শ্রমিক জামিনদার আইনের অন্যতম বিপদ হলো- এটা শ্রমিকদের অনিচ্ছায় নিয়োগ দাতা বা পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। এক্ষেত্রে জামিনদারের অধীনে কাজ করতে আসা কর্মীদের ভাগ্যের ওপরই নির্ভর করতে হয়। যদি কর্মদাতা নৈতিকতা বিবর্জিত হন আর অপব্যবহারের আলামত দেখা দেয়, তবে কর্মীর জীবন দুঃসহ হয়ে উঠতে পারে, তা বলাইবাহুল্য।
সৌদিতে সম্প্রতি রাসেদ নামে এক বাংলাদেশী শ্রমিকের সঙ্গে আমার সখ্য হয়। এই যুবকের সঙ্গে কথোপকথনে আমি তার নির্দয় সৌদি পৃষ্ঠপোষকের অনেক নিন্দিত শ্রমহরণ সম্পর্কে জেনেছি। তার কাছ থেকে জানা গেছে যে, প্রবাস জীবনে এই রাজ্যে তার দ্বিতীয় সফর। প্রথমদিকে সে একটি পাঁচতারকা হোটেলে কাজ করত। সেই সময় তার পরিচয় হয়েছিল এক সৌদি ব্যবসায়ীর সঙ্গে যে তাকে অনেক বেশি বেতন দিয়ে তার কোম্পানিতে কাজ করার জন্য অফার দেয়। ওই ব্যবসায়ী বাংলাদেশ থেকে ১০০টিরও বেশি শ্রমভিসা দেয়ার ক্ষমতা রাখে বলে রসেদকে বোঝাতে সক্ষম হয়। রাসেদ যদি তার কোম্পানিতে কাজ করতে চায়, তাহলে তাকে বর্তমান কাজ ছেড়ে নতুন কর্মসংস্থানের জন্য ভিসা প্রক্রিয়ার বিষয়ে ঢাকায় ফিরতে হবে।
দুই কন্যা সন্তানের জনক রাসেদ এই সুযোগ এবং নতুন আর্থিক সচ্ছলতার কথা ভেবে প্রস্তাবটি বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছাড়াই লুফে নেয়। সে তার পূর্ববর্তী কর্মসংস্থান ছেড়ে দেশে ফিরে এবং দ্রুতই সৌদি জামিনদারের অধীনে নতুন কর্মস্থলে যোগ দেয়।
রাসেদ বেদনার্ত কণ্ঠে আমার কাছে তার জীবনে ঘটে যাওয়া করুণ কাহিনী বর্ণনা করে। তার ভাষ্য এ রকমÑ ‘ফিরে আসার পর প্রথম দু’দিন আমি তার অফিসে কাজ করি কিন্তু তারপর হঠাৎ তিনি আমাকে তার বাড়িতে কাজ করতে বললেন। আমি তাকে আমার যোগ্যতা মোতাবেক বেতন যথাযথ হলে যে কোন কাজ যতদিন ইচ্ছা করতে পারি এ কথা জানালাম।
‘পরবর্তী ছয় মাস, আমি তার বাড়িতে ও পরিবারের জন্য গার্হস্থ্য সাহায্যকারী হিসেবে সব কাজই করতে লাগলাম, এমনকি ঘরদোরও পরিষ্কার পর্যন্ত। মালী এবং গার্ড হিসেবেও কাজ করতে লাগলাম পুরোদমে। আমি একসময় হতাশ ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। কেননা আমি তখনও পর্যন্ত বেতনের দেখা পাইনি। বাস্তবিক অর্থে, কাজের ধরন নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ ছিল না। এই কঠিন সময়ের মধ্যে আমার জীবনে এলো এক দুঃসংবাদ। বাবা মারা গেলেন। আমার নিয়োগকর্তা শুধু সান্ত¡না ছাড়া আর কিছুই দেননি। কিন্তু আমি আশা করেছিলাম প্রাপ্য বেতনসহ আরও কিছু সুবিধা।’
‘যখন ছয়মাস অতিবাহিত হলো তখন আমার পরিবার ভয়ানক আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে। আবার তার কাছে গেলাম আগের ছয় মাসের বেতন চাইতে। তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুই সপ্তাহের পারিবারিক ছুটি কাটিয়ে সুইজারল্যান্ড থেকে ফিরেই আমার প্রাপ্য মিটিয়ে দেবেন। সে সময় ছিল আসলেই আমার জন্য কঠিন ও দুঃসময়। আমার স্ত্রীর কাছ থেকে যখন জানতে পারলাম ঈদে আমার দুই যুবতী কন্যার নতুন জামা কেনার সামর্থ্য নেই। আমার বাবা মৃত্যুর সময় তেমন অর্থকড়ি রেখে যাননি। এই ব্যর্থতায় নিজেকে একজন অক্ষম পিতা ভাবা ছাড়া আর কোন সান্ত¡¡না খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’
‘দুই সপ্তাহের কথা বলে পরিবার নিয়ে ছয় সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে আসার পর একসময় আমি তার কাছে দাবির টাকা চাইলে তা দিতে অপারগতা প্রকাশ এবং ইউরোপ ভ্রমণের বিস্তর খরচের হিসাব সম্পর্কে আমাকে অবগত করে।’
‘তখন সে আমাকে বলে যে, যদি আমি এই বিষয়ে ক্ষুব্ধ হই বা আরেক স্পন্সরের কাছে কাজ করতে ইচ্ছুক হই তবে জামিনের জন্য তাকে ১০,০০০ এসআর প্রদান করতে হবে। আর যদি আমি এতে রাজি না হই তবে সে আমার পাসপোর্ট নির্বাসনের জন্য জাওয়াতে পাঠিয়ে দেবে। তার এ কথায় আমি বজ্রাহত হলাম। আমি এত টাকা কোথা থেকে যোগাড় করব?
‘আমি আপনাকে বলতে চাই, এই বাস্তবতা এ ধরনের লোকদের সততা নিয়ে সন্দেহের জন্ম দেয়। আমার মতো গরিব লোকদের তারা শিকারে পরিণত করে, বিশ্বাসকে ছুড়ে ফেলে দিতেও তারা দ্বিধা করে না।’
‘এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে, আমি সেখান থেকে পালিয়ে গেলাম। আমার পাসপোর্ট এখনও তার দখলে। আমার ছিল ৯ মাসের বসবাস ও ইকামার অনুমতি। কোনরকম বেঁচে থাকার মতো একটি কাজ যোগাড় করলাম। অন্যদিকে কিছু টাকা জমিয়ে পরিবারের কাছে পাঠাতে লাগলাম। কিছুদিনের মধ্যেই জানলাম যে, আমার সেই সৌদি স্পন্সর আমার পাসপোর্ট জাওয়াতে দিয়েছে। প্রতি মুহূর্তে ভয়ে ভয়ে কাটাতাম। না জানি কখন সে আমাকে খুঁজে বের করে তার কাছে নিয়ে যাবে।‘
আমি তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলামÑ কেন আপনি এই বিষয় নিয়ে শ্রম আদালতের দ্বারস্থ হননি? যারা এমন ঘৃণিত কর্ম করে প্রকাশ্যে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রতারণা করে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত নয়?
রাসেদ এর জবাবে বলেÑ ‘সবার সঙ্গে তার খুব ভাল সম্পর্ক। ক্ষমতার কাছাকাছি সে থাকে। আর আমি কে? আমি তো সাধারণ এক শ্রমজীবী মানুষ। কে আমাকে অপার ভরসায় হাত এগিয়ে দেবে? কে আমার কথা শুনবে? বরং এখানকার কর্তৃপক্ষ আমাকে উল্টো জেলে পুরবে। হতে পারে আমাকে শূন্য হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য করবে।’
সৌদি গেজেট অবলম্বনে