ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বৈসাবি উৎসব

পাহাড়ী-বাঙালী মিলনমেলা উৎসব আমেজ

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১২ এপ্রিল ২০১৬

পাহাড়ী-বাঙালী মিলনমেলা উৎসব আমেজ

জিতেন বড়ুয়া ও মোহাম্মদ আলী ॥ পাহাড়ে এখন উৎসবের আমেজ। বৈসাবির চেতনায় উজ্জীবিত পাহাড়ী আবালবৃদ্ধ বনিতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের অন্যতম সামাজিক উৎসব বৈসু, সাংগ্রাই ও বিঝু (বৈসাবি) উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে দিতে সোমবার সকালে পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। হাজার হাজার পাহাড়ী-বাঙালীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে র‌্যালিটি হয়ে উঠে সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলায়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ নিজস্ব পোশাক, বাদ্যযন্ত্র আর বিলুপ্তপ্রায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নিয়ে নেচে, গেয়ে, বিচিত্র রংয়ে অংশ নেন। বিভিন্ন বয়সী মারমারা রঙিন ছাতায় পুরো র‌্যালিকে রাঙিয়ে দেয়। ত্রিপুরা কিশোর-কিশোরীদের ‘গরয়া নৃত্য’ ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। দৃষ্টি কাড়ে চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে অংশ নেয়া নারী-পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ততাও। পরিষদ কার্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহর পদক্ষিণ করে টাউনহল প্রাঙ্গণে গিয়ে শেষ হয়। এর আগে শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী। এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি সদর জোনের জোন কমান্ডার লেঃ কর্নের হাসান, পুলিশ সুপার মোঃ মজিদ আলী, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চুঞ্চুমনি চাকমা, পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ হাবিবুর রহমান, উপজাতীয় শরনাথী বিষয়ক ট্রাক্সফোস কমিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক এটিএম কাওছার আলম। বৈসাবি উপলক্ষে খাগড়াছড়ি এখন উৎসবমুখর পরিবেশে শুরু হয়েছে। এই উপলক্ষে পাহাড়ের ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে নানা বাহারি খাবারের আয়োজন। শহর গ্রাম নানা প্রান্তে চলছে আদিবাসীদের জুম চাষভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা-সাংস্কৃতিক আয়োজন। বাংলা বছরের শেষ দু’দিন এবং বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ অন্যান্য ১৩টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভিন্ন ভাষাভাষি জাতিসত্তা ঐতিহ্যবাহী উৎসব পালন করে থাকে। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই, চাকমাদের বিজু তিন দিনের প্রথাগত সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক আচার অনুষ্ঠান হলেও চলে সপ্তাহ ধরে। পাহাড়ে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে পুরানো বছরের কালিমা এবং নতুন বছরের শুভ কামনায় নতুন বারতা নিয়ে পাহাড়ী পল্লী মেতে উঠে আনন্দ উচ্ছ্বাসে। পাহাড়ের প্রতিটি ঘরের আঙ্গিনায় উৎসব আর উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসছে। চাকমাদের ফুল বিঝু, ত্রিপুরাদের ‘বৈষুমা বৈসুক’, মারমাদের ‘আল্লেনিহ’। নানা জাতের পিঠা, পুলি ঘরে ঘরে দিয়েছে উৎসবের নতুন মাত্রা। পাড়ায় পাড়ায় গৈড়িয়া নৃত্য, বোতল নৃত্য পরিবেশন করছে নানা বয়সের শিল্পীরা। অন্যদিকে বাড়ির বয়স্ক গৃহবধূরা গৈড়িয়া দেবতার উদ্দেশ্যে চাল, ধান, টাকা উৎসর্গ করে নতুন বছরকে কল্যাণের দিকে আনতে মাঙ্গলিক পূজা করছে। চাকমাদের ‘গর্যাপর্যা’, ত্রিপুরাদের ‘বিছিকাতাল বা আট্টদাং বৈসুক’, মারামদের ‘আছংনিহ্ সাংগ্রাই’ উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে মেতে উঠেছে কিশোর কিশোরী যুবা বুড়া সকলেই। বৈসাবি উপলক্ষে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও উন্নয়ন সংগঠন পাহাড়ী পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন করেছে নাটক, ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী ঘিলা খেলা, সুকুই খেলা, পত্তি খেলা, গদু খেলা, ধ-খেলা, ফোর খেলা, বেত দিয়ে কালোং তৈরি প্রতিযোগিতা। এছাড়া গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বলি খেলা, মাতৃ ভাষায় অনুবাদ প্রতিযোগিতা, বাঁশ ও পাতায় রান্নার প্রতিযোগিতা। এসব আয়োজনে মেতে উঠেছে নানা বয়সের মানুষ। চাকমাদের গেংখুলী, ত্রিপুরাদের গৈড়িয়া নৃত্য, বোতল নৃত্য, মারমাদের পানি খেলা উৎসবের আয়োজন চলছে। আগামীকাল বুধবার ভোরে নদীতে ফুল ভাসিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে পাহাড়ে বৈসাবি উৎসবের সূচনা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে বৈসাবি। যাকে বাংলায় চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে ধরা হয়। পুরাতন বর্ষকে বিদায় এবং নববর্ষকে স্বাগত জানানোর মধ্যে দিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব। পাহাড়ী জাতিসত্তাসমূহের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ঐক্যের প্রতীক। বৈসাবি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। এটি পাহাড়ীদের সবচেয়ে বড়ো পার্বন কাল। চৈত্রের শেষ দু’দিন এবং নববর্ষের দিন নিয়ে মোট তিন দিন পর্যন্ত পাহাড়ীদের ঘরে ঘরে এ উৎসব চলে। প্রতিবছর বৈসাবি আসে পাহাড়ীদের মাঝে আনন্দের বার্তা আর সোনালী স্বপ্ন নিয়ে। বৈসাবিকে কেন্দ্র করে ফুটে ওঠে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যম-িত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। তাই এটি পাহাড়ীদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। এটি পাহাড়ীদের সাংস্কৃতিক চেতনার উৎসস্থল ও সামাজিক সাম্যবাদের প্রতিফলন। রাঙ্গামাটির পাহাড়ে উপজাতীয়দের প্রাণের উৎসব বৈসাবি শুরু হয়েছে। উপজাতিদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি তিনদিনের হলেও মূলত এই উৎসবের নানা আয়োজন চলে সপ্তাহব্যাপী। পাহাড়ের চূড়ার ছোট জিন্ন কুটির থেকে শহরের উঁচু দালান পর্যন্ত সর্বস্তরে শুরু হয়েছে উপজাতিদের এই প্রধান সামাজিক উৎসবের আমেজ। রাঙ্গামাটিতে বর্ণাঢ্য নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিজু, সাংগ্রাই বৈসুক ও বিষু শুরু হয়েছে ৪ এপ্রিল থেকে। ওইদিন উষায় প্রাঙ্গণে রাঙ্গামাটিতে এ উৎসব শুরু হয়েছে সাংগ্রাই বৈসুক ও বিষু সাংস্কৃতিক মেলা দিয়ে। এছাড়া বৈসাবি উপলক্ষে শহরে বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করা হয় বৈসাবি উদযাপন কমিটির ও জেলা পরিষদের উদ্যোগে। চৈত্র মাসের শেষের আগের দিনকে বলে ফুল বিজু, এই দিনে পাহাড়ী মেয়েরা নদীতে ফুল ভাসায়। শেষ দিনে পাহাড়ীরা মূল বিজু পালন করে এদিন সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করে কাটায় পাহাড়ী জনপদের তরুণ-তরুণীরা, ঘরে ঘরে নিমন্ত্রণ আর আতিথিয়েতা গ্রহণের। সে এক অনাবিল আনন্দ। ওইদিন প্রতিটা পাহাড়ীর ঘরে ঘরে ঐতিহ্যবাহী খাবার পাঁচন ভোজন হয়। একের ঘরে অন্যরা গিয়ে আনন্দে মতোহারা হয়ে উঠেছে। অতিথিদের মাঝে ঐহিত্যবাহী খাবার ‘পাঁচন’ পরিবেশন আর একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া আসার মধ্য দিয়ে বৈসাবি উৎসব তার চিরায়ত ব্যঞ্জনায় রূপ লাভ করে। বহু প্রকার সবজি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই পাঁচন তৈরি করা হয়। যা অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পাহাড়ী বাঙালী সকলের জন্য অত্যন্ত প্রিয় থাবার। পাহাড়ীদের বিশ্বাস, এই পাঁচন খেলে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া একদিনে সাত পরিবারে এই পাঁচন খেলে সর্বরোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। বিজুর দিনে পাহাড়ীদের বাসায় পাহাড়ী-বাঙালী সবাই যায়। এদিন ফুটে ওঠে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। শেষের দিন ‘গজ্যাপজ্যা’ করে তাদের উৎসবের সমাপ্ত করে। এদিকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে রাঙ্গামাটিতে একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করা হবে। র‌্যালিতে শহরের সর্বস্তরের লোক অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ওইদিন জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বরে বৈশাখী মেলার আয়োজন করেছে। সেখানে পান্তা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
×