ঘটনাও এই প্রথম একই দলের নামে পরিচিতদের মধ্যে এমন মরণপণ সংঘাত পূর্বে সংঘটিত হয়নি। ৬. এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে রাখা থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার হ্যাকিং করে সরানো হয়েছে। ৭. তনু নামের একজন তরুণী সেনানিবাসের নিরাপদ এলাকায় নিহত হয়েছে। ৮. বাঁশখালীতে চরম সংঘাতপূর্ণ অবস্থায় চারজন নিহত। ৯. এবার মিলিয়ে দেখা যাক এ প্রসঙ্গে বিএনপি, ওলামা লীগের সদ্য প্রদত্ত বক্তব্যগুলো : ক.খালেদা বলেছে – হাসিনা হীন নির্বাচন হবে এবার। খ.বিএনপির এক নেতা বলেছেন- এবার বিএনপির আন্দোলন ভয়াবহ ঝড় হয়ে আসবে। গ.ওলামা লীগ বলেছে- বাংলা নববর্ষ ইসলামবিরোধী, এটা বন্ধ করতে হবে। এমনকি নববর্ষের উৎসব ভাতা বন্ধ করতে হবে। এরই মধ্যে খুন হয়েছে মুক্তমনা ব্লগার নাজিম উদ্দীন। এখন দেখা যাচ্ছে উপরোক্ত সব ঘটনা- ঘোষণা, বক্তব্য একত্রে একটি লক্ষ্যকেই প্রকাশ করে। যা হচ্ছে- আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারের অগ্রযাত্রা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে বন্ধ করা এবং শেষ পর্যন্ত অব্যাহত অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে বর্তমান সরকারের পতন ঘটানো। সরকার নিশ্চয় উপলব্ধি করেছে- আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছে শত্রুর দল। তারা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ধ্বংস, সরকারের কৃতিত্ব ম্লান করে জনমানুষের রোষ সৃষ্টি করতে তৎপর। যারা মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালী সংস্কৃতিবিরোধী মৌলবাদী, কট্টর জেহাদী জঙ্গী, তাদের দ্বারা সারাদেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতিবিরোধীরা ওইসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। তারা প্রকৃতপক্ষে খালেদা-তারেকেরই অনুসারী, পাকিস্তানী উগ্র জঙ্গী জেহাদীপন্থী, যারা কোনক্রমেই বাঙালীর মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক মৌল চেতনা এবং বাঙালীর স্বদেশজাত সংস্কৃতি- পহেলা বৈশাখ, হালখাতা, নবান্ন, পৌষপার্বণ, বসন্ত উৎসব, মেলা, যাত্রাপালা, অভিনয়, সঙ্গীত, নৃত্য, বাদ্যবাজনা- এসব গ্রহণ করে না, বরং বিজাতীয় ভেবে ঘৃণা করে। এই ঘৃণারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে তথাকথিত ওলামাদের ‘লীগ’-এর মোল্লারা। সরকারপ্রধানসহ সরকারের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গ অবশ্যই অবগত আছেন যে, সাপের মাথায় হাত বুলিয়ে সাপকে বশীভূত রাখা যায় না। সাপ তার চরিত্র দুধ-কলা খেয়েও বদলায় না। এমন প্রবচন ব্যবহার করে অনেক আগেই বিদ্ব্যজ্জনেরা আমাদের সাবধান করে গিয়েছেন। এখন তো প্রকাশ্য হয়ে গেল যে, কাক ময়ূরের পাখনা পরে ময়ূরের দলে ঢুকেছিল, প্রকৃতপক্ষে তারা যে ময়ূর নয় তা তাদের এই বাংলা নববর্ষবিরোধী বক্তব্যই প্রমাণ করে দিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই এখন তারা আত্মস্বীকৃত বাঙালীবিরোধী। যারা বাঙালীর সংস্কৃতিকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ, উন্নত, স্বনির্ভর, তথ্য-প্রযুক্তি-জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ নির্মাণে শত সহস্র ক্ষেত্রে দু’হাতে কাজ করে চলেছে, অবদান রাখছে, তাদের আরও একবার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নামতে হবে, যার কোন বিকল্প নেই। সরকারকেও নিজ অস্তিত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব ধর্মের জনগোষ্ঠী রক্ষার্থে এখনই দ্রুত কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেগুলো হতে পারে এমন- ১. বাঙালীর ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধিতা হিসেবে গণ্য করে প্রস্তাবিত মুক্তিযুদ্ধ সুরক্ষা আইনটিকে আরও সম্প্রসারণের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ২. যারাই বাঙালীর নববর্ষের বিরোধিতা করেছে তাদের জাতির শত্রু গণ্য করা হবে না কেন- এ মর্মে আদালতে একটি রিট করবে বাঙালী সংস্কৃতি চর্চারত জোট। ৩. সরকারকে দ্রুততার সঙ্গে যেসব এলাকায় হিন্দু, আদিবাসী, হরিজনসহ সংখ্যালঘুরা হামলা, হত্যা, জায়গা-জমি দখল, ধর্ষণ ও জীবিকা ধ্বংসের শিকার হচ্ছে, সেসব এলাকার সাংসদদের নিয়ে একটি ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা কমিটি’ গঠন করতে হবে। বিশেষ করে ফরিদপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, সাতক্ষীরা, সিলেট, পিরোজপুরসহ আক্রান্ত জেলাগুলোয় শান্তি স্থাপন ও সংখ্যালঘুদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সাংসদদের দিতে হবে। এসব জেলার সংখ্যালঘুদের অবস্থা মাসিক ভিত্তিতে মনিটরিং করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রশাসনিক বিভাগ থেকে। ৪. দেশে অব্যাহত সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে একটি ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে। এর মাধ্যমে অন্তত আক্রান্তরা আইনী সহায়তা লাভ করতে পারবে। এ ছাড়া, সাংসদরা সমাজে সংখ্যালঘুর প্রতি মানবিক হবার আহ্বান জানিয়ে স্থানীয় তরুণদের নিয়ে মাঝে মাঝে সভা-মিছিল করবেন। এই থিমকে ব্যবহার করে সংস্কৃতিসেবীরা রেডিও, টিভিতে ছোট ছোট নাটিকা প্রচার করবেন। মসজিদের ইমামদের সংখ্যালঘু সুরক্ষা বিষয়ে ধর্মীয় নির্দেশনা প্রচার ও শুক্রবারের খুতবায় বয়ানের ব্যবস্থা করতে হবে। ৫. সরকারের দুটি কর্তব্য সম্পাদন করে সংখ্যালঘু হত্যা, নির্যাতন এবং মুক্তচিন্তক তরুণদের হত্যা বন্ধ করতে পারে। প্রথমত, ২০০১-এর সংখ্যালঘু নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ এবং আওয়ামী লীগারদের ওপর হামলা, খুনের ওপর প্রণীত অনুসন্ধানী, তথ্য-গবেষণাভিত্তিক প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ঐ অপরাধীদের গ্রেফতার ও বিচার করে জনগণকে জানাতে হবে যে, সরকার সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার বিষয়ে এবং আক্রান্তের ন্যায়বিচার লাভে কোন আপোস করে না। সরকারকে দেশে ও বিদেশে অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, মুক্তচিন্তকদের একজনের হত্যার বিচার এখনও পর্যন্ত হয়নি, যে কারণে জঙ্গী উগ্রবাদীরা নিশ্চিন্তে একের পর এক তাদের তালিকা ধরে অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গঠনে ব্রতী তরুণদের হত্যা করে চলেছে, যা সরকারের জন্য খুবই অপমানজনক এবং যা সরকারের অর্থনৈতিক, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। সত্যি কথা বলতে গেলে- কিছু কূপম-ূক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চায় না। আমাদের তরুণ সমাজ তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, তাদেরকে সরকার নিরাপত্তা না দিয়ে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করতে বলছে। সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- এই বৈশাখী নববর্ষকে ঘিরে আমাদের গ্রামবাংলার কারুশিল্পী, কুটির শিল্পী, তাঁতশিল্পী, কামার, কুমারের তৈরি খেলনা, তৈজসপত্র, বাঁশ-বেত-কাঠ-মাটির জিনিস ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে দেশজুড়ে যে ব্যবসা-বাণিজ্য হয় সেটি শহর ও গ্রামের সবরকম পেশাজীবীদের আয়-উপার্জনের একটি বড় উৎসে পরিণত হয়েছে। এটি একটি শ্রেণী যারা খেজুর গাছ আর মরুভূমির দেশের দিকে তাকিয়ে থাকে, অথচ নিজ দেশের পাশের বাড়ির হিন্দু, আদিবাসীর দিকে ফিরেও তাকায় না, তারাই বাংলা নববর্ষ ও বাঙালীর সংস্কৃতিকে অপছন্দ করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে- এতে কোন সন্দেহ নেই। বরং তারা বারবার তাদের এ রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান প্রকাশ করছে। সরকারকে তাদের রাষ্ট্রের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থানের জন্য বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তবেই রাষ্ট্রের সংস্কৃতিবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে। ভবিষ্যতে বাঙালী সংস্কৃতির ওপর কোন আঘাত এলে জনগণ এ ‘আত্মস্বীকৃত’ বাঙালী সংস্কৃতিবিরোধী এবং অন্য ধর্ম বিদ্বেষীদের চিহ্নিত করবে অতি সহজে এবং উপযুক্ত পন্থায় মোকাবেলা করবে- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্মর্তব্য, বাঙালী সংস্কৃতির চর্চা বাংলার স্থানীয় আদি ধর্ম সনাতন থেকে উৎসারিত এবং যে সংস্কৃতি বাঙালীকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একসূত্রে গেঁথে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে।
×