ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

বৈশাখী অর্থনীতি ও হালখাতা

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১০ এপ্রিল ২০১৬

বৈশাখী অর্থনীতি ও হালখাতা

পহেলা বৈশাখ আবহমানকাল থেকে প্রাচীন বাংলায় পালিত হয়ে আসছে নববর্ষ উদযাপন রীতি। আমাদের জাতীয় জীবনে এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বৈশাখী উৎসবের ব্যাপকতা সৃষ্টি হয়েছে গ্রাম থেকে শহরে। পাশাপাশি বিশাল এই আয়োজনকে কেন্দ্র করেই বিরাট আকারের বাণিজ্যিক তৎপরতা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখন শুধুই উৎসব নয়, আমাদের জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম একটি উপলক্ষও বটে। প্রাচীনকালের সেই বৈশাখী মেলা, পূজা-পার্বণ, হালখাতা, মিষ্টি বিতরণ, লাঠিখেলা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এসেছে নতুনরূপে। বৈশাখী আয়োজনে আছে- রথ নির্মাণ, নতুন ঢাক ঢোলের ছবি আঁকানো, বৈশাখী পোশাক, মাসব্যাপী বৈশাখী মেলা, বৈশাখী উৎসব, রমনা বটমূলের আয়োজন, রেডিও-টেলিভিশনের ব্যাপক অনুষ্ঠান প্রচার, পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ- এসব কিছুর পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক তৎপরতা। একসময় পারস্পরিক ভাব বিনিময়, সম্প্রীতি ও ক্রয়-বিক্রয়ের উৎস হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিল বৈশাখী মেলার। তখন সারা বছরের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা হতো মেলা থেকে। গ্রামীণ দৈনন্দিন জীবনের ঘর-গেরস্তালির যাবতীয় জিনিসপত্রের জন্য মেলার ওপর নির্ভরশীলতা ছিল বহুলাংশে। তখন গ্রামীণ অর্থনীতিও ছিল মেলাকেন্দ্রিক। মেলাকে কেন্দ্র করে কৃষিজ দ্রব্য, কুটির শিল্প, তাঁত শিল্প, বাঁশ-বেত-পাট শিল্প, মৃৎ শিল্প, চারু ও কারু শিল্পের বিশাল সমাবেশ ঘটত বৈশাখী মেলায়। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়- সারাদেশে কম-বেশি ২৭০টি বৈশাখী মেলা বসে। মরহুম পটুয়া কামরুল হাসান নিজে ঢোল বাজিয়ে গ্রামীণ মেলার আদলে রাজধানীতে প্রথম বাংলাদেশে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় বৈশাখী মেলা শুরু করেন বাংলা একাডেমি সবুজ চত্বরে। সেই থেকে পহেলা বৈশাখেই ঢাকা পরিণত হয় মেলার নগরীতে। বাংলা সংস্কৃতিকে লালন করার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশের মহান লক্ষ্য ছিল এ মেলা আয়োজনে। হালখাতা শব্দটি বাংলা ভাষার অতিথি, আরবী-ফারসী জাত। জমিদারি আমলে ‘হালখাতা’ বৈভবের চূড়ান্তে পৌঁছেছিল। সেই রমরমা হালখাতার অনুষ্ঠানটি পয়লা বৈশাখে প্রতিপালিত হয়। হালখাতার সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কোন সম্পর্ক নেই, যদিও হালখাতার মাথায় একটা স্বস্তিবচন লেখা থাকে। মুসলিম ব্যবসায়ী হলে তাঁর হালখাতায় ‘এলাহি ভরসা’ অথবা হিন্দু ব্যবসায়ী হলে ‘গণেশায় নমঃ’ লেখা থাকে। এই রীতি ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের অভিব্যক্তি মাত্র। হালখাতা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এ উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরনো দেনা শোধ করে দেন। হিসাবের খাতা হাল নাগাদ করা থেকে ‘হালখাতা’-র উদ্ভব। তবে এই হালখাতা উৎসবের সঙ্গে হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেন ঘটে। এসব কারণে আমাদের জাতীয় জীবনের অর্থনীতিতে বৈশাখী মেলা ও হালখাতা উৎসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
×