ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

নিহত শৈশব, শিশুর এ কেমন বেড়ে ওঠা ॥ অভিমত

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১১ এপ্রিল ২০১৬

নিহত শৈশব, শিশুর এ কেমন বেড়ে ওঠা ॥ অভিমত

ঢাকা শহরে শিশুদের পড়ালেখা শুরুর ছোট স্কুলগুলো ছোট হতে হতে ফ্ল্যাটে ঢুকে গিয়েছে। নেই তাদের খেলার জায়গা, নেই তাদের অন্য কোন মানসিক বিকাশের পরিবেশ। ছোট স্কুলগুলোর কথা বাদ দিলাম, এই সময়ের ভাল বলে খ্যাত যে বড় স্কুলগুলো, পাবলিক পরীক্ষায় ফল বিবেচনায় যেগুলোর স্থান উপরের দিকে সেগুলোর অবস্থাও একই রকম। যেগুলো অপেক্ষাকৃত নতুন সেগুলোর জায়গা এমনিতেই ছোট। আর যেগুলো পুরনো তাদের হয়ত এক সময় বিশাল জায়গা ছিল; কিন্তু পরবর্তী সময়ে আরও ভাল পাঠদানের উদ্দেশ্যে হোক আর বাণিজ্যিক লক্ষ্যেই হোক বিশাল জায়গা আর বিশাল নেই; সেখানে উঠেছে ইট-পাথরের সুরম্য অট্টালিকা। হারিয়ে গেছে খেলার জায়গা, সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডার জায়গা। চালু হয়েছে মর্নিং শিফট, ডে শিফটের মতো নানান শিফট। শিশুরা ছোট্ট জায়গা ও পরের শিফটের শিশুদের আগমনের কারণে কোনরকমে ক্লাস শেষ করেই অভিভাবক অথবা পরিবারের সহায়ক কর্মীর সঙ্গে বসবাসরত ফ্ল্যাটে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। খেলা কিংবা দাঁড়ানোর জায়গা না থাকায় এই ছোট্ট বয়সটিতে একটি শিশুর সঙ্গে আরেকটি শিশুর ভাবের আদান-প্রদান হচ্ছে না। যার কারণে একটি শিশু আরেকটি শিশুর নিকট থেকে কিছুই শিখতে পারছে না। যেটি মানসিক বিকাশে এক বিরাট অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। শুধু ব্যাগভর্তি পাঠ্যবই পড়াটাই স্কুল নয়। সত্যিকার অর্থে স্কুল মানে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, সংস্কৃতি, বিনোদনসহ অনেক কিছুর সমন্বয়েই আনন্দদায়ক কিছু একটি হওয়া উচিত। যেটি এক সময় ঢাকার প্রায় সব স্কুলেই ছিল। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে শিশুটি কিভাবে সময় কাটাচ্ছে? হয়ত কম্পিউটার অথবা টিভির সামনে তার দিনের বেশিরভাগ সময় চলে যাচ্ছে। এমনকি বিকেলবেলা যে সময়টি পাড়ার অন্যান্য শিশু-কিশোরের সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারত সেটুকুও চলে যাচ্ছে এই যন্ত্রগুলোর সামনে। এর ফলে প্রথম ক্ষতি যেটি হচ্ছে- বেশিরভাগ শিশু-কিশোর খুব অল্প বয়স থেকে চোখে চশমা ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে পাড়া-মহল্লায় খেলার কোন মাঠ নেই। কোথায় যাবে আর খেলবেইবা কী করে? এক সময় ঢাকায় পর্যাপ্ত খেলার জায়গা ছিল, প্রায় প্রতিটি মহল্লায় ছিল খেলার মাঠ। কিন্তু ধীরে ধীরে অপরিকল্পিতভাবে দালান-কোঠা নির্মাণ ও বিভিন্নভাবে দখলের ফলে প্রায় বিলীনের পথে সেসব খেলার মাঠ। ফলে শিশু-কিশোররা মস্তিষ্কনির্ভর খেলায় অভ্যস্ত হচ্ছে, শরীরনির্ভর খেলা ভুলে যাচ্ছে। স্থূলকায় শিশু-কিশোরের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শৈশবের দুরন্তপনা, উচ্ছলতা এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে। যে নগরীতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতেই বেশিরভাগ মানুষকে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে শিশু-কিশোরদের জন্য একচিলতে ফাঁকা মাঠ রাখার কথা ভাবতেও চায় না কেউ। মহল্লাগুলোতে খেলার জায়গা হিসেবে যেটুকু ফাঁকফোকর আছে তাও পরিণত হয়েছে বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে। পাশাপাশি দিনদুপুরে চলে নেশাখোরদের আড্ডা। সন্ধ্যার পর চলে যায় ছিনতাইকারীদের দখলে। এরকম নানাবিধ কারণে শিশু-কিশোররা খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, বেড়ে উঠছে রোবটের মতো যান্ত্রিকভাবে। পড়ালেখার পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন নির্মল বিনোদন। কোথায় বিনোদন? বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানার মতো স্থাপনাগুলো নেই বললেই চলে। যা আছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। যার ফলে বিনোদনের জন্যও ঘুরেফিরে শিশু-কিশোররা বেছে নিচ্ছে সেই প্রযুক্তি। বেশিরভাগ সময় কম্পিউটার বা প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শিশু-কিশোররা হয়ে পড়ছে আত্মকেন্দ্রিক। জড়িয়ে পড়ছে নানান অপকর্মে। পরিবার শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠার জন্য এক বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হলো বাবা-মা আমরা প্রত্যেকে নানাভাবে ব্যস্ত। লেখার শুরুতে একটি কথা উল্লেখ করেছিলাম শিশু বেড়ে উঠছে অনেকক্ষেত্রে মায়ের কোলে নয়, গৃহকর্মীর কোলে। কী নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা! ভাবা যায়? আপনি শিশুর মা অথচ আপনার শিশু বেড়ে উঠছে গৃহকর্মীর কোলে। গৃহকর্মীর নিকট বেড়ে উঠতে উঠতে একটি পর্যায়ে এমন অবস্থা দাঁড়াচ্ছে আপনার শিশুটি আর আপনাকে খুঁজছে না, খুঁজছে গৃহকর্মীকে। আপনার সঙ্গে শিশুর বন্ধন তৈরি হচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে আমার একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। এক আত্মীয়কে দেখেছি তাদের শিশুটি পুরোপুরি গৃহকর্মীনির্ভর। স্বামী-স্ত্রী বিভিন্নভাবে ব্যস্ত। শিশুকে কিছুতেই সময় দেন না। ফলে বয়স অনুযায়ী শিশুর মানসিক বিকাশ তো দূরের কথা, অনেক বড় হয়ে যাওয়ার পরেও কথা বলা পর্যন্ত শিখে উঠতে পারেনি। মা-বাবার চেয়ে গৃহকর্মীর নিকট থাকতেই শিশুটি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এরকম নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের নগর শিশুরা। এ কথা সত্য, বর্তমানের বাস্তবতা এমনই স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই নিজের পেশাসহ নানান বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। কিন্তু তারপরেও আপনার যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে কি আপনার সন্তানকে সময় দেয়া সম্ভব নয়? আমি মনে করি অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু যে মা-বাবারা সময় দেন না তাদের ক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাবটাই আমার নিকট প্রবল বলে মনে হয়। কেমন যেন একটি উদাসীন ভাব পরিলক্ষিত হয় তাদের মধ্যে। এমনিতেই আপনার শিশু নানা সঙ্কটের কারণে বসবাসের অযোগ্য পরিবেশে বেড়ে উঠছে। এরপরেও আপনার পারিবারিক পরিবেশটিও যদি ভাল না হয় তাহলে এই শিশু ভবিষ্যতের সম্পদ নয়; বরং বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এটি অবশ্যই কারও কাম্য নয়। একটি ভাল সমাজ গড়তে হলে ভাল মানুষ দরকার। বর্তমানে সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে এই ভাল মানুষ আমাদের শিশুদের মধ্য থেকে কিছুতেই বের করে আনতে পারছি না। পাবলিক পরীক্ষায় হাইব্রিড গোল্ডেন এ প্লাসের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ কি তৈরি হচ্ছে? তৈরি হচ্ছে না বলেই সমাজে নানান অস্থিরতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যত সমাজ কী হবে সেটি অবশ্য ভাববার বিষয়। শিশুর মধ্যেই সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ খুঁজতে হলে এখনই প্রয়োজন শিশু-কিশোরদের নিয়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ। জাতি হিসেবে আমরা নানা সমস্যা অতিক্রম করে হয়ত সবেমাত্র কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে জানান দিতে শুরু করেছি আমরাও বিশ্বের অন্যতম রাষ্ট্র। আমাদেরকে দেখ! আর আমাদের এই দেখাতে হলে নিজেদের শিশু-কিশোরের জন্যও একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে হবে। তা না হলে আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যত কিভাবে তৈরি হবে? এই প্রশ্ন রাখলাম সকল মহলের নিকট। পরিশেষে সুকান্তের কবিতার লাইন দিয়েই লেখার সমাপ্তি টানছি- ‘এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ লেখক : সাংস্কৃতিক কর্মী ংধুুধফশধফরৎ৪৩@ুধযড়ড়.পড়স
×