ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়ি উদ্ধারে দায়বদ্ধতা সবার

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১২ এপ্রিল ২০১৬

সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়ি উদ্ধারে দায়বদ্ধতা সবার

সুচিত্রা সেনের বাবা ছিলেন করুণাময় দাশগুপ্ত। পাবনা শহরের বর্তমান পুরাতন পলিটেকনিকের সামনে হেম সাগর লেনের বাড়িতেই সুচিত্রার জন্ম। ১৯৮৭ সালে পাবনা জেলা প্রশাসন ইমাম গাজ্জালি ইনস্টিটিউট নামে একটি বেসরকারী গার্লস স্কুল এবং কলেজকে লিজ দেয় বাড়িটি। জামায়াতে ইসলামীর একটি ট্রাস্টি বোর্ড স্কুল ও কলেজটি পরিচালনা করত। এক সময় বাড়িটির আঙ্গিনায় নানা ফুল, নানা দামী গাছ ছিল। এখন আর সেগুলো নেই। সব কেটে সাবাড় করে খোলা অংশজুড়ে কয়েকটি টিনের ঘর তোলা হয়। ছাদ ভেঙ্গে টিনের চালা লাগানো হয়। বাড়ির প্রবেশপথ বন্ধ করে সড়কের ধারে তোলা হয়েছে দোকানঘর। প্রধান সড়ক থেকে আড়াল হয়ে গেছে বাড়িটি। জামায়াত পরিচালিত ইমাম গাজ্জালি ইনস্টিটিউট সরিয়ে বাড়িটি উদ্ধার করতে পাবনার সাংস্কৃতিক কর্মীদের অনেকদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়। প্রয়াত শফিকুল ইসলাম শিবলীর বাড়ির নিকটবর্তী সুচিত্র সেনের পৈতৃক বাড়িটি দখলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম কলম ধরেন তিনি। আজকের কাগজের সহযোগী সাপ্তাহিক ‘কাগজ’-এর পাতায় দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই প্রবন্ধে শফিকুল ইসলাম শিবলী বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়িটি অবমুক্ত করে সেখানে একটি স্মৃতি সংগ্রহশালা অথবা স্মৃতি মন্দির করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এর পরেই পাবনার সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা বাড়িটি অবমুক্ত করার আন্দোলন শুরু করেন। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা কমরেড জাকির হোসেন, গণতন্ত্রী পার্টির সুলতান আহমেদ বুড়ো, জাসদের আমিরুল ইসলাম রাঙা, কমিউনিস্ট পার্টির রেজাউল করিম মনি, ড্রামা সার্কেলের গোপাল সান্যাল, মোস্তাফিজুর রহমান রাসেল প্রমুখ এই আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুল হক চুন্নু। পাবনায় কর্মরত অধিকাংশ সাংবাদিক এই আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। দীর্ঘ কয়েক বছর আন্দোলন চলে। জামায়াতে ইসলামীর ছত্রছায়ায় দখলদার স্কুল কর্তৃপক্ষ মামলা করে। উচ্চ আদালত মামলায় বাড়িটি অবমুক্ত করার পক্ষে রায় প্রদান করে। এর আগে চলে মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন ইত্যাদি। সেই সঙ্গে চলে সুচিত্রা সেনের জীবনভিত্তিক আলোচনা সভা, চলচ্চিত্র উৎসব ইত্যাদি। ওই অনুষ্ঠানসমূহে অংশগ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের সকল চলচ্চিত্র শিল্পী। নায়করাজ রাজ্জাক, ফারুক, উজ্জ্বল, ইলিয়াস কাঞ্চন, নায়িকা শাবানা, কবরী, দিতি, অঞ্জনা প্রমুখসহ চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন, সুভাষ দত্তও এসেছিলেন। জমজমাট চলচ্চিত্র উৎসবের সমন্বয়ক বা নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড জাকির হোসেন। তিনি সকল অতিথিকে আপ্যায়িত করার মূল কাজগুলো করেন দক্ষতার সঙ্গে। ২০০৯ সালের ২৩ অক্টোবর পাবনা টাউন হল প্রাঙ্গণে উৎসবের উদ্বোধন করেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সারা কবরী এমপি। প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত, নাট্যজন আলী যাকের ও চলচ্চিত্র সমালোচক সাব্বির চৌধুরী। জেলা প্রশাসক ড. এ এফ এম মঞ্জুর কাদির এতে সভাপতিত্ব করেন। প্রতিদিনই চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। কিংবদন্তি পাবনার মেয়ে কৃষ্ণা ঘটনাচক্রে একদিন হয়ে যান সুচিত্রা সেন। কৃষ্ণা থেকে রমা দাশগুপ্ত, তারপর রমা সেন এবং সুচিত্রা সেন। বাংলার মানুষের প্রিয় শিল্পী। অবিভক্ত পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) বেলকুচি উপজেলার সেন ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে নানা রজনীকান্ত সেনের বাড়িতে ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল সুচিত্রা সেনের জন্ম। পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার একতলা পাকা পৈতৃক বাড়িতে আজকের সুচিত্রা সেনের শিশুকাল, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। তার স্কুলে ভর্তি করার সময় আরও একটি নাম রাখেন কৃষ্ণা দাশগুপ্ত। তার সমবয়সীরা তাকে কৃষ্ণা এবং কম বয়সীরা কৃষ্ণাদি বলে ডাকতেন। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে চাকরি করতেন। মা ইন্দিরা দাশগুপ্ত ছিলেন গৃহিণী। দু’বোনের মধ্যে সুচিত্রা ছিলেন বড়। ছোট বোন হেনা দাশগুপ্ত। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সুচিত্রা সেনের প্রতি বাবা-মায়ের একটু বাড়তি আদর-সোহাগ-স্নেহ ছিল। আবার বাড়তি শাসনও ছিল। ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের ক’মাস পরে সুচিত্রার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত পাবনার বাড়িঘর, চাকরি সবকিছু ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যান। করুণাময় দাশগুপ্ত নিজের বাড়িটি সরকারের কাছে ভাড়ার বন্দোবস্ত হওয়ায় অনেকটা অভিমান করেই পাবনা ছাড়েন। এরপর সুচিত্রা ও তার বাবা-মা কিংবা তার পরিবারের কেউ পাবনার এ বাড়িতে আসেননি। সুচিত্রা সেনেরও এখান থেকে যাওয়ার পর চেনাজানা ও ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি ঘটে। কোন যোগাযোগ হয়নি। কলকাতা বেড়াতে যাওয়ার বছর দুয়েক পরেই সেখানকার বনেদি পরিবারের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে পাবনার মেয়ে রমা দাশগুপ্ত অর্থাৎ কৃষ্ণার বিয়ে হয়। বিয়ে হয় পাবনার বাড়িতেই। চলে যান কলকাতায়। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে তিনি একবার পাবনায় এসছিলেন। আর বিয়ের পর স্বামীর পদবিতে রমা দাশগুপ্ত হয়ে যান রমা সেন। সুচিত্রা সেনের স্বামী দিবানাথ সেনের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশেরই দক্ষিণের এক জেলায়। পাবনার উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রমা বনেদি পরিবারের বধূ হয়ে ঘর-সংসার করতেই সিনেমার অভিনয়ে জড়িয়ে পড়েন। বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ নামের একটি বাংলা ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। অজ্ঞাত কারণে ছবিটি মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে নায়িকা হয়ে তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবিটি মুক্তি পায়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর সুচিত্রা সেন নিজেকে সিনেমার অভিনয়ে জড়িয়ে রেখেছিলেন। স্বামী দিবানাথ সেনের প্রবল আপত্তি থাকলেও সুচিত্রা সেন মনের তাগিদে নিজেকে অভিনয়ে জড়িত রেখেছিলেন। ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবির পরিচালক ছিলেন সুকুমার দাশগুপ্ত। তারই একজন সহকারী পরিচালক নীতিশ রায় এ ছবিতে অভিনয় করার পর ছবি মুক্তির সময় রমা নাম বদলে নাম দেন সুচিত্রা সেন। সুচিত্রা সেন বাংলা ৫৬টি ও ৭টি হিন্দী মিলে মোট ৬৩টি ছবিতে নায়িকার অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ৩২টি ছবিতেই নায়ক ছিলেন উত্তম কুমার। উত্তম কুমারের সঙ্গে ১৯৫৩ সালে প্রথম ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে সুচিত্রা সেন নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালে উত্তম-সুচিত্রা জুটির শেষ ছবি ‘প্রিয় বান্ধবী’ মুক্তি পায়। সুচিত্রা সেন অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। এ ছবির নায়ক ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সুচিত্রা অভিনীত ৭টি ছবিতে বিকাশ রায় এবং ৫টিতে বসন্ত চৌধুরী নায়ক ছিলেন। এক সময় পাবনা থেকে কেউ কলকাতা গিয়ে সহজেই সুচিত্রা সেনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতে পারতেন। তিনি তাদের কাছে পাবনা শহর, পুরনো বান্ধবী ও চেনাজানা ব্যক্তিদের খোঁজ-খবর আগ্রহভরে জিজ্ঞাস করতেন। ১৯৭৮ সালে সিনেমায় অভিনয় বন্ধ করে দেয়ার পর থেকেই তিনি আর কাউকে সাক্ষাত দেননি। পাবনার অনেকেই কলকাতায় গিয়ে সুচিত্রা সেনের সাক্ষাত পেতে গেলে ভেতর থেকে বিনয়ের সঙ্গে না উত্তর মিলেছে। পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার (পুরাতন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বিপরীতে) সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়িটির হাল দেখে মনে ব্যথা জাগো। একতলা পাকা বাড়িতেই সেই রমার শিশুবেলা, শৈশব, কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে। এ বাড়ির সবখানেই তার হাতের ছোঁয়া, পদচারণা স্মৃতি হয়ে মিশে আছে। এক সময় এই বাড়ির তুলসীতলায় মায়ের আঁচল ধরে সাঁঝবাতি দেয়া আর শঙ্খধ্বনি দিতে দেখেছেন সুচিত্রা সেন। এখন এ বাড়িতে নেই তুলসী গাছ। প্রায় ভগ্নদশা। বাড়িটিতে ১৯৪৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত জেলায় কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটগণ থাকতেন। পরে এ বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করেন অনেকেই। বাড়ি ভাড়া দেয়া টাকাতেই বাড়িটির মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা বা বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। বাড়িটি সংরক্ষণের দাবি করা হয়েছিল স্থানীয় প্রশাসনের কাছে; কিন্তু ওই দাবি বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা চাই সুচিত্রা সেনের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি হোক সাংস্কৃতিক আঙ্গিনা।
×