ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

পিএইচডি ডিগ্রিধারী গবেষক, পর্যটক এবং দই বিক্রেতা

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১৩ এপ্রিল ২০১৬

পিএইচডি ডিগ্রিধারী গবেষক, পর্যটক এবং দই বিক্রেতা

ড. চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে আমার পরিচয় বিস্ময়করভাবে। আমি তাকে চিনেছিলাম একজন দেশি মিষ্টান্ন বিক্রেতা হিসেবে। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী (মানিক) তাকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। লন্ডনের ইস্ট এন্ডে আমাদের একটি সভা হচ্ছিল। তাতে বিচারপতি শামসুদ্দীনও ছিলেন। তিনি বললেন, “গাফ্ফার ভাই, আজ আপনাদের এমন দই খাওয়াব যা কোনোদিন খাননি।” ভেবেছিলাম কোনো দোকান থেকে দই কিনে এনে খাওয়ানো হবে। কিন্তু আমাদের সভায় দইয়ের ভাঁড় নিয়ে এক ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন। চল্লিশোর্ধ বয়স। দেখলে মনে হয় আরও কম। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। চোখে চশমা। চোখে মুখে শিক্ষা ও সুরুচির ছাপ। দেখে দই বিক্রেতা বলে মনে হলো না। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেই তাকে মানায়। তখন আর মনের বিস্ময় প্রকাশ করিনি। তার দই খেয়েও বিস্মিত হয়েছি। বড় কয়েকটি মাটির ভাঁড়ে তিনি দই নিয়ে এসেছিলেন। সম্পূর্ণ সাদা দুধের রঙ। কোনো রঙ মেশানো হয়নি। স্বাদ অতুলনীয়। বিলাতে বসে এমন চমৎকার দেশি দই খাব তা কোনোদিন ভাবিনি। সেদিন সভায় সকলের কাছেই দইওয়ালার কদর বেড়ে গেল। ভবিষ্যতে এই দই আরও খাব তা ভেবে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার দোকান কোথায়? তিনি বললেন, আমার দোকান নেই। তবে মিষ্টি তৈরির কারখানা আছে। আমি দেশি করিগর দ্বারা সব রকম দেশি মিষ্টি তৈরি করি এবং লন্ডনসহ বিভিন্ন শহরে সাপ্লাই দেই। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইস্ট এন্ডের ব্রিক লেনের দোকানগুলোতে তার দই পাব কিনা! তিনি বললেন, তা পাবেন। এই দই আপনার ভালো লেগেছে? বললাম, খুবই ভালো লেগেছে। বাজারের দই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। চিত্তরঞ্জন দাস বললেন (তখনও জানি না তার নামের আগে ডক্টরেট লাগানো আছে) আমার দইয়ের জন্য আপনাকে ভাবতে হবে না। এই দই আপনার বাসায় মাঝে মাঝে পৌঁছে দেব। আমি রসগোল্লা, চমচম, অমৃত, জিলিপিসহ সব রকম মিষ্টি বানাই। আপনাকে তাও দেব। তাকে বলেছি, আমি ডায়াবেটিক। মিষ্টি খাওয়া বারণ। তিনি বললেন, “ডায়াবেটিকদের জন্য স্পঞ্জের রসগোল্লা বানাই। আপনাকে সেই রসগোল্লা দেব।” ড. দাসের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। এই পরিচয়ের আড়াল থেকে সহসাই একদিন একজন উচ্চশিক্ষিত, আইনবিদ, সাবেক অধ্যাপক ও বিশ্ব পর্যটক বেরিয়ে আসবেন তা ভাবিনি। এটা সেই রূপকথার রাজকন্যার ব্যাঙ স্বামীর হঠাৎ সুদর্শন রাজপুত্রের মতো বেরিয়ে আসা যেন। পরিচয়ের বেশ কিছুদিন পর পূর্ব লন্ডনের ডকল্যান্ডে ‘মেম সাহেব’ রেস্টুরেন্টে এক সভায় যাব। আমাকে সভায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল আমার সদ্য পরিচিত এই ‘দইওয়ালার’ উপর। তিনি তার গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে আমাকে নিতে এসেছিলেন। পথে যেতে যেতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার পরিচয় জেনে নিয়েছিলাম। তিনি দ্বিধা করছিলেন। কিন্তু আমার তাড়ায় শেষ পর্যন্ত না বলে পারেননি। তিনি অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে তার লেখা একটি বই আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। দেখি তাতে তার নাম লেখা ড. চিত্তরঞ্জন দাস। পিএইচডি ডিগ্রিওয়ালা একজন দই বিক্রেতা। বিস্ময়ের ঘোর ভেঙে তার পরিচয় আরও ভালো করে জানতে দেরি করিনি। ড. চিত্তরঞ্জন দাসের জন্ম ১৯৫৭ সালে যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি ইউনিয়নের কোমরপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে ১৯৮২ সালে এলএলবি, অনার্সসহ এলএলএম, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএম থেকে ১৯৯২ সালে “হিউম্যান রাইটস, কন্ডিশন ফর পীস, স্ট্যাবিলিস্ট এ্যান্ড ডেভলপমেন্টÑ এ কেস স্টাডি অব বাংলাদেশ” বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে বাংলাদেশের বহু উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনে পূর্ব তিমুরে এবং তানজানিয়ায় উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন। এখানেই ড. দাসের পরিচয় শেষ নয়। ২০০৩ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে ফোর্সড মাইগ্রেসনের উপর উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকার বেসরকারী কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের প্রধান হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। এক সময় লন্ডনের সিনাজি বিজনেস কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। সুদানের আলফাসের বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-কালীন অধ্যাপক ছিলেন। বিশ্বের ৪৫টি দেশ তিনি ভ্রমণ করেছেন। বর্তমানে ব্রিটিশ নাগরিক এবং লন্ডনের বাসিন্দা। পেশায় মিষ্টান্ন শিল্পের মালিক এবং গবেষক ও গ্রন্থকার। মানবাধিকার সম্পর্কে লেখা একটি ইংরেজি বইসহ তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচটি। দেশ দেশান্তর (প্রথম খ- থেকে তৃতীয় খ-) এবং সদ্য প্রকাশিত বইটির নাম ভিক্টোরিয়া থেকে নায়াগ্রা। ড. দাসের বাংলা বইগুলোর ভূমিকা লিখেছেন বাংলাদেশের আরেক প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সুশান্ত সরকার। বিস্মৃতপ্রায় কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারকে নিয়ে লেখা তার গবেষণামূলক এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লেখা নতুন দৃষ্টিভঙ্গির বই দু’টি আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি ড. দাসের বইগুলোর ভূমিকা লিখে তার লেখার বৈশিষ্ট্য, শুধু পর্যটকের চোখে নয়, গবেষকের চোখে দেখা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভূচরিত্র ও মানব চরিত্র অঙ্কনে পারদর্শিতা এবং তার ভাষা ও বর্ণনাশক্তির চমৎকারিত্ব তুলে ধরেছেন। ড. দাসের তিন খ-ের দেশ দেশান্তর বই পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, এমন ধরনের ভ্রমণকাহিনী আগে আমি খুব কম পড়েছি; যাতে আছে দেশ বিদেশের নানা অজানা কথার সঙ্গে সেখানকার প্রকৃতি, নাগরিক চরিত্র এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অতুলনীয় চিত্র। দেশ বিদেশে আমরা অনেকেই ঘুরি। কিন্তু আমাদের ক’জনের দেখার চোখ ও জানার মন আছে। শুধু দেখলে এবং জানলেই হবে না; সেটিকে সাহিত্যরসে জারিত করে পাঠকের কাছে হাজির করা এবং পাঠক মনকে রঞ্জিত করা কম আয়াসসাধ্য কাজ নয়। আমার বলতে দ্বিধা নেই, দেশ দেশান্তরের তিন খ-েই আমি ভ্রমণকাহিনীর সঙ্গে ছোট গল্পের মতো নানা কাহিনী এবং নানা দেশের নানা চরিত্রের কথা জেনেছি। এই চরিত্রগুলো ড. দাস অত্যন্ত নিপুণভাবে এঁকেছেন। আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে ড. চিত্তরঞ্জন দাসের বইতে ভূগোলের সাথে ইতিহাসের অপূর্ব মিশ্রণ এবং বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্নতা তুলে ধরার নিপুণতা দেখে। আমেরিকা থেকে পর্তুগাল, সুদানসহ অসংখ্য দেশ তিনি ঘুরেছেন। শুধু দেশগুলোর ভূ-প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, মানুষগুলোর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, সামাজিক অবস্থান বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং তার চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। ক্রিটিকের চোখে নয়, একজন মানব দরদীর চোখে তিনি তার দেখা দেশগুলোর ভালো মন্দ দুই দিক দেখার চেষ্টা করেছেন এবং তার জীবন্ত বর্ণনা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। তার বইগুলো পড়ার সময় আমার মনে হয়েছে, কোনো ভ্রমণকাহিনী পাঠ করছি না, যেন নিজেই দেশগুলো ভ্রমণ করছি। তার হেনরি, শুভ্র প্রভৃতি চরিত্র যেন আমার নিজেরই পরিচিত চরিত্র। আমি ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম। এখনও ইতিহাস পাঠে অনাবিল আনন্দ পাই। ড. দাসের বইগুলো মূলত ভ্রমণকাহিনী। কিন্তু প্রত্যেকটি দেশের ইতিহাস- বিশেষ করে রাজনৈতিক ইতিহাসও তাতে রয়েছে। আছে কোনো কোনো দেশের উপনিবেশ বিস্তারের ইতিহাস। কোনো কোনো দেশের সামাজিক উত্থান-পতনের বিবরণ। আছে এসব দেশের মানুষের চমৎকার মানবিক চরিত্রের দিকগুলো। আবার তাদের মন্দের দিকগুলোও লেখক সংবেদনশীল মন নিয়ে দেখেছেন। মাঝে মাঝে তার লেখায় উপন্যাসের স্বাদ পেয়েছি। বহিরাগত সম্প্রদায় হিসেবে বহু দেশেই এখন বাঙালীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের ভালো মন্দ চরিত্রের চিত্রণও রয়েছে তার লেখায়। পর্তুগালে বাঙালী বহিরাগতদের জন্য ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় করা বা নাগরিকত্ব পাইয়ে দেয়ার নাম করে বহু ভুয়া বাঙালী প্রতিষ্ঠান অসহায় বাঙালীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের পথে বসায়। এই একই কাহিনী ব্রিটেনসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশেও জানা যাবে। ড. দাসের দৃষ্টিতে তা অত্যন্ত ভালোভাবে ধরা পড়েছে। আমাদের দেশে গাড়ি দুর্ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই মানুষের জীবন নিয়ে এমন হেলাফেলা খেলা হয় না। সে কথাও তিনি লিখেছেন। তিনি উদাহরণ দেখিয়েছেন, “ব্রিটেনে ভারি কোনো যানবাহন চালাতে গেলে একটা বিশেষ ক্যাটাগরির ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগে। আর মোটরওয়েভে সর্বোচ্চ ৬০ মাইলের অধিক গতিতে এসব ভারি যানবাহন চালানো যায় না। তদুপরি একটানা ২ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর ৩০ মিনিট বিশ্রাম নিতে হয়। এই নিয়ম মেনে চালক গাড়ি চালাচ্ছে কিনা সেটা মনিটর করার জন্য গাড়িতে এক ধরনের মনিটরিং ডিভাইস লাগানো আছে।... পুলিশ যে কোনো সময় রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে এসব তথ্য যাচাই বাছাই করে এবং ব্যতিক্রম কিছু পেলে চালককে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। আর আমাদের দেশের দূরপাল্লার বাস ড্রাইভাররা একটানা কত ঘণ্টা গাড়ি চালান সে প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর।” ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আইনের শাসন, নিয়মশৃঙ্খলা এবং জননিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা আমাদের দেশে কতটা অনুপস্থিত তার বহু বিবরণ ড. দাসের বইতে রয়েছে। এক কথায় তার বইতে এমন কাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন দেশের ইতিহাস, ভূগোল, নাগরিক চরিত্র ও সামাজিক অবস্থার বৈশিষ্ট্য এবং আমাদের দেশের সঙ্গে তার পার্থক্যের বিবরণটি বিশদভাবে জানা যায়। কিন্তু তার লেখা এতোটাই সাহিত্যের রসাশ্রিত যে, তা একটানা পাঠেও ক্লান্তি আসে না। পরিচয় হওয়ার পর আমি ড. চিত্তরঞ্জন দাসকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ হয়ে তিনি বিভিন্ন উচ্চপদের চাকরি এবং অধ্যাপনা ছেড়ে কেন লন্ডনে মিষ্টান্ন বিক্রির কারখানা খুলে বসলেন। বললেন, এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও শখ মেটাতে মিষ্টির ব্যবসায় নেমেছিলাম। এখন দেখছি সেটাই আমাকে লাভের মুখ দেখিয়েছে। এই ব্যবসাটার জন্য আমি লন্ডনে স্থিতিশীল হতে পেরেছি এবং লেখাপড়া ও সমাজ সেবার কাজে সময় দিতে পারছি। ড. দাস এখন গবেষণামূলক বই লিখছেন এবং সেই সঙ্গে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-েও জড়িত। তার স্ত্রী উচ্চশিক্ষিত এবং তার সন্তানেরাও। আমি ড. চিত্তরঞ্জন দাসের মধ্যে দু’জন বাঙালী মনীষীর নামের ও কাজের মিশ্রণ দেখি। গত শতকের অবিভক্ত বাংলায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ছিলেন বাঙালীর এক মহানায়ক। আমাদের দই বিক্রেতা ড. চিত্তরঞ্জন দাসের নামের সঙ্গে দেশবন্ধুর নামের মিল রয়েছে। অন্যদিকে আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন একজন বিজ্ঞানের সাধক ও শিক্ষাবিদ। তিনি দেশী সাবান, দাঁতের মাজন, চুলের তেল ইত্যাদি তৈরি করে বেঙ্গল কেমিক্যাল নামে বিরাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছিলেন। আমাদের সাহিত্যানুরাগী ড. চিত্তরঞ্জন দাসও একজন গবেষক, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ হয়েও লন্ডনে একটি দেশী মিষ্টি দ্রব্যের বিরাট ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। তার সাহিত্যানুরাগের সঙ্গে ব্যবসা-অনুরাগ তাকে বিলাতে বাঙালী কম্যুনিটির কাছে এক নতুন প্রতিষ্ঠা দান করেছে। লন্ডন ১০ এপ্রিল, রবিবার ২০১৬
×