ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের আবাহনে বৈশাখ

প্রকাশিত: ০৭:১১, ১২ এপ্রিল ২০১৬

তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের আবাহনে বৈশাখ

‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ পুরনো বছরের সব গ্লানি, অপ্রাপ্তি, বেদনা মুছে দিয়ে জীবনে নতুন সম্ভাবনার শিখা জ্বালাতে আবার এসেছে পহেলা বৈশাখ। একটি নতুন দিন, একটি নতুন বছরের শুভ সূচনা। স্বাগত ১৪২৩। বাঙালীর নিজস্ব সংস্কৃতি ও গর্বিত ঐতিহ্যের রূপময় ছটায় উদ্ভাসিত সর্বজনীন উৎসবের দিন বৈশাখ। নব প্রভাতে জাতির কায়মনে প্রার্থনা, যা কিছু ক্লেদ, গ্লানি, যা কিছু জীর্ণ-শীর্ণ-বিদীর্ণ, যা কিছু পুরনো জরাগ্রস্ত- সব বৈশাখের রুদ্র দহনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় এই দিনে। আনন্দ-উৎসব আর উচ্ছ্বাস-উষ্ণতায় পুরো জাতি এই দিনটিতে নতুন করে বরণ করে নেবে। সবার হৃদয়ে আজ রবীন্দ্র-নজরুলের সুর জেগে উঠবে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’ কিংবা ‘...ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখী ঝড়, তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’ কল্যাণের সানাই বাজাতে বাজাতেই আগমন ঘটে বৈশাখের। মুখরিত হয়ে ওঠে যুগযুগান্তের ধারায় বয়ে চলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। মেতে ওঠে চারুকলার বকুলতলা, টিএসসি, কলাভবন, স্বোপার্জিত স্বাধীনতাসহ পুরো শিক্ষাঙ্গন। বৈশাখের মধুর ক্ষণে পুব আকাশে সূর্য উঁকি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা আর সুরে সুরে ধ্বনিত হয় মঙ্গলবার্তা। আর মঙ্গলের আহ্বানে সাড়া দিতে বাঁধভাঙা জোয়ারে মানুষ আঁছড়ে পড়ে শহর-বন্দরসহ প্রতিটি জনপদে। রাজধানীজুড়েও সৃষ্টি হয় এক অভূতপূর্ব মিলনমেলার। ভোরে রমনা বটমূলে ছায়ানটের সুরের আহ্বান আর নানা আনন্দ-উৎসবে সারা দিনই ব্যস্ত থাকে রাজধানীর মানুষ। আর পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া, গানবাদ্য সবকিছুতেই প্রাধান্য পায় বাঙালীয়ানা। আড্ডা, আমন্ত্রণ, উচ্ছ্বাসে উৎসবমুখর জাতি কাটায় দিনটি। পীড়াদায়ক তাপদাহ তুচ্ছ করে, অস্বস্তি উপেক্ষা করে ভোর থেকে দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা পেরিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলে বৈশাখবরণ। সকালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের সুরের মঙ্গলবার্তা দিয়ে শুরু হয় দিনের কর্মসূচী। ঢাবির ঐহিত্যবাহী চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দিতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। সকাল ৮টায় চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতি কামনা করে অন্ধকারের ঘোর কাটিয়ে জ্বলে উঠুক আলোর ধারা। পুরো শোভাযাত্রায় শোভা পায় বাঙালীর প্রিয় যত রং আর ঢং। আকুল করা প্রাণে হাজার হাজার মানুষের মুখে মুখে রঙের প্রলেপ। ঢাক-ঢোল, একতারা আর তালপাখার ছবি। সেদিন সারাদিনই রাজধানীজুড়ে বসে তারুণ্যের মেলা। কান পাতলেই শোনা যায় ঢাকের শব্দ, ঢোল, বাঁশি, নাগরদোলায় ঘূর্ণনের সঙ্গে উচ্ছ্বসিত তরুণ-তরুণীর উন্মাদনা। মেলায় বিক্রি হয় দেশীয় লোকজ হস্তশিল্প আর কুটিরশিল্পের বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে মণ্ডা-মিঠাই, মুড়ি-মুড়কি। হিড়িক পড়ে বাতাসার স্বাদ গুহণের। সারাদিন উৎসবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো ছাড়াও ঐদিন বাঙালীর ঘরে ঘরে থাকে নববর্ষের নানা আয়োজন। তার সঙ্গে পান্তা-ইলিশের স্বাদ উৎসবে যোগ করে ভিন্নমাত্রা। এছাড়া সারাদেশের ব্যবসায়ীরা পালন করেন হালখাতা। পুরনো হিসাব শেষ করে তারা তাদের হিসাবের খাতা খোলেন নতুন করে। ক্রেতাদের করান মিষ্টিমুখ। বকুলতলায় চলে ভিন্নধারার গানের উৎসব। কবিগুরুর ‘এসো হে বৈশাখ থেকে শুরু করে এই সময়ের তারুণ্যের গান, কিছুই বাদ যায় না। তারুণ্যনির্ভর বৈশাখের উচ্ছ্বাস চলে সারাদিন। তারুণ্যের এই বাঁধভাঙ্গা ঢেউ ছুঁয়ে যায় টিএসসি, বাংলা একাডেমি, চারুকলার বকুলতলা, পলাশী, নীলক্ষেত, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শহীদ মিনার হয়ে ফুলার রোডের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। বৈশাখের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। এ মেলায় পাশেই চারুকলা চত্বরের মূল স্টেজে চলে মঞ্চ নাটক, জারি-সারি, মুর্শিদী, ভাটিয়ালীসহ ভক্তিরসের গান, দেশপ্রেম, লোকগীতি, কবিতা পাঠ ছাড়াও বিভিন্ন লোকজসঙ্গীত। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় কনসার্ট। শুধু চারুকলা চত্বরের মেলাই নয়, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে বসে নানা প্রকার, নানা আকার, নানা ঢঙের পিঠা প্রদর্শনী। এছাড়া মাটির গহনা, বিভিন্ন অলঙ্কার, শাড়ি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, মুখোশসহ শিক্ষার্থীদের হাতের তৈরি ও নক্সা করা বিভিন্ন জিনিসপত্র এদিন প্রদর্শন ও বিক্রি করা হয়। বৈশাখ মানেই যেন মেলা। বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেলা শুরু হয়ে যায়। কোন কোন জায়গায় এই বৈশাখী মেলা মাসব্যাপী হয়। এই মেলাতে নানা প্রকারের দেশীয় মিষ্টান্ন, নারিকেল মুড়কিসহ আরও অনেক সুস্বাদু খাবারের দেখা মেলে। প্রতিবছর বাংলাদেশের চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে বসে ঐতিহাসিক জব্বারের বলী খেলা। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লাঠি খেলা, নৌকাবাইচ প্রভৃতি খেলা হয়। কী গ্রাম কী শহর সর্বত্রই সৃষ্টি হয় অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য। আনন্দে মাতে পুরো দেশের তারুণ্য। পহেলা বৈশাখের বেশ কিছুদিন বাকি থাকতেই শুরু হয় এর প্রস্তুতি। বৈশাখ এলেই গায়ে ওঠে পাটভাঙা তাঁতের শাড়ি। লাল ও সাদা তো থাকবেই, সঙ্গে থাকতে হবে অন্যান্য রং। কিংবা অন্য কোন রঙের শাড়িতে সেজে কপালের টিপ আর হাতের চুড়িটা সবাই লাল পরবেন। বৈশাখকে ঘিরে তরুণদের চাহিদার মধ্যে রয়েছে পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বৈশাখী শার্ট, গামছাসহ কিছু নতুন ও ব্যতিক্রমী প্রসাধনী সামগ্রী। ফতুয়ায় বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী ঢোল, একতারার ডিজাইনগুলো এবার কিছুটা ব্যতিক্রম ও নজরকাড়া। আর সেদিকেই ঝুঁকছেন অধিকাংশ ফ্যাশন সচেতন তারুণ্য। শুধু এই দিনটিতে নয়; বরং প্রাণের টানে আর নিজের ঐতিহ্যের গর্বে নিজস্ব চেতনায় আপনি বাঙালীয়ানাকে ছড়িয়ে দিতে পারেন আপন ঐশ্বর্যে। তবে ছাত্ররাই অর্থাৎ তরুণেরাই সমস্ত পুনর্জাগরণের রূপকার। তারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে, চারুকলাকে কেন্দ্র করে বাঙালী সংস্কৃতির প্রেরণাসঞ্চারি, আলোকিত আর অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রটিকে বর্ষবরণ উৎসবের কেন্দ্রে নিয়ে এলো। শুরু হলো মুখোশমিছিল, রমনা পার্কে ভোরের সঙ্গীতানুষ্ঠান। কালে কালে অনুষ্ঠানের সংখ্যা ও পরিধি বাড়ল। আজ তো দেখা যায়, সারা বাংলাদেশেই এই নতুন রূপের নববর্ষ উৎসব চলে সারাদিন ধরে। এই উৎসব হালখাতার মলাট থেকে, আমাদের পতাকা থেকে, গ্রীষ্মের কৃষ্ণচূড়া থেকে লাল রংটি নিল; সাদা নিল আমাদের পবিত্রচিন্তার প্রশান্তি থেকে। এখন বৈশাখের রং হচ্ছে তারুণ্যের লাল এবং পরিণত বয়সের সাদা; অথবা তারুণ্যের লাল এবং তার আলোকিত, স্থিতধি চিন্তার সাদা। বৈশাখ তার কড়ি ও কোমলে যে বৈপরীত্যকে মেলায়, লাল-সাদা সে রকম এক সমীকরণের ইঙ্গিত। সংস্কৃতির কথায় বাংলাদেশজুড়ে বর্ষবরণ উৎসবের প্রসঙ্গটি উঠে আসে। পয়লা বৈশাখে সারা বাংলাদেশে বর্ষবরণ হয়Ñ আড়ং হয়, মেলা হয়, হালখাতা খোলা ও মিষ্টিমুখ হয়, যেমন হয়েছে একশ’-দু’শ বছর আগেও। এই উৎসবটি ধর্ম-জাত-পেশা নির্বিশেষে সবার। বাংলাদেশ বরণ করবে বাংলা ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে। ১৪২২-এর অবসানে অনেকেই অতীতে ফিরে যাবে, হিসাব কষবে বছরজুড়ে নানা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির। তবে তারুণ্যকণ্ঠে প্রধানত প্রাধান্য পাবে আশা এবং উচ্ছ্বাস। তারুণ্যের জন্য এই আশা এবং উচ্ছ্বাস আজ নূতন করে রূপ নেয় সংকল্প এবং আত্মবিশ্বাসে। বৈশাখ আমাদের আত্মবিশ্বাস শেখায়, সংকল্পবদ্ধ হতে শেখায়। এই জীবন আবহমান বাংলার। বাংলার কৃষকের, বাংলার শ্রমিকের আর বাংলার তারুণ্যের এই হচ্ছে শক্তিশালী বৈশাখ যাপন বা বর্ষাযাপন। যে তরুণেরা আগামীতে কা-ারি হবেন দেশের ও জাতির, তাদের সকল শক্তি এবং সাহসের জন্য যেতে হবে বিশাল বাংলার মানুষের কাছে, বৈশাখে ঘর হারানো গৃহস্থের কাছে, শিলাবৃষ্টিতে ক্ষেত তছনছ হওয়া কৃষকের কাছে, মেঘনা অথবা সাগরে জাল ফেলা মৎস্যজীবী ও মাঝির কাছে। এই অর্জন টুকুর জন্য আমাদের জনজীবন, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসে তাকে ফিরতে হবে। তবে গর্বের বিষয় একটাই যে, পৃথিবীর আর কোন জাতি তার স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছরে এতগুলো উৎসবের নবায়ন এভাবে রঙের মধ্য দিয়ে, গানের মধ্য দিয়ে, সারা দিনের আরও নানা নৃত্যের মধ্য দিয়ে করতে পারেনি। আমরা পেরেছি। উৎসবপ্রিয় এই জাতি একদিন উৎসবের সংখ্যা, বৈচিত্র্য ও অভিঘাতের বিচারে সবাইকে হয়তো পেছনে ফেলে যাবে। তরুণরা যে এভাবে উৎসব আবিষ্কার বা পুনরাবিষ্কার করছেন, তার মূল কারণটি যদি কেউ শনাক্ত করতে চান, তাকে যেতে হবে দুটি সূত্রের কাছেÑ এর প্রথমটি তারুণ্যের স্বাভাবিক প্রাণশক্তি এবং দ্বিতীয়টি নতুনত্বের এই তারুণ্যের সহজাত সমর্থন ও নিষ্ঠা। বর্ষশেষ তো একটি নতুন বছরের আগমনীও বটে। বছরের পর বছর যদি নতুনের অভিযাত্রা অব্যাহত থাকে, যদি প্রতিটি বৈশাখে তারুণ্য গ্রহণ করে দিন-বদলের অঙ্গীকার এবং দিন-বদলের সংগ্রামে পথে নামে, তাহলে এই বাংলার দুঃখ-দারিদ্র্য, অপমান-লাঞ্ছনা শীঘ্রই অতীতের বিষয় হয়ে যায়।
×