ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মহৎ আত্মত্যাগ

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ১২ এপ্রিল ২০১৬

মহৎ আত্মত্যাগ

শনিবার ৯ এপ্রিল সকালের ঘটনা। অকুস্থল বনানী রেলক্রসিং। চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর এক্সপ্রেস মহানগর-প্রভাতী দ্রুত বেগে অতিক্রম করছিল বনানী রেলস্টেশন। এ সময় রেললাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। পেছনে যে ধেয়ে আসছে মৃত্যুরূপী যন্ত্রদূত, সেদিকে প্রায় কোন ভ্রƒক্ষেপ ছিল না ব্যক্তিটির। মিজান নামের এক ব্যক্তির চোখে পড়ে দৃশ্যটি। বেখেয়ালি লোকটির আচার-আচরণে মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারেন যে, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি অন্ধ। অতঃপর অনেক ডাকাডাকির পরও রেল লাইন থেকে অন্ধ ব্যক্তিটিকে সরাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মিজান ঝাঁপিয়ে পড়েন তাকে বাঁচাতে। তবে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারাল মিজান। বাঁচাতে পারেননি অন্ধ ব্যক্তিটিকেও। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান দু’জনই। এভাবে অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিঃস্বার্থভাবে প্রাণ বিসর্জন দেয়া ব্যক্তিটির নাম মিজানুর রহমান। পঞ্চাশোর্ধ মিজানের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের কদমতলায়। বাড্ডা এলাকার ফুটপাথে একটি চায়ের দোকান চালান তিনি। এতদিন ‘অন্ধজনে দেহ আলো’-র কথা শোনা গেছে। এখন জানা গেল ‘অন্ধজনে দেহ প্রাণে’র কথা। ঘটনা সামান্য, তবে অসামান্য তার ব্যঞ্জনা। সময়ের সামান্য হেরফেরে হতভাগ্য মিজান অন্ধ ব্যক্তিটির প্রাণ বাঁচাতে পারেননি সত্য। তবে নিজের জীবন দিয়ে তিনি আরও একবার প্রমাণ করে গেলেন যে, ‘মানুষ মানুষের জন্য’। প্রসঙ্গক্রমে রাজধানীসহ সারাদেশের রেলক্রসিংগুলোর কথা বলা যেতে পারে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, অধিকাংশই অরক্ষিত। অনেক স্থানেই রেল ক্রসিংগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। সিগনালম্যান, নিরাপত্তারক্ষী তো দূরের কথা, নিরাপত্তা বেষ্টনী বলতে যা বোঝায় তা পর্যন্ত নেই। কোন কোন স্থানে থাকলেও তা প্রায়ই অকেজো ও অসম্পূর্ণ। সিগন্যাল ওঠাতে-নামাতে হয় হাত দিয়ে, তাও যদি রেলের লোক থাকে। তদুপরি শহর-বন্দর বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার রেলপথের দু’পাশে ক্রমাগত গজিয়ে উঠেছে বস্তি, হাট-বাজার, কলোনি, মাদকসেবীদের আখড়া, আড্ডাখানা ইত্যাদি। এসবের উচ্ছেদ নিয়ে প্রায়ই চলে চাপানউতোর খেলা। সকালে উচ্ছেদ করা হয় তো বিকেলেই বসে যায় বাজার। কলোনি উচ্ছেদ হয় তো বসে যায় বস্তি। রেলের জমি নিয়ে প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই চলছে ভাঙ্গা-গড়ার এই খেলা। কতবার কত পরিকল্পনা নেয়া হলো! শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হলো না কোনটাই। সবমিলিয়ে রেললাইন ও রেল ব্যবস্থা একরকম অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ থেকেই গেল। অবশ্য সবক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিñিদ্র ও নিরাপদ হবে এমন কোন কথা নেই। রেললাইন সুরক্ষায় নাগরিক দায়িত্বও কম নয়। প্রায়ই দেখা যায় যে, রেল যখন ক্রসিং অতিক্রম করে তখন সেদিকে আদৌ ভ্রƒক্ষেপ না করে পার হতে চায় পথচারী, সাইকেল আরোহী, হোন্ডাযাত্রী এমনকি প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস পর্যন্ত। সুতরাং দুর্ঘটনা ও জীবনহানি অনিবার্য। অন্যদিকে কানে সেলফোন লাগিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে তরুণ-তরুণীদের আনমনে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য তো সুপরিচিত। তবে সামান্য দরিদ্র চা বিক্রেতা মিজানের আত্মত্যাগটি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সে এক অন্ধ ব্যক্তিকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে বুঝিয়ে দিল জীবনের মূল্য।
×