ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যানজট লেগেই আছে ;###;মাসাধিককালের নিত্যদিনের চিত্র ;###;জলাবদ্ধতা নিরসনে এ পদক্ষেপ- সিটি কর্পোরেশন

মহাভোগান্তি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১২ এপ্রিল ২০১৬

মহাভোগান্তি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ আইল্যান্ডের এক পাশজুড়ে কাটা রাস্তা। গভীরতা প্রায় ১০ ফুট। রাস্তার ওপর রাখা আছে ইটের স্তূপ। জমানো বালু আর মাটির পাহাড়। কোথাও রাখা আছে বিশাল বিশাল পাইপ আর রড। রাতদিন চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সব মিলিয়ে মূল সড়কের অর্ধেকের বেশি অংশ ব্যবহারের অনুপযোগী। গাড়ি চলাচলে দুর্ভোগের শেষ নেই। দিন রাত আছে যানজট। পথচারী চলাচলেও অসুবিধা। এ চিত্র গুলশান দুই নম্বর এলাকার ৭১ নম্বর সড়কের। এ সড়ক থেকে গুলশান দুই নম্বর পর্যন্ত একই অবস্থা। দূর থেকে দেখলে এটি কোন রাস্তা বলে মনে হবে না। নতুন কোন সড়ক হয়ত নির্মাণ হচ্ছে! তাই এরকম অরাজক দৃশ্য! অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিতি গুলশানের এমন অবস্থা দেখে অনেকেই বিস্মিত। এরকম ভয়াবহ দৃশ্য প্রমাণ করে পরিকল্পনাবিহীন গড়ে উঠেছে এই নগরী। নগর পরিকল্পনাবিদরাও বলছেন একই কথা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, উন্নয়নের নামে এমন ভোগান্তি চলছে মাসাবধি। জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন নতুন ড্রেন নির্মাণের কাজ শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এ থেকেই ভোগান্তির যাত্রা শুরু। গুলশানের বেশিরভাগ এলাকার চিত্র এখন ঠিক এরকম। আর ভোগান্তি মাথায় নিয়েই প্রতিদিন চলতে হচ্ছে নগরবাসীকে। রাস্তা বন্ধ। সড়ক উন্নয়নের কাজ চলছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। আদেশক্রমে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এই হুকুমজারি চোখে পড়বে গুলশান ১ ও ২ নম্বর সড়কের বেশিরভাগ অংশে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, গুলশান এক নম্বর থেকে দুই নম্বর গোল চত্বর ছাড়িয়ে ইউনাইটেড হাসপাতাল সড়ক এলাকা অর্থাৎ পাকিস্তান হাইকমিশন ছাড়িয়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির দৃশ্য চোখে পড়ে। মূল সড়কের মাঝখানে ড্রেনের জন্য মাটি তোলা হচ্ছে। কোথাও রাস্তার একপাশে চলছে হরদম খোঁড়াখুঁড়ি। প্রতিটি গলি থেকে মূল সড়কের মাথায় রাস্তা কাটার দৃশ্য চোখে পড়ে। এ কারণে অনেক সড়ক দিয়ে এখন যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে নাগরিক ভোগান্তির মধ্যেও মূল সড়কটি চালু আছে। রাস্তা কাটাকাটির কারণে অনেক সড়কে গাড়ি বিকল হয়ে যেতে দেখা গেছে। গর্তের মধ্যে গাড়ি পড়ে যাবার মতো ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। সব মিয়ে দেড় শতাধিক গলিপথ ও মূল সড়ক একযোগে কাটা হয়েছে পুরো গুলশান ও বনানী এলাকাজুড়ে। নগরবিদরা বলছেন, রাজধানী ঢাকা এখন যানজটের মহানগরী হিসেবে পরিচিত। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই মহানগরীতে এখন চলাচল করাই দায়। যানজটের কারণে নিত্য ভোগান্তিতে অস্থির নগরবাসীর দুর্ভোগ আরও বাড়াতে এখন শুরু হয়েছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব। তা কবে শেষ হবে নিশ্চিত করে বলতে পারেন না সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরাও। নগর বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা নগরীতে এখন সেবা সংস্থাগুলোও পরিকল্পিতভাবে কাজ করে না। যার যখন প্রয়োজন বা খুশি তখনই রাস্তা কাটে, খোঁড়াখুঁড়ি করে। কোন সমন্বয় নেই। এমনও দেখা যায়, ওয়াসা রাস্তা খুঁড়ে সড়ক মেরামতের পরপরই একই সড়ক খোঁড়া শুরু করে অন্য একটি সেবা প্রতিষ্ঠান। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সড়ক উন্নয়নের কাজটি হয় একেবারেই ধীরগতিতে। কেটে-খুঁড়ে কাজ শেষ করার পর সড়ক মেরামত আর হয় না, পড়ে থাকে দীর্ঘদিন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, সমন্বয় করে কাজ করলে মানুষের ভোগান্তি কম হয়। নগরবাসীর ভোগান্তির বিষয়টি মাথায় রেখে উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাবার পরামর্শ দেন তিনি। গুলশান দুই এলাকায় মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজার বিপরীত দিকের রাস্তায় চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন প্রায় মাসাবধি চলছে রাস্তা কাটাকাটি। সেখানে সড়কের একপাশে দেখা গেল বিশাল গর্ত। দিনভর শ্রমিকদের হাকডাক। চলছে মাটি তোলার কাজ। গর্তের গভীরতা অনেক বেশি হওয়ায় কোথাও কোথাও মই দিয়ে মাটি তোলা হচ্ছে ওপরে। রাস্তার অন্য পাশে রাখা হয়েছে পাইপের সারি। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, মাটি কাটার কাজ শেষ হলে পাইপ নিচে নামানো হবে। তারপর বিশেষ ব্যবস্থায় জোড়া লাগানোর কাজ চলবে। এরপর গর্তে ফেলা হবে মাটি। এ কাজ শেষ হবার পর রাস্তা পাকার কাজ শুরুর কথা জানিয়েছেন তারা। দুই নম্বর থেকে এক নম্বর যেতে সড়কের বেশিরভাগ অংশে দেখা গেছে রাস্তা কাটার চিত্র। কোথাও ম্যানহোল থেকে মেশিন দিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। সেই পানি ফেলা হচ্ছে মূল সড়কে। সড়কে রাখা আছে নির্মাণ সামগ্রী। সড়কে বাঁধা হচ্ছে লোহার রড দিয়ে মাচা। যা পাইপের সংযোগস্থলে দেয়ার পর পাকা করা হবে। গুলশান-২ এর ফার্মার্স ব্যাংকের সামনের রাস্তাটি এতটাই বেহাল যে ব্যাংক থেকে বের হবার মতো উপায় নেই। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানালেন, রাস্তাটি দিয়ে গাড়ি চলাচলের কোন সুযোগ নেই। উন্নয়ন কাজ চলায় সব সময় যানজট লেগেই থাকে। অনেকে গাড়ি রাস্তায় রেখে পায়ে হেঁটে চলাচল করেন। দুই নম্বর এলাকার পাকিস্তান দূতাবাসের সামনের রাস্তা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বাসার সামনের রাস্তাটিও কাঁটা হয়েছে। ১২৩ নম্বর সড়কটি দিয়ে হেটে চলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহল্লা থেকে মূল সড়কে ওঠা মানেই বিলাশ ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। গোল চত্বরের উত্তরা ব্যাংকের সামনের রাস্তাটি ২৫ দিন ধরে কাটা হলেও কাজের গতি কম থাকার অভিযোগ করলেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ওয়েস্টিন হোটেলের সামনের দৃশ্যও বেহাল। গুলশান এক নম্বরের ১৩১ ও ১৩২ নম্বর সড়কের বাসিন্দাদের মুখে হাসি নেই। রাস্তা বন্ধ। তাই ব্যক্তিগত সহ সব ধরনের গাড়ি চলাচল বন্ধ। স্থানীয় বাসিন্দা কবির হোসেন জানান, দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে বাসা থেকে বের হতে হয়। রিক্সা চলাচলেরও উপায় নেই। কাজের গতি মন্থর হওয়ারও অভিযোগ করেন তিনি। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, অনেক সড়কের সামনে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সাইনবোর্ড দেয়া হয়েছে। এতে লেখা আছে- ‘রাস্তা বন্ধ। বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করুন। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। আদেশক্রমে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।’ এ প্রসঙ্গে গুলশান দুই সিটি কর্পোরেশন মার্কেটের ব্যবসায়ী আবুল হায়দার জানান, রাস্তার বেহাল অবস্থার কারণে ক্রেতা কমেছে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পণ্য বিক্রির লক্ষমাত্রা আগের বছরের তুলনায় তিনভাগের একভাগে নেমে এসেছে। তিনি জানান, গাড়ি চলাচলের অসুবিধার কারণেই ক্রেতারা আসেন না। ঠিকাদররা জানান, খোঁড়াখুঁড়ির কাজ যতটা সম্ভব রাতে শেষ করতে হবে। সেটা সম্ভব না হলেও রাস্তা খুঁড়ে মাটির স্তূপ করা যাবে না। কাজ শেষে রাস্তা পরিচ্ছন্ন করতে হবে, যেন পরদিন সকাল থেকেই স্বাভাবিক যান চলাচল করতে পারে। কিন্তু কথার সঙ্গে কাজের কোন মিল পাওয়া যায়নি। অনেক সড়কে ড্রেনেজ লাইন সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নগরীতে জলাবদ্ধতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে নির্বাচিত মেয়রদের। তাই জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় শুরু হয়েছে উন্নয়ন কাজ। যেসব এলাকায় বেশি জলাবদ্ধতা হচ্ছে সেসব এলাকায় পানি প্রবাহের লাইন সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। যাতে দ্রুত পানি নিষ্কাশন হয়। গুলশান এলাকার দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাস্তা কাটার আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কিংবা ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে তেমন একটা সমন্বয় হয় না। হঠাৎ করে উন্নয়ন কাজের জন্য রাস্তা কাটা হলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয়। অনেক রাস্তা বন্ধ রাখতে হয়। বিকল্প সড়ক ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করা কঠিন হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সাঈদ আনোয়ারুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী গুলশান এলাকায় নতুন পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ জুলাই মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য রোজার আগে অর্থাৎ মে মাসের শেষ দিকে সব কাজ শেষ করা। উন্নয়ন কাজের জন্য জনভোগান্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা মানসম্মত কাজ করার চেষ্টা করছি। এজন্য সবাইকে একটু ছাড় দিতে হবে। কয়েকদিন কষ্ট করলে দীর্ঘ সময় এর সুফল পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, মূল সড়ক থেকে অলি গলিতেও পাইপ লাইন সংযোগ দেয়া হচ্ছে। যাতে ভবিষ্যতে মূল সড়ক খুঁড়ে গলির লাইন স্থাপন করতে না হয়। পরবর্তীতে গলি পথে লাইন স্থাপন করা হবে বলে জানান তিনি।
×