ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাজিম হত্যা মিশন চূড়ান্ত হয় দেড় বছর আগেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১০ এপ্রিল ২০১৬

নাজিম হত্যা মিশন চূড়ান্ত হয় দেড় বছর আগেই

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুক্তমনা লেখক নাজিম উদ্দিন সামাদ হত্যার প্রাথমিক পরিকল্পনা হয় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। আর বছর দেড়েক আগে হত্যার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। হত্যার টার্গেটের তালিকায় সিলেটে খুন হওয়া ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের সঙ্গে নাজিম ছাড়াও বেশ কয়েকজনের নাম রয়েছে। অনন্ত হত্যার পর পরিস্থিতি জটিল হলে নাজিম হত্যার মিশন থেকে সাময়িক সরে যায় হত্যাকারীরা। তবে নাজিম হত্যা টার্গেটের বাইরে ছিল না। দীর্ঘ সময় পর তারই ধারাবাহিকতায় নাজিমকে সুযোগ বুঝে ঢাকায় হত্যা করা হয়। নাজিমের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে অনন্ত বিজয় দাশ হত্যায় গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। মামলার ছায়া তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে দেশের প্রতিটি জেলায় গণজাগরণ মঞ্চের শাখা সৃষ্টি হয়। গণজাগরণ মঞ্চের সিলেট শাখার অন্যতম সংগঠক ছিলেন নিহত নাজিম। এরপর থেকেই নাজিম হত্যাকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়। সিলেট থাকা অবস্থায় নাজিমকে একাধিকবার হুমকি দিয়েছে। নাজিম কিছুদিন আত্মগোপনেও ছিল। এরপর ফেসবুকও কিছুদিন বন্ধ করে রেখেছিল। নাজিম চলতি বছরের প্রথম দিকে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় আসার পর আবার ফেসবুকে তৎপর হয়ে ওঠে। তার ধারণা ছিল বিপদ কেটে গেছে। প্রকৃতপক্ষে হত্যাকারীরা নাজিম হত্যার মিশন থেকে সরে যায়নি। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৬ এপ্রিল বুধবার রাত নয়টার দিকে রাজধানীর সূত্রাপুর থানাধীন একরামপুর মোড়ে কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক, বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পরিষদের সিলেট জেলা শাখার তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন সেশনের এলএলএম বিভাগের শিক্ষার্থী নাজিম উদ্দিন সামাদকে। এ ঘটনায় সূত্রাপুর থানার উপ-পরিদর্শক নুরুল ইসলাম অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামি করে সূত্রাপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সূত্রাপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সমীর চন্দ্র সূত্রধর জানান, হত্যাকারীরা পেছন থেকে নাজিমের ওপর আক্রমণ করে। তাদের একজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় কোপ দিলে নাজিমের মাথা কেটে মগজ বেরিয়ে পড়ে। নাজিম রাস্তায় পড়ে যান। এ সময় নাজিমের বন্ধু সোহেল পালিয়ে যায়। পরে নাজিমকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে একজন মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি চালায়। নাজিমের চিৎকার ও গুলির শব্দে আশপাশের মানুষ জড়ো হলে হত্যাকারীরা ভিড়ে মিশে পালিয়ে যায়। হত্যাকারীদের পরনে প্যান্ট-শার্ট ছিল। সবার বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। সূত্রাপুর থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জানান, ঘটনার সময় পালিয়ে যাওয়া সোহেল নাজিমের বন্ধু ও সহপাঠী। তারা দুজনই গে-ারিয়ার রজনীকান্ত চৌধুরী লেনের ২৯/ঘ নম্বর মেসের এক রুমে থাকত। সোহেলকে কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে সোহেল হত্যাকা-ের বর্ণনা দিয়েছেন। হত্যাকারীদের আটক বা গ্রেফতার কোনটিই করা হয়নি। তবে কয়েক দফায় সোহেলকে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তাকেসহ আরও দুজনকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র বলছে, গত বছরের ১২ মে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকার নূরানী পুকুরপাড়ে মুক্তমনা ব্লগের লেখক অনন্ত বিজয় দাশকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। অনন্ত হত্যায় মান্নান ইয়াহিয়া (২৪) ও তার ভাই মোহাইমিন নোমান (২১) এবং আবুল খায়ের (২২) গ্রেফতার হয়। মান্নান ইয়াহিয়া আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দেয়। তার দেয়া জবানবন্দী মোতাবেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ব্লগার রাজীব হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত শফিউর রহমান ফারাবীকে। অনন্তসহ সিলেটের বেশ কয়েক ব্লগারকে হত্যার টার্গেট করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে নাজিমও ছিল। এজন্য নাজিম হত্যায় নতুন করে অনন্ত হত্যায় গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হতে পারে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পূর্ব বিভাগের উপ-কমিশনার মাহবুব আলম জানান, মাত্র এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে নাজিমকে হত্যা করা হয়। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে ধারণা করা হচ্ছে, সিলেটে বসেই নাজিমকে হত্যার পরিকল্পনা হতে পারে। শুধু মাত্র নানা কারণে হত্যাকারীরা হয়তো সিলেটে নাজিমকে হত্যা করতে পারেনি। ঢাকা আসার পর নাজিম পুরনো আশঙ্কা ঝেড়ে ফেলে নতুনভাবে চলাফেরা করা শুরু করেছিল। এজন্যই নাজিমকে হত্যা করা সহজ হয়েছে হত্যাকারীদের পক্ষে। সিলেটে অনন্ত বিজয় দাশসহ যে ক’জন ব্লগার হত্যার টার্গেটে ছিল তার মধ্যে নাজিমও ছিল। অনন্ত হত্যায় জড়িত পলাতকরাও নাজিমকে হত্যা করতে পারে। এজন্য অনন্ত হত্যায় গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হতে পারে। এদিকে নাজিম হত্যাকা-ের ঘটনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি মেহরাব আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মানুষ হত্যা করা যায় কিন্তু কোন নীতি আদর্শকে হত্যা করা যায় না। মুক্তমনা, ব্লগারদের একের পর এক হত্যা করে আমাদের এই নীতি আদর্শকে কখনও কেউ খতম করতে পারবে না। নাজিম একজন প্রগতিশীল মুক্তমনা অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ছিল। তাকে কুপিয়ে হত্যা করা কোন মানবতার পরিচয় না। সে যুক্তি দিয়ে কথা বলত। এতে যদি কারোর লাগে তাহলে সে যুক্তি দিয়ে তাকে প্রতিহত করত। কিন্তু বর্বরভাবে এই হত্যাকা- আমাদের শঙ্কিত করে তুলছে। তাই হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে রবিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হবে।
×