ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর বর্ষবরণের ইতিহাস

বাংলার অপরূপ সাজে চিরচেনা বৈশাখ

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১১ এপ্রিল ২০১৬

বাংলার অপরূপ সাজে চিরচেনা বৈশাখ

সমুদ্র হক ॥ দুয়ারেই নববর্ষ। ঘরে ঘরে চলছে জোর প্রস্তুতি। কত কী আয়োজন! সবই সম্পন্ন প্রায়। আর মাত্র দু’দিন বাদেই নতুন বাংলা বছরকে বরণ করে নেয়া হবে সাড়ম্বরে, সগৌরবে। বটতলা-হাটখোলায় জমবে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। এসব আয়োজন দেখে আজকের দিনে কারও মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, অতীতে কেমন ছিল এই নববর্ষ....। বছর কুড়ি আগেও ইংরেজী এবং বাংলা তারিখের পর যথাক্রমে সাল ও সন লেখা হতো। সাল কথাটি ফার্সি, সন কথাটি আরবী। দূর অতীতে মুঘলের দ্বিতীয় সম্রাট আকবর তারিখ ই ইলাহী নামে ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করে বাংলা দিনপঞ্জিতে বঙ্গাব্দ শব্দ ব্যবহার করেন। সম্রাট আকবর সোলার ক্যালেন্ডার অর্থাৎ প্রতিদিন সূর্য উদিত হয়ে অস্ত যাওয়াকে দিন ধরে বছরের হিসাব কষেছেন। আমাদের দেশে বঙ্গাব্দ ও খ্রিস্টাব্দ লেখা শুরু হয় গেল শতকের ৯ এর দশকের প্রথমে। ’৪৭-এ দেশ ভাগের আগেও এই উপমহাদেশের বঙ্গদেশে নববর্ষ ছিল না। তবে চৈত্র সংক্রান্তি ছিল। অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে উৎসবের আয়োজন ছিল সর্বজনীন। গ্রামের গৃহস্থ ও কিষান বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার করে মাটি পানিতে গলিয়ে কাপড়ের টুকরো অথবা কিছু খড় দিয়ে লেপে দেয়া হতো। ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে গাঁয়ের বধূরা গীত গেয়ে নেচে পুরুষরা বড় নৌকা করে মাঝ নদীতে গিয়ে চাঁদের আলোয় উৎসবে মেতে উঠত। ইংরেজ শাসনে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের তারিখের উৎসব দেখে বাঙালীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। চৈত্র সংক্রান্তির সঙ্গে কি করে পরের দিন বৈশাখের প্রথম দিনে বঙ্গাব্দের উৎসবের সূচনা করা যায় তা ভাবতে শুরু করে। প্রতিবাদের এই মাঠে এগিয়ে এলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের বন্ধু রাজ নারায়ণ বসু। তিনি ছিলেন কলকাতার একটি স্কুলের হেড মাস্টার। তার স্কুলে তিনি বৈশাখের প্রথম দিনের প্রভাতে সকল শিক্ষার্থী অভিভাবক ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সঙ্গীত নৃত্যগীত গান এবং মেলা বসিয়ে দিনভর উৎসবের আয়োজন করেন। বর্ষবরণ ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। তখন সময়কাল ১৩২৫ বঙ্গাব্দ। এরপর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তি নিকেতনে নববর্ষ পালনের সূচনা করেন। পরবর্তীতে কালের পরিক্রমায় নববর্ষ উদযাপন উৎসবে মুখরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তবে গত শতকের ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত এই দেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে দেয়া হয়নি। তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের রক্তচক্ষু ও আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের রোষানলে পড়ে বাঙালীর জাত-পরিচিতি হারিয়ে যেতে বসেছিল প্রায়। তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে যতটা জানা যায়, ১৯৬৪ সালের ১৫ এপ্রিল ঢাকায় কবি জাহানারা আরজুর বাড়িতে সেদিনের তরুণ কবি হাসান হাফিজুর রহমান বৈশাখ নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করে খুবই স্বল্প পরিসরের ঘরোয়া পরিবেশে বৈশাখ বরণের পালা শুরু করেন। পরের বছরই বীরের জাতি বাঙালী রমনার বটমূলে স্রোতের মতো নেমে আসে। এরপর আর বৈশাখকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ আমরা যে সম্প্রীতির বন্ধনের কথা বলি তার সবই আছে বাংলা নববর্ষে। একমাত্র বৈশাখের প্রথম দিন দেশের প্রতিটি কোনায় সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষ মিলিত হয়ে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। বৈশাখী মেলার আয়োজনে বাঙালীর সংস্কৃতির সকল অনুসঙ্গই খুঁজে পাওয়া যায়। বৈশাখ মাস এলেই বাঙালীর সংস্কৃতির একেবারে গভীরের রূপটি অপরূপ হয়ে ওঠে। আমরা গর্ব করে বলতে পারি সম্প্রীতির বাঁধনে আমরাই আপন করে নিয়েছি সকল মানুষকে দেশে দেশে। নববর্ষ সেই ধারকেই এগিয়ে নিয়ে যাবে যুগে যুগে। একটু পেছনে ফিরে তাকালেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যায় কিভাবে নববর্ষ আমাদের গর্বিত করে তুলেছে। যত উৎসবই হোক বৈশাখ শুরু হলেই নানা আয়োজনে বাংলাদেশকে খুব কাছে থেকে দেখা। শিশু ও কিশোর বেলা গ্রামের সেই পথঘাট, বটতলার সেই বাঁশির সুর, ঢাকের বাদ্য, মাটির থালায় (সানকি) পান্তা ভাত, জিলাপি লই মুড়ি খাগরাই শিশুদের পুতুল খেলার মাটির হাড়িপাতিল, কবিগান পালা গান গীতের সঙ্গে হেলেদুলে নাচ... শিকড় থেকে উঠে আসা কত যে আয়োজন...। উৎসবের আনন্দে কোনটি নাচ কোনটি গান তা খুঁজে পাওয়াই যেন আরেক আনন্দে রূপ নেয়। কথা বলছে নাচছে আবার গাইছে। নাচ গান সংলাপের এই অদ্বৈত রূপকে ইতিহাসের পাতায় কেউ বলেছেন ‘কথার ত্রয়ী’। এর আগে বাঙালী সঙ্গীতের তাল লয় সুর অথবা রাগ-রাগিনী সম্পর্কে তেমনটি জানা যায় না। চর্যার কাল হতে একাদ্বশ শতক পর্যন্ত বাঙালীর সঙ্গীত ভাবনায় আর্য প্রভাবের সঙ্গে কৌম বাঙালীর লোকায়ত সঙ্গীত চিন্তার মিশ্রন ঘটেছে। যার প্রভাবে বাঙালীর কীর্তন ঝুমুর বাউল গানে আমাদের লোকায়ত সঙ্গীত ভাবনার প্রতিফলন ঘটে। বর্তমানে নিত্য বছর বাংলা নববর্ষ ঢাকার বটমূল থেকে দেশের প্রতিটি প্রান্তে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তা শিকড়কেই টেনে আনে। এই নববর্ষ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক অপার সম্প্রীতির ভুবন গড়ে দেয়, যে ভুবন চিরদিনের বাঙালীর...।
×