ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদের সংখ্যার বিরুদ্ধে বার্গম্যানের আবিষ্টতা

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১২ এপ্রিল ২০১৬

শহীদের সংখ্যার বিরুদ্ধে বার্গম্যানের আবিষ্টতা

ইংরেজী শব্দ ড়নংবংংরড়হ-এর বাংলা প্রতিশব্দ আবিষ্টতা অতটা শক্তিশালী না হলেও সাধারণত ইতিবাচক ব্যঞ্জনা বহন করে। উদাহরণস্বরূপ, আমি সবসময় স্বদেশবাসীর উদ্দেশে আমার প্রতিটি বক্তৃতার, বিশেষভাবে আমাদের তিনটি জাতীয় দিন স্মরণ, শুরুর প্রারম্ভে এ শব্দটা ব্যবহার করি এভাবে : ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার ড়নংবংংরড়হ, আমি এটা নিয়েই জেগে থাকি, এটা নিয়েই স্বপ্ন দেখি যখন আমি ঘুমিয়ে থাকি।’ মনে হয় ড. কামাল হোসেনের জামাতা সারা হোসেনের স্বামী ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যান এবং আমি উভয় ড়নংবংংরড়হং-এ ভুগছি। তবে মূল পার্থক্য হলো একজন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে জনগণের পর্বতসম আত্মাহুতিকে মহিমান্বিত প্রচেষ্টায় নিমগ্ন, অন্যদিকে অন্যজন উঠে পড়ে লেগেছেন ত্রিশ লাখ মানুষ যে আত্মাহুতি দেয়নি এটা প্রমাণ করার জন্য। আমি এমন একজন বাঙালী যার চোখে অশ্রু নেমে আসে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত যখন গাওয়া হয়, অন্যদিকে বার্গম্যানের জন্য এটা কোন গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতি বহন করে না। এমনকি যদি বার্গম্যান বাংলাদেশের একটি ন্যাচারালাইজড নাগরিকও হয়ে থাকেন। ঠিক একইভাবে, যদিও আমি কানাডার একজন ন্যাচারালাইজড নাগরিক, আমি কোন আবেগ অনুভব করি না যখন কানাডার জাতীয় সঙ্গীত কোন অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়। আমার এ অনুভূতির সঙ্গে পূর্ণ সুরে আছেন প্রত্যেক বাঙালী যিনি তার হৃদয়ের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে লালন করেন (বার্গম্যানের জ্ঞাতার্থে বলছি তাকে আওয়ামী লীগ সমর্থক হতে হবে তা নয়)। উদাহরণস্বরূপ, গত ২৩ মার্চ তারিখে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে, আমি যখন অন্টারিওর সংসদ ভবন কুইন্স পার্কে অন্টারিও আইনসভার মাননীয় স্পীকারের সহায়তায় শত শত পতাকা আন্দোলিত বাঙালীর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সুরে সুরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করছিলাম, তখন অনেকেই আমার মতো আবেগপ্রবণ হয়ে তাদের চোখে আনন্দাশ্রু নেমে আসে। স্পীকার আমার চোখে অশ্রু দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি একেবারে তোমার অনুভূতি অনুধাবন করতে পারছি। যে জাতির লোকেরা এই পতাকা অর্জনে লাখ লাখ জীবনের আত্মাহুতি দিতে পারে তারা ইতিহাস তৈরির এ মুহূর্তে এমন আবেগপ্রবণ হবেন এটাই স্বাভাবিক।’ আমাদের আত্মাহুতিকে নিরলস হেয় করার প্রয়াস বার্গম্যান নিউইয়র্ক টাইমসে (এপ্রিল ৫, ২০১৬) ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইনের’ খসড়ার সমালোচনায় ‘বাংলাদেশের রাজনীতি গণহত্যা বিতর্ক’ শিরোনামে তার নিজের চিরাচরিত যুক্তির উপস্থিতির মাধ্যমে উপসংহার টেনেছেন, ‘প্রস্তাবিত গণহত্যা আইন স্বল্প মেয়াদে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্য সহায়ক হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে, তাদের দলীয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য তৈরি এ আইন গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক হবে।’ একজন ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিক’ দাবিদার বার্গম্যানকে একাডেমিক গবেষণা এবং রাজনৈতিক বিবৃতির মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন থাকার কথা। প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার উদ্দেশ্য সৎ উদ্দেশ্যে সত্যকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা। উদাহরণস্বরূপÑ বার্গম্যান লেখক এসএ করিমের বই ‘ট্রাম্প এবং ট্র্যাজেডি, শেখ মুজিব’ থেকে ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা সম্পর্কে উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে : ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাকে বলা হয়েছে, সোভিয়েত সংবাদপত্র প্রাভদা থেকে এ সংখ্যাটি নেয়া হয়েছে।’ কিন্তু বার্গম্যান এসএ করিমের পরবর্তী বিশ্লেষণ উদ্ধৃত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এসএ করিমের পরবর্তী বাক্য ছিল এ রকম, ‘সঠিক সংখ্যা এক মিলিয়ন বা এর কাছাকাছি হতে পারে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের জন্য যুদ্ধ চলেছিল সে অবস্থার জন্য এ সংখ্যা বিরাট।’ তিনি আরও বলেন, ‘দখলদার সেনাদের আচরণের জঘন্য দিক নিছক নিরপরাধ বেসামরিক লোকদের ওপর শুধু গণহত্যাই নয়, কিন্তু ভয়াবহ হিংস্রতা যা দিয়ে এ হত্যাকান্ড সম্পন্ন হয়েছিল। উপরন্তু, এমনভাবে নারী ধর্ষণ হয়েছিল যেটার স্কেল আধুনিক ইতিহাসে অতুলনীয়।’ তার সম্প্রতি প্রকাশিত, বহু পুরস্কারপ্রাপ্ত, অনেক প্রশংসিত বই, ‘ব্লাড টেলিগ্রাম : নিক্সন, কিসিঞ্জার এবং একটি বিস্মৃত জেনোসাইড’, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি বাস, শহীদের সংখ্যা সম্পর্কে তার নিজের হিসাব রয়েছে, লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের এ হত্যাযজ্ঞ সাম্প্রতিক ইতিহাসের এক কার্ডিনাল নৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে ... আধুনিক যুগের নিষ্ঠুরতার অন্ধকার বর্ষপঞ্জিতে, এটা বসনিয়ার চেয়ে রক্তক্ষয়ী এবং রুয়ান্ডার মতোই একই রুক্ষ লীগের নিম্ন স্তরে গণ্য হবে।’ এর বিপরীতে, কিছু মানুষ বাক স্বাধীনতার নামে, কোন এক বিশেষ উদ্দেশ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। তারা এক অসৎ উদ্দেশ্যে আমাদের ত্যাগ এবং উৎসর্গকে লঘুকরণের অপচেষ্টায় লিপ্ত এবং অনেক ক্ষেত্রে সুচতুরভাবে আমাদের জনগণের ওপর সংগঠিত অপরাধকে যৌক্তিকতা দানের প্রয়াসী। খালেদা জিয়ার বক্তব্য, যা বার্গম্যানের প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, একেবারে একমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যেটা উপরোক্ত উদ্দেশ্য অর্জনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। বলা হয়, এত লাখ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে, আসলে কত শহীদ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, এটা নিয়েও বিতর্ক আছে। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না।’ গত নবেম্বরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সময় কোন যুদ্ধাপরাধ বা নৃশংসতা সংঘটনে পাকিস্তান অস্বীকারের পর পরই এসেছিল তাঁর বক্তব্য। একই বক্তব্যে তাঁর সার্বক্ষণিক দাবির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি একটি ‘আন্তর্জাতিক মান’ এর ‘স্বচ্ছ’ যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য তার চাহিদার কথা আবারও উল্লেখ করলেন। তাঁর মন্ত্রিসভার এক মন্ত্রী এবং এক সংসদীয় উপদেষ্টা সঠিক বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে (যেটা অবশ্য বার্গম্যানের মতে ‘সঠিক প্রক্রিয়া স্খলন’ এর মাধ্যমে) ইতোমধ্যেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেছেন এবং আর একজন মন্ত্রী ফাঁসির লাইনে রয়েছেন। এর বাইরেও, খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্য আরও তর্কসাপেক্ষ এ কারণে যে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘৃণিত দোষী সাব্যস্ত এবং মৃত্যুদ- কার্যকর করা যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার দলের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিলে শোক প্রস্তাব গ্রহণ। ইউরোপের কোন প্রধান রাজনৈতিক দল যদি নুরেমবার্গ ট্রায়ালে মৃত্যুদ- কার্যকর করা কোন যুদ্ধাপরাধীর জন্য শোক প্রস্তাব গ্রহণ করত তাহলে, ঐ দল কি আইনগতভাবে টিকে থাকার অনুমতি বজায় রাখতে পারত? ঐ দলে অবস্থানকারী এখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয়দানকারী মানুষের উচিত ছিল নাকে খৎ দিয়ে ঐ দল থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া। কোন গণহত্যায়ই হতাহতের সংখ্যা মাথা গণনার ভিত্তিতে রেকর্ড করা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে, নাৎসি বাহিনী ছয় মিলিয়ন ইহুদী হত্যা করেছে। যদিও নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীর আইনজীবী ও পরে নাৎসি সমর্থকরা এ সংখ্যা প্রশ্নবিদ্ধ করা সত্ত্বেও মিত্র সরকার দ্বারা সরবরাহ করা সংখ্যা সরকারীভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বার্গম্যান যদি পৃথিবীর একমাত্র ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলে গিয়ে হলোকস্টে যে ৬০ লাখ ইহুদীকে হত্যা করা হয়েছে বলে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সেটাকে নিয়ে প্রশ্ন করতেন তাহলে ইসরাইলে তার কি পরিণতি হতো? বেলজিয়ামে, হলোকস্ট অস্বীকার ১৯৯৫ সালে অবৈধ হয়েছে। আইন শর্ত দেয়া হয়েছে, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক শাসকদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা অস্বীকার করা, ছোট করা বা ন্যায্যতা দেয়ার প্রচেষ্টা যে কেউ করলে সে ব্যক্তি দণ্ডিত হবেন।’ জুলাই ১৩, ১৯৯০ সালে ফ্রান্সে, গ্যাসট এ্যাক্ট নামের এক আইন অনুযায়ী নাৎসি নেতাদের যার ভিত্তিতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিভাগে পড়া যে অপরাধের ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করা হয় সে অপরাধের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা আইনের দৃষ্টিতে দণ্ডনীয় অপরাধ। জার্মানিতে ‘প্রকাশ্যে বা জনসভায় জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের শাসনাধীনে সংঘটিত অপরাধকে অস্বীকার, লঘুকরণের প্রচেষ্টা বা অনুমোদন দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ।’ হাঙ্গেরীর সংসদ হলোকস্ট অস্বীকার বা লঘুকরণের প্রচেষ্টার অপরাধে তিন বছর পর্যন্ত দ-নীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে সরাসরি হলোকস্ট অস্বীকার নিষিদ্ধ না হয়ে থাকলেও গণহত্যা অস্বীকার, লঘুকরণের প্রচেষ্টা বা অনুমোদনের অপরাধে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান সব সদস্য রাষ্ট্রের ঐচ্ছিকরূপে প্রয়োগ করার অধিকার দেয়া হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অফিসিয়াল মৃতের সংখ্যা চ্যালেঞ্জ করে ইতিহাসকে অবমাননার অপরাধে ডেভিড বার্গম্যানকে দোষী সাব্যস্ত করে। মাননীয় বিচারক বার্গম্যানের ২০১১ সালের একটি ব্লগ পোস্টে ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। ২০১১ সালের নবেম্বর দেয়া ঐ পোস্টে তিনি সেখানে মৃতের সংখ্যা অনেক কম বলে মতামত দেন এবং সরকারী সংখ্যার সমর্থনে কোন প্রমাণ নেই বলে উল্লেখ করেন। ট্রাইব্যুনালের প্রিসাইডিং বিচারক ওবায়দুল হাসান ডেভিড বার্গম্যানকে দোষী সাব্যস্ত করে দেয়া তাঁর রায়ে বলেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা সরল বিশ্বাসে এবং জনস্বার্থে প্রয়োগ করা যেতে পারে। ডেভিড বার্গম্যানের তন্ন তন্ন করে খুঁজে এ সংখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করার পিছনে সরল বিশ্বাস ছিল না এবং এটা তিনি জনস্বার্থ রক্ষার জন্য করেননি।’ একইভাবে খালেদা জিয়ার শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করার পিছনে ‘সরল বিশ্বাস’ বা ‘জনস্বার্থের’ কোনটারই কোন সম্পর্ক ছিল না। ট্রাইব্যুনাল পুনর্ব্যক্ত করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং এটা বাংলাদেশের জনগণের ‘আবেগের সঙ্গে জড়িত’। ট্রাইব্যুনাল এছাড়াও এই সংখ্যা (তিরিশ লাখ) ট্রাইব্যুনালের দেয়া আগের আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ‘যে কেউ এই গবেষণা করতে পারেন কিন্তু তাদেরকে ট্রাইব্যুনালের মর্যাদা আঘাত হতে পারে এমন ধরনের কোন মন্তব্য করার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে’, মাননীয় বিচারক যোগ করেন। প্রস্তাবিত ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইনের’ খসড়ায় মাননীয় বিচারকের এ পর্যবেক্ষণকে এবং সুপ্রীমকোর্ট কর্তৃক দেয়া একাধিক আপীলের রায়ে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা লিপিবদ্ধকে পূর্ণ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। বার্গম্যান ’৭১ সালে পাকিস্তানীদের সমর্থিত বিহারী জাতিগত গ্রুপ সদস্যদের ‘ব্যাপক’ হত্যাকা-ের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। বিহারীরা অনেকেই সশস্ত্রভাবে পাকিস্তানীদের পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন, অতএব তাদের নিহত হওয়াকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করা এক অযৌক্তিক এবং নির্বোধ তুলনা। তখন আমার জেলা শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন রেলওয়ের এক খালাসী নিজেকে মেজর হিসেবে ঘোষণা দিয়ে। ওর নেতৃতে ওরা পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে ওদের ভাষায় ‘গুলি বাঁচানোর জন্য জবাই করে’ বাঙালীদের হত্যা করেছে। আমি নিজে ’৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে একদিনে ৩০ জন (যাদের ২ জন ছিলেন আমার অতি নিকটের) জবাই করা বাঙালীর দাফনে শরিক হয়েছি। এর বাইরে নিরস্ত্র বিহারী যারা নিহত হয়েছেন তারা অবস্থার শিকার। আমরা যে ত্রিশ লাখ মানুষকে গণহত্যার কথা বলি তাদের সিংহভাগই নিরস্ত্র ছিলেন, এদের মধ্যে শহীদ সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা হিসাবে নেয়া হয়নি। কেননা সশস্ত্র যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তাদেরকে বীর শহীদ হিসেবে গণ্য করা হয়; কিন্তু তাদের নিহত হওয়াকে গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা হয় না। বার্গম্যানের মতে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় এসে ১৯৭১ সালের আবেগ ব্যবহার করে স্বৈরাচারী একদলীয় শাসনের দিকে যাওয়াকে যথার্থতা দেয়ার চেষ্টা করছে। বার্গম্যানের মতে, আওয়ামী লীগের ইতিহাস হলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পার্টি এবং অন্য সব বিরোধী দল ‘প্রো-পাকিস্তানী’ এবং ‘বিপজ্জনক এবং দেশের প্রতি আনুগত্যহীন’। এ বক্তব্য দিয়ে বার্গম্যান চরম অসাধুতার পরিচয় দিয়েছেন। একমাত্র ‘জামায়াতে ইসালামী’ দলকে সর্বসম্মতভাবে ‘প্রো-পাকিস্তানী’ দল হিসেবে গণ্য করা হয়। এর বাইরে বিএনপি (’৭১ সালে এ দলের জন্ম হয়নি) বিশেষ করে তাদের দলীয় প্রধানের বক্তব্য, চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তাঁর অবস্থান এবং শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের কারণে নিজেকে ‘প্রো-পাকিস্তানী’ হিসেবে নিজেই উপস্থাপিত করেছেন। অন্য সব রাজনৈতিক দল বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক দল, যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য ছোটখাটো দলকে সরকার বা জনগণের কেউই ‘প্রো-পাকিস্তানী’ দল হিসেবে গণ্য করে না। প্রস্তাবিত ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইনের’ সরকার কর্তৃক সম্ভাব্য অপপ্রয়োগ সম্পর্কে তার আশঙ্কা চিত্রিত করে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের চাপের কথা বলতে গিয়ে তিনি ইদানীং একজন, সংবাদপত্রের সম্পাদকের হয়রানির কথা উল্লেখ করেছেন। একজন বাংলাদেশভিত্তিক সাংবাদিক বার্গম্যানের না জানার কথা নয় যে এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকারের কোন সম্পর্ক নেই। দেশের মুক্ত চিন্তার সব বিবেকবান মানুষ এ হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। উপরন্তু ওই সম্পাদক নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা, এই সেদিনও তিনি তাঁর পত্রিকায় এক কড়া সম্পাদকীয়তে লিখেছেন, ‘পাকিস্তানীদের দ্বারা আমাদের ত্রিশ লাখ মানুষের হত্যাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য জাতিসঙ্ঘের কাছে দাবি জানাচ্ছি’ এবং যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার চালিয়ে যাওয়ার তিনি একজন একনিষ্ঠ প্রবক্তা। লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
×