ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখের তরজা

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১২ এপ্রিল ২০১৬

বৈশাখের তরজা

‘একখানা মেঘ ভেসে এলো আকাশে/একঝাঁক বুনোহাঁস পথ হারালো...’ বহুশ্রুত গানটি কয়েক দিন ধরে গুনগুন করে ভেসে উঠছে মনের গহীনে। গানটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় গায়ক ভূপেন হাজারিকার। একেবারে পরিশীলিত ব্র্যান্ডের গলা। আমাদের হেঁড়ে কণ্ঠে তা মানায় না কোনমতেই। আর তাই মনের গহীনে বুড়বুড়ি কাটা পর্যন্তই সার। তবে মেঘ ভেসে আসার আলামত দেখতে পাচ্ছি রাজধানীর নিসর্গ প্রকৃতিতেই। বড় বড় সুউচ্চ দালান ও আকাশচুম্বী অট্টালিকার সিলুয়েটে সকাল কিংবা সন্ধ্যায় হঠাৎ করে প্রায়ই চোখে পড়ে কাজল ঘন সজল মেঘমালা, বজ্র ও বিদ্যুতের মুহুর্মুহু ঝিলিক, সেই সঙ্গে দমকা হাওয়া ও ঝড়ো বাতাস এবং অনতিপরেই ঝটিতি বৃষ্টি। এমনকি শিলা বৃষ্টিও। চৈত্রের গুমোট গরমে অবশ্যই প্রাণ মন জুড়িয়ে যাওয়া স্বস্তির ঝড়-তুফান-বজ্র বৃষ্টি। বৃষ্টিবিহীন বসন্ত দিনেও ছিল আকাক্সিক্ষত বৃষ্টির তুমুল প্রত্যাশা। তবে সেই প্রত্যাশার ফল অচিরেই মিলে গেল বলে স্বস্তিও পাচ্ছি বেশ। আদিকালের মানুষ চৈত্র-বৈশাখের তীব্র খরা মৌসুমে ঝড়-বৃষ্টির আকাক্সক্ষা ও কামনায় কত রকম লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা পালন করত। বট-অশ্বত্থের বিয়ে দেয়ার পাশাপাশি ঘটা করে দেয়া হতো ব্যাঙের বিয়ে। ডাল-পালা, গাছ-গাছালির পূজা তো হতোই। কোথাও কোথাও এমনকি শুকনো খটখটে চাষের জমির ওপর সকাল-কিংবা সন্ধ্যায় আনগ্ন নারীদের নাচ-গানের প্রচলনও ছিল বৃষ্টির কামনা ও প্রার্থনার আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে। আধুনিককালে আমরা যাই বলি না কেন, খরা ও খরিপ মৌসুমে উপমহাদেশ এবং আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে এবং নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে এখনও এসব আদি প্রথা ও সংস্কৃতির কিছু কিছু অনুসৃত হয়ে থাকে। হয়ত সেসব অভিজ্ঞ ওঝা বা পুরোহিত আজ আর তেমন অবশিষ্ট নেই, তবে বংশের নিবু নিবু বাতি হিসেবে যেসব প্রবীণ প্রতিনিধি কষ্টে-সৃষ্টে কায়ক্লেশে বেঁচেবর্তে আছেন, তারাই বা কম কি! ডিসকভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সৌজন্যে মাঝে-মধ্যে আমাদের সেসব দেখার সৌভাগ্যও ঘটে বৈকি! এর পাশাপাশি আছে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে মরু ও খরাপ্রবণ অঞ্চলে বৃষ্টি নামানোর খবরাখবরও। এই যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র খরাক্রান্ত আরিজোনার পার্বত্য অঞ্চলে বিমান থেকে আকাশে সিলভার আয়োডাইড নামক রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এতে অচিরেই বৃষ্টিপাত হতে পারে। ১৯৪০ দশকে নিউইয়র্কের জেনারেল ইলেকট্রিকের পরীক্ষাগারে প্রথম এই পরিকল্পনা গৃহীত হয়। চীনও অবশ্য অনেক আগে থেকেই কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের পরিকল্পনা ও ধারণা কাজে লাগিয়েছে। অবশ্য এর বিপরীত চিত্রও আছে বৈকি। ২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিলে চৈনিক বিজ্ঞানীরা আকাশে রকেট ছুড়ে মেঘমালা অন্যত্র ভাসিয়ে দিয়ে আটকে দিয়েছিলেন বৃষ্টিপাত। এটি ছিল একটি সফল প্রচেষ্টা। অন্যদিকে সিকিমের বর্তমান রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান চলাকালে বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিলে সুপ-িত লামা ও বৌদ্ধভিক্ষুর দল প্রার্থনা তথা জপতপে বসে গিয়েছিলেন, শুভক্ষণে যাতে বৃষ্টিপাত না হয়, সেজন্য। আমাদের লেখালেখি ও আশাআকাক্সক্ষায় শুরু হয়েছে ঝড়-বৃষ্টি, একথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। চৈত্র মাসের শেষ দিকে এবং বৈশাখের শুরুতে এমনিতেই কালবৈশাখীর প্রচলন ও আয়োজন বেশ পুরনো ও প্রাচীন প্রথা। গ্রাম-গঞ্জে এ সময় হয়ে থাকে চড়ক পূজা, নীল ও হাজরা পূজা এবং পার্বত্য অঞ্চলে বৈসাবি। এসবই নিতান্তই লোকাচার ও লোকানুষ্ঠান। মহাদেব-পার্বতী এ সময়ে হিমালয় তথা এভারেষ্টের চূড়া থেকে নেমে আসেন মাটিতে, মানুষের রূপ ধরে, ছদ্মবেশে। প্রকৃতপক্ষে মানুষই সেজে থাকে অদ্ভুত মহাদেব, কিম্ভূত পার্বতী। সঙ্গে নন্দী-ভৃঙ্গির দল। ঢাকের কাঠি বাজে কুরুতাং কুরুতাং কুরুম কুরুম। ঘণ্টা বাজে, কাঁসর বাজে, বাজে ঢাক-ঢোল, বাজে শঙ্খনাদ। সম্মিলিত বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচেন বাবা মহাদেব, মা পার্বতী, নন্দী-ভৃঙ্গির দল। আকাশে-বাতাসে, চরাচরে, চৈত্রের খাঁ খাঁ প্রান্তরে উলুকঝুলুক উদাস দুপুর ও অপরাহ্ণে গ্রামে গ্রামে, দূর-দূরান্তরে ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ে সেই নাচ-গান ও বাজনা। বৃষ্টি না নেমে যাবে কোথায়! এ সময় হঠাৎ হঠাৎ ঈষাণ কোণে ঝটিতি দেখা দেয় কাজল কালো মেঘ। চৈত্রের উদাসীন খরতপ্ত ঘূর্ণায়মান বাতাসে মুহূর্তের মধ্যে সেসব ছড়িয়ে পড়ে সারা আকাশ ছেয়ে। দমকা, ঝড়ো ও উন্মাতাল বাতাসে কাজল মেঘের বুক চিরে তীব্র গর্জনে মুহুর্মুহু বেজে ওঠে বজ্রের দামামা। উড়ে যায় ঝরা পাতা, এলোমেলো হয় বাঁশঝাড়, বেতবন, আম-কাঁঠালের উঁচু উঁচু ডালপালা ঝাঁকিয়ে দিয়ে কে বা কারা যেন উচ্চকণ্ঠে গেয়ে ওঠেন, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, তুমি যে বহ্নিশিখা...।’ অতঃপর নামে বৃষ্টি, দমকা বাতাস। এ বৃষ্টি অবশ্যই বর্ষার মুষল বারিধারা নয়। এ বৃষ্টির দমকে ঠমকে ভরা আছে বজ্র ও বিদ্যুত, আছে ঝড়ো বাতাস ও মাতাল সমীরণ। চৈত্র-বৈশাখের কালবৈশাখীর বৈশিষ্ট্য এটাই। তা না হলে কি আদৌ মানায় বসন্ত বিদায় এবং নববর্ষের আবাহন! ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর বাঙালী তো এই বৈশাখেরই তুমুল প্রতীক্ষা করে থাকে প্রতিবছর। বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণের কথা প্রায়ই বলা হলেও, এর বেশ কয়েকটি প্রধানত ধর্মকেন্দ্রিক অথবা ধর্মীয় অনুষঙ্গের সঙ্গে জড়িত। যেমন ঈদ উৎসব, দুর্গাপূজা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মেরি ক্রিসমাস ইত্যাদি। আর অন্যদিকে পহেলা বৈশাখ যথার্থই ধর্ম-বর্ণ নিরপেক্ষ, একেবারে সর্বজনীন। এরকম আরও কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎসব-অনুষ্ঠান রয়েছে। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, অবশ্য এটি একটি শোকোৎসব। অনুরূপ বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস। এসব উৎসব অনুষ্ঠানের আবেদনও অবশ্যই সর্বজনীন। তবে কোনটাই পহেলা বৈশাখের মতো নয়। বাংলা নববর্ষ উৎসব মানে ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে বাঙালীর ঘরে ফেরা। আবহমান বাংলাদেশ ও বাঙালীর হৃদয়ের আয়নায় নিজের চেহারা প্রত্যক্ষ তথা আবিষ্কার করা। হাজার বছর ধরে প্রবহমান বাঙালীর শেকড় সন্ধান। মাটি ও মৃত্তিকামায়ার মর্মমূলে প্রত্যাবর্তন। বাঙালীর মন ও মননের আত্মানুসন্ধান। এ প্রসঙ্গে সংস্কৃতির কথাটি একটু বলি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। তবে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এডওয়ার্ড টেইলরের ধ্রুপদী সংজ্ঞাটি প্রণিধানযোগ্য : মানুষের বিশ্বাস, আচার-আচরণ এবং জ্ঞানের একটি সম্মিলিত ও সমন্বিত রূপকে বলা যায় সংস্কৃতি। ভাষা, সাহিত্য, ধারণা, ধর্ম-বিশ্বাস ও রীতিনীতি, পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ ও নিয়মকানুন, পালাপার্বণ, উৎসব, শিল্পকর্ম, কুটির শিল্পসহ প্রতিদিনের কাজে লাগে- এমন সব হাতিয়ার-উপকরণ ইত্যাদি নিয়েই সংস্কৃতি। সে বিবেচনায় বলা যায়, বাঙালীর সংস্কৃতি হিন্দু, মুসলমান, নিম্নবর্গীয় হিন্দু, বৈষ্ণব, শাক্ত, বাউল, আশরাফ, আতরাফ, বৌদ্ধ-খ্রীস্টান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়- সবার সম্মিলিত সংস্কৃতি। শহর-নগর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জ, সমতল-পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসী- সব মানুষের সংস্কৃতি। পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ সর্বদাই সেই সংস্কৃতির কথা বলে উচ্চকণ্ঠে সম্মিলিতভাবে- গান-গল্প-কবিতা, নাটক-নৃত্যগীত, যাত্রা, পুতুল নাচ, সার্কাস-মেলা-ধর্মানুষ্ঠান এমনকি ছড়া ও কৌতুকে। সংস্কৃতির অনিবার্য প্রতিফলন ঘটে থাকে খাবার-দাবারেও। পহেলা বৈশাখে মোগলাই খাবার তথা পোলাও-মাংস, রোস্ট, বিবিয়ানি, কোরমা কালিয়া, জর্দা-বোরহানি ইত্যাদি হয়ে থাকে, তাও নয়। ফাইভ-সেভেন-থ্রি স্টার হোটেল-রেস্তরাঁয় এসবের এলাহী আয়োজন করা হয় ঠিকই এবং কোন কোন আলিশান বাড়ি ও পরিবারেও। তবে বাংলা নববর্ষে মোটের ওপর বাংলা খাবারই চলে বেশি। এরকম একটি আদর্শ বাঙালী খাবারের নমুনা পাচ্ছি মধ্যযুগে রচিত প্রাকৃত পৈঙ্গলের একটি পদে : যে নারী রোজ কলা পাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল আর নালিতা বা পাটশাক পরিবেশন করেন, তার স্বামী ভাগ্যবান তথা পুণ্যবান। উৎসব উপলক্ষে আরও একটি ভাল খাবারের বর্ণনা তুলে দিচ্ছি মুকুন্দরামের চ-িমঙ্গল থেকে। খুল্লনাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার পর যা রান্না হয়েছিল তার বিবরণ দিচ্ছেন কবি : সর্ষের তেলে চিতল মাছের কোল ভাজা, কুমড়ো বড়ি আর আলু দিয়ে রুই মাছের ঝোল, আদারস দিয়ে সর্ষে তেলে কৈ মাছ ভাজা, কাতলা মাছের ঝোল, খরশোলা মাছ ভাজা আর শোল মাছের কাঁটা বের করে কাঁচা আমের সঙ্গে রান্না। বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলেও দেয়া আছে বিবিধ রান্নার বিবরণ। রুই মাছ দিয়ে কলতার আগা, মাগুর মাছ দিয়ে গিমা গাছ, ঝাঁঝাল কটু তেল (সর্ষে) দিয়ে রান্না খরসুন মাছ, ভেতরে মরিচের গুঁড়া দিয়ে বাইরে সুতো পেঁচিয়ে চিংড়ি মাছের মাথা, চিতল মাছের কোল ভাজা আর কৈ মাছ দিয়ে মরিচের ঝোল। এবারে শেষ পাতের কথা একটু বলি। দই-মিষ্টি ছাড়া সম্পন্ন ও সম্পূর্ণ হয় না বাঙালীর ভোজনপর্ব। মধ্যযুগের সাহিত্যে রকমারি মিষ্টি ও মিষ্টান্নের বিবরণ পাওয়া যায়, সুস্বাদু পায়েসসহ। গোপাল হালদার এক স্থানে ঠাট্টা করে লিখেছেন, বাঙালীর সংস্কৃতি রসগোল্লা ও সন্দেশের সংস্কৃতি। রসগোল্লার উদ্ভব সম্পর্কে সঠিক জানা না গেলেও ইংরেজ আমলের আগেই বলে অনুমিত হয়। অবশ্য সোয়া শ’ বছর আগে বাগবাজারের নবীন দাস রসগোল্লার আধুনিক রূপ দেন বলে জানা যায়। আর বিজন বিহারী ভট্টাচার্য মনে করেন, চৈতন্য চরিতামৃতে যে মনহরার নাম পাওয়া যায়, তা আধুনিক সন্দেশের আদিরূপ। এসব মিলিয়েই তো বাঙালী, বাংলা নববর্ষ, বাঙালীর সংস্কৃতি, উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি। সবাইকে নববর্ষের আন্তরিক শুভেচ্ছা।
×