ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

বর্ষবরণ উৎসবে মেতে উঠুক দেশ

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১১ এপ্রিল ২০১৬

বর্ষবরণ উৎসবে মেতে উঠুক দেশ

পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের এমনই উৎসব- যা ধর্ম, সমাজ, বয়স ও বৃত্তির সীমা পেরিয়ে সর্বত্র একাকার। নববর্ষের আনন্দ চিত্তে নতুনের জাগরণ ঘটায়। উৎসবের মধ্যে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায় বৃহত্তরের গ-িতে। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী- কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ; সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন যে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ পহেলা বৈশাখ নতুন আঙ্গিকে জীবন গড়ার শপথের দিন। এদিন রাষ্ট্রীয় কর পরিশোধের অঙ্গীকার গ্রহণের দিন ছিল একদা। দেনা-পাওনা হালনাগাদ করার দিন। ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলার দিন। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির প্রেরণার দিন। একদা ফসলি কর পরিশোধের সঙ্গে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাবোধ জাগানোর দিন ছিল। বাঙালী জীবনে দীর্ঘকাল ধরে পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গ হচ্ছে ‘হালখাতা’। উদ্দেশ্য হচ্ছে ফসলি কর পরিশোধের আনন্দ প্রকাশ করা এবং ব্যবসায়ের হিসাব ও খাজনা ‘রাজকীয়’ খাতায় হালনাগাদ রাখা। এ উপলক্ষে রাজা-জমিদারকে প্রজারা তাদের সৃজনশীল পণ্য ও সূচিকর্ম উপহার দিত। রাজা-জমিদাররাও প্রজাদের কর রেয়াত ও ইনাম দিতেন। মানুষের নৈপুণ্য প্রদর্শন ও সাংবাৎসরিক প্রয়োজনীয় অথবা শৌখিন পণ্যের বেচাকেনার জন্য বৈশাখীমেলা লোকবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য। মানুষ এই উৎসবের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে মুঘল আমল থেকেই। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে।’ সেই দিন হতে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাতি নতুন বর্ষ পালন করে আসছে নিজ নিজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমুন্নত রেখে। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে একটি নতুন সৌর সনের উদ্ভাবন করা হয়। ফসলি সন হিসেবে এই বাংলা সন বাঙালীর জীবনে নিয়ে আসে প্রাণের স্পন্দন আজও। আর ‘জগতের যেখানে অব্যাহত শক্তির প্রচুর প্রকাশ, সেখানেই যেন মূর্তিমান উৎসব’ (রবীন্দ্রনাথ)। এই উৎসব নিয়ে আসে সবার প্রাণে-মনে চির নতুনের আবাহন। মধ্যযুগের বাংলায় দরিদ্র মানুষের জীবনে বৈশাখ আনন্দবার্তা নিয়ে আসত এমন নয়, প্রচ- গরম আর অভাবের মাঝে বেঁচে থাকা গ্রামবাংলার মানুষ তবু খুঁজত প্রাণে প্রাণে যোগ। কবি মুকুন্দ রামের ‘কালকেতু ফুল্লরা উপাখ্যানে’ ফুল্লরার বর্ণনায় বৈশাখের দেখা মেলে এভাবেÑ ‘পাশেতে বসিয়া রামা কহে দুঃখবাণী/ভাঙা কুড়্যা ঘরখানি পরে ছাওনী/ভেরান্ডার খাম তার আছে মধ্যঘরে/প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙে ঝড়ে ॥/ পুণ্য কর্ম্ম বৈশাখেতে খরতর খর/তরুতল নাহি মোর করিতে পসর ॥/ পদ পোড়ে খরতর রবির কিরণ/শিরে দিতে নাহি আঁটে অঙ্গের বসন॥/ বৈশাখ হৈল আগো মোরে বড় বিষ/মাংস নাহি খায় সর্ব্বলোক নিরামিষ ॥’ রাজকর পরিশোধের আওতায় এই নিরন্ন, অভাবী বাঙালী না থাকলেও বৈশাখীমেলায় তার উপস্থিতি দেখা যেত। বৈশাখের নবপ্রভাতেই বাঙালী আজও তাই কায়মনে প্রার্থনা করে, যা কিছু গ্লানিময়, ক্লেদাক্ত, জীর্ণ বিশীর্ণ, দীর্ণ, পুরনো তা বৈশাখের রুদ্রদহনে পুড়ে যেন হয় ছাই, গ্রীষ্মের তাপস নিঃশ্বাস বায়ে পুরনো বছরের সব নিষ্ফল সঞ্চয় যেন দূর-দিগন্তে মিলায়। খরতাপে প্রকৃতি অগ্নিস্নানে হয় মত্ত। বাঙালী তাই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে বৈশাখকে আবাহন করে গেয়ে ওঠে, ‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা।’ সকল অপ্রাপ্তির বেদনাকে ধুয়ে মুছে; আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে নতুনভাবে রাঙিয়ে তোলে। বৈশাখের প্রথম দিনে যে উৎসবের ঘনঘটা, তা আসলে কৃষিজীবী বাঙালীর যুগ-যুগান্ত ধরে বয়ে আসা জীবনচর্যার অন্যরকম অনুষঙ্গ হিসেবে স্পন্দিত হয়। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন, ‘আজ আলোক জ্বলিয়াছে, সঙ্গীত ধ্বনিতেছে, দ্বার খুলিয়াছেÑ আজ মনুষ্যত্বের গৌরব আমাদিগকে স্পর্শ করিয়াছেÑ আজ আমরা কেহ একাকী নহিÑ আজ আমরা সকলে মিলিয়া একÑ আজ অতীত সহস্র বৎসরের অমৃতবাণী আমাদের কর্ণে ধ্বনিত হইতেছেÑ আজ অনাগত সহস্র বৎসর আমাদের কণ্ঠস্বরকে বহন করিবার জন্য সম্মুখে প্রতীক্ষা করিয়া আছে।’ পহেলা বৈশাখ সর্বস্তরের বাঙালী জনসাধারণের জন্যই শুভ নববর্ষের প্রথম দিবস। জমিতে বীজ বপনের দিবস হিসেবে বাঙালীর জাতীয় উৎসবের দিন। মেলা, খেলাধুলা, নৌকা বাইচ, গান-বাজনা এবং ভাল খাওয়া-দাওয়ার দিন। সর্বজন পালিত জাতীয় দিবসটি ইরানী নববর্ষ নওরোজের সূচনা দিবসের সঙ্গে তুল্য। বৈশাখ মাসেই গ্রামবাংলায় মেলার আয়োজন চলে বহুকাল হতে। ‘আমাদের দেশ প্রধানত পল্লীবাসী। এই পল্লী মাঝে মাঝে যখন আপনার নাড়ীর মধ্যে বাহিরের বৃহৎ জগতের রক্ত চলাচল অনুভব করিবার জন্য উৎসুক হইয়া ওঠে; তখন মেলাই তাহার প্রধান উপায়। এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান। এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সঙ্কীর্ণতা বিস্মৃত হয়Ñ তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ’ (রবীন্দ্রনাথ)। পাকিস্তান যুগে পহেলা বৈশাখকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ‘হিন্দুর বর্ষারম্ভ দিবস’ রূপে আখ্যায়িত করে তার আনন্দ-উৎসব হতে দূরে রাখার অভিযান চালিয়েছিল। বাঙালী যাতে বাঙালী না থাকে সেজন্য তার সংস্কৃতির মেলবন্ধনকে নিশ্চিহ্ন করার নানা প্রয়াস চলতে থাকে। পাকিস্তানকালে বাঙালী আর বাঙালী থাকল না বটে, কিন্তু বাংলাদেশ মুসলমান, হিন্দু, খ্রীস্টান বৌদ্ধ এবং নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি রয়েই গেল। রয়ে গেল বৈশাখ মাসও। হালখাতাও চলায়। ‘বাঙালী বলিয়া কোথাও কিছু নাই’ বলে পাকিস্তানী জান্তারা যতবার গলা হাঁকিয়েছে, বাঙালী ততবেশি নিজের বাঙালিত্ব রক্ষার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। যদিও নগরজীবনে বৈশাখ সেভাবে পালন করা হতো না। কিন্তু বাঙালীর রাজনৈতিক আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগাতে বৈশাখ রণরঙ্গিনী মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিল। চেতনায় বাঙালিয়ানা ক্রমশ স্বরূপ ধারণ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বাঙালীর উৎসব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করে তার স্বাধীন বিকাশের সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিলেন। বুঝেছিলেন তিনি, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই চেয়েছিলেন মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুপ্ত শক্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাক্সক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি। বলেছিলেনও তিনি ১৯৭০ সালের শেষদিনেÑ ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা না পেলে সংস্কৃতিকে গড়ে তোলা যায় না। বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না বলেই বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ হয়নি। দেশভাগের পর বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য প্রায় কিছুই করা হয়নি। শিল্পী, সাহিত্যিক এবং সংস্কৃতিসেবীদের তাদের সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত করতে দেয়া হয়নি। যে সংস্কৃতির সঙ্গে দেশের মাটি ও মনের সম্পর্ক নেই তা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।’ বঙ্গবন্ধু বাংলা ও বাঙালী অন্তঃপ্রাণ ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধুসহ প্রগতিশীল নেতারা বাংলা নববর্ষে সরকারী ছুটি দাবি করেন। তাদের দাবির মুখে সরকার ছুটি ঘোষণা করে। পাকিস্তানী জান্তা সরকারও তা বাতিল করার দুঃসাহস দেখায়নি। বঙ্গবন্ধু অবশ্য পরবর্তীকালে বলেছিলেন, ‘আঞ্চলিক পরিবেশ ও জনগণের ধ্যানধারণার ভিত্তিতে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে। ধর্মের নামে ভাড়াটিয়া সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া মানুষের আত্মার স্পন্দনকে পিষে মারারই শামিল।’ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালীকে তার সংস্কৃতির প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করতে বাধ্য করে। পাকিস্তানীদের নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও সংস্কৃতি কর্মীরা ঐতিহ্যকে সমুন্নত করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। ছায়ানটের হাত ধরে নগরজীবনে পহেলা বৈশাখ আসে আনন্দলোকেÑ মঙ্গলালোকের গান গেয়ে। ছায়ানট রমনার অশ্বত্থতলে ভোরের বেলা আয়োজন করে অনুষ্ঠানমালার। ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/তাপস নিঃশ্বাস বায়ে/মুমূর্ষেরে দাও উড়ায়ে।’ সমবেতভাবে শিল্পীদের উদাত্ত কণ্ঠে ধ্বনিত এ গান মানুষের মনে আশা জাগাত, প্রেরণা সৃষ্টি করত। সে সুরের অনুরণন ছাপিয়ে যায় গোটা ঢাকা শহর হয়ে সারাদেশে। নববর্ষের আগমনকে চিত্তে একটি নতুন উপলব্ধির শিহরণরূপে অনুভব করতে থাকে সংগ্রামী বাংলার বাঙালী পাকিস্তান যুগের শেষদিকে, একাত্তরের আগে। বাঙালী বুঝতে পারে পাকিস্তান যুগে রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ থেকে, যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারও করা হয়েছিল নিষিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষেরও আগে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আজ আমাদের কিসের উৎসব? শক্তির উৎসব। মানুষের মধ্যে কী আশ্চর্য শক্তি আশ্চর্যরূপে প্রকাশ পাইতেছে। আপনার সমস্ত ক্ষুদ্র আয়োজনকে অতিক্রম করিয়া মানুষ কোন্ উর্ধে গিয়ে দাঁড়াইয়াছে। ...জ্ঞানে প্রেমে কর্মে মানুষ যে অপরিমেয় শক্তিকে প্রকাশ করিয়াছে, আজ আমরা সেই শক্তির গৌরব স্মরণ করিয়া উৎসব করিব। আজ আমরা আপনাকে; ব্যক্তিবিশেষ নহে, কিন্তু মানুষ বলিয়া জানিয়া ধন্য হইব। ....আজ উৎসবের দিন শুদ্ধমাত্র ভাবরসসম্ভোগের দিন নহে; শুদ্ধমাত্র মাধুর্যের মধ্যে নিমগ্ন হইবার দিন নহেÑ আজ বৃহৎ সম্মিলনের মধ্যে শান্তি উপলব্ধির দিন, শক্তি সংগ্রহের দিন।’ বৈশাখে বাঙালী সেই শক্তির ভেতর দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করে আসছে। ১৯৭১ সালে তথা ১৩৭৮ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে এসেছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তখন বাঙালী নিধনে মত্ত। শহর-গঞ্জ-গ্রামে হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার ঘৃণ্যতায় লিপ্ত। যার বিরুদ্ধে বাঙালী সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছিল। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশে নববর্ষ পালন হয় মুক্ত পরিবেশেই। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সামরিক জান্তা শাসকরা বাঙালী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে খড়গ হাতে নেমে পড়ে। পাকিস্তানী বিজাতীয় সংস্কৃতির পুনর্প্রর্বতনের অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু বাঙালী প্রতিরোধের শক্তিতে তখনও বলীয়ান। নব্বই দশকে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের সহযোগী সংগঠন জাসাস রমনা অশ্বত্থতলা দখলের জন্য নোংরা আচরণ করে। ছায়ানটের অনুষ্ঠানস্থল তারা দখলের চেষ্টা চালায়। কিন্তু বাঙালী জনগণের হৃদয়ে ঠাঁই না পাওয়ায় পিছু হটতে বাধ্য হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নতুন বছরকে আপন সংস্কৃতির অনুশীলনে বরণ করে নেয়ার উৎসবকে স্তব্ধ করে দিতে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলাও চালানো হয়। টিএসসিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মেয়েদের প্রতি অশালীন আচরণের ঘটনা উৎসবকে ম্লান করে দেয়ার অপচেষ্টা হলেও তা সম্ভব হয়নি। মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদীরা বাঙালীর সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে নববর্ষ পালনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের এই হীন কর্মকা-কে নিশ্চিহ্ন করার পথ খুঁজে না পেয়ে তাই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে সংক্ষিপ্ত করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবার। নিñিদ্র নিরাপত্তা দেয়ার নানা আয়োজনও বিধি-নিষেধের নামে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। পাকিস্তানী জান্তা এবং বাংলাদেশী জান্তা শাসকরা শত চেষ্টা করেও বর্ষবরণ উদযাপনকে সঙ্কুচিত করতে পারেনি। নাশকতার অজুহাত দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বাঙালীর সর্বজনীন উৎসবকে পঙ্গু করারই নামান্তর। ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে বরণ করার জন্য বাঙালী যখন প্রস্তুত, তখন এসব বিধি-নিষেধ বাঙালীর সংস্কৃতির বিপরীতে জঙ্গী, মৌলবাদীদের কথিত পরিকল্পনাকে বৈধতা দেয়ার নামান্তর বলা যায়। নিরাপত্তা দিতে না পারার অসফলতার কারণে এই বিধি-নিষেধ মনে হতে পারে। কিন্তু উৎসবে নেমে আসা বাঙালীকে গৃহবন্দী করার মাধ্যমে তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও নতুনের প্রতি আবাহনকে স্তিমিত করার লক্ষ্যকেই কার্যকর করবে। রাজপথে নাগরিকদের ঢল মূলত জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে জাতীয় জাগরণই ঘটাবে। সংস্কৃতি কর্মীরা যেমনটা বলছেন, মৌলবাদীদের না আটকে তাদের আটকে দেয়া হচ্ছে। কোন ধর্মসভার ক্ষেত্রে সময়সীমা থাকে না, জাতীয় উৎসবের ক্ষেত্রে কেন এ সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে, তা প্রশ্ববোধক হয়ে থাকছে। নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি চালু করার যে প্রচেষ্টা এবার চালানো হয়েছে, তা জাতিকে শতগুণে প্রতিরোধী করে তুলবে। জনমনে আতঙ্ক তৈরি করার, ভয়ভীতির সংস্কৃতিকে বিকশিত করার এ অপচেষ্টা স্বাধীন দেশে নতুন করে আঘাত হানার শামিল। ১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ তার ‘উৎসবের দিন’ প্রবন্ধে যা বলেছিলেন, আজকের বাংলাদেশে তার পুনরাবৃত্তি ঘটুকÑ এটা কারও কাম্য নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য দিয়ে স্পষ্ট করা যায় বিষয়টি। ‘হায়, এখন আমরা উৎসবকে প্রতিদিন সঙ্কীর্ণ করিয়া আনিতেছি। এতকালে যাহা বিনয়রসাপ্লুত মাদলের ব্যাপার ছিল, এখন তাহা ঐশ্বর্যমদোদ্ধত আড়ম্বরে পরিণত হইয়াছে। এখন আমাদের হৃদয় সঙ্কুচিত, আমাদের দ্বার রুদ্ধ। এখন কেবল বন্ধুবান্ধব এবং ধনীমানী ছাড়া মঙ্গলকর্মের দিনে আমাদের ঘরে আর কাহারো স্থান হয় না। আজ আমরা মানব সাধারণকে দূর করিয়া নিজেকে বিচ্ছিন্ন-ক্ষুদ্র করিয়া, ঈশ্বরের বাধাহীন পবিত্র প্রকাশ হইতে বঞ্চিত করিয়া বড়ো হইলাম বলিয়া কল্পনা করি। আমাদের দীপালোক উজ্জ্বলতর খাদ্য প্রচুরতর আয়োজন বিচিত্রতর হইয়াছেÑ কিন্তু মঙ্গলময় অন্তর্যামী দেখিতেছেন আমাদের শুষ্কতা, আমাদের দীনতা, আমাদের নির্লজ্জ কৃপণতা।’ অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হচ্ছে একদিকে, অপরদিকে প্রদান করা হয়েছে উৎসব ভাতা। সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৈশাখী ভাতায় বিকেল ৫টার পর রেস্তরাঁয় গিয়ে তা ব্যয় করবেনÑ এমনটা ভাবাও সঙ্গত নয় যদিও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বৈশাখী ভাতা পেয়ে উৎসবে অংশ নেবেনÑ এমনটা হওয়াই ছিল বাঙালী সংস্কৃতির জন্য মাইলফলক। কিন্তু কেন এই হীনতা, দীনতা, সঙ্কীর্ণতা আর সংস্কৃতি বিমুখতা, সেসব খুঁজে বের করা নিশ্চয়ই দুঃসাধ্য নয়। জঙ্গীবাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান নিয়ে আসা পহেলা বৈশাখে মানুষ ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমে আসুক, উৎসবে হোক মাতোয়ারা। গেয়ে ওঠুকÑ ‘এসো হে বৈশাখ।’
×