ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজিম সামাদের দাফন সিলেটে সম্পন্ন

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৯ এপ্রিল ২০১৬

নাজিম সামাদের দাফন সিলেটে সম্পন্ন

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও মুক্তমনা লেখক নাজিম উদ্দিন সামাদের লাশ নিজ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। শুক্রবার বেলা এগারোটায় বিয়ানীবাজার উপজেলার তিলপাড়া ইউনিয়নের টুকা ভরাউট জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে তার দাফন সম্পন্ন হয়। ভোর সাড়ে ৬টার দিকে নাজিম উদ্দিন সামাদের লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এ সময় নিহতের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে। বুধবার রাতে ঢাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে নাজিম উদ্দিন সামাদ নিহত হয়। পরে তার চাচাত ভাই লন্ডন প্রবাসী বদরুল হক বৃহস্পতিবার বিকেলে দেশে ফিরে রাত ১১টা ২০ মিনিটে সূত্রাপুর থানার মাধ্যমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে লাশ গ্রহণ করেন। ১০ দিন নিজ বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন সামাদ ॥ উগ্রবাদীদের হুমকির কারণে ১০ দিন সিলেটের বিয়ানীবাজারের নিজ বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন নজিম। এমনকি ১৫দিন নিজের ফেসবুক এ্যাকাউন্টও বন্ধ (ডিএক্টিভ) রেখেছিলেন। সামাদের বন্ধুরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। পরিস্থিতি কিছুটা ‘স্বাভাবিক’ হয়ে এলে আবার ঢাকায় ফিরে যায় সামাদ। ফের সচল করেন ফেসবুক এ্যাকাউন্টও। ফেসবুকে পুনরায় ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদবিরোধী লেখালেখি শুরু করেন। নাজিমউদ্দিন সামাদের গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার তিলপাড়া ইউনিয়নের মাটিজুরা গ্রামে। বিয়ানীবাজারের প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও সেখানকার গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক হাসান শাহরিয়ার বলেন, সামাদকে বিভিন্ন সময় হুমকি দেয়া হয়েছিল বলে শুনেছি। গত ৩০ অক্টোবর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দিপনকে হত্যা ও আরেক প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুকে হত্যাচেষ্টার পর কিছুটা ভয় পেয়ে যান সামাদ। এর কিছুদিন পরই তিনি বিয়ানীবাজারে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। সেখানেই কিছুদিন অনেকটা আত্মগোপন করে ছিলেন। তবে ১০ দিনের মতো বিয়ানীবাজারে অবস্থান করার পর সামাদ আবার ঢাকায় ফিরে যান বলে জানান শাহরিয়ার। সিলেটের সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেন সামাদ। এই স্কুলে তার সহপাঠী ছিলেন সিলেট জেলা সিপিবি নেতা গোলাম রাব্বি চৌধুরী। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছিলো। গোলাম রাব্বি চৌধুরী বলেন, সামাদ আমার ছোটবেলার বন্ধু। সে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সবসময়ই সোচ্ছার এবং বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। রাব্বি বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে সামাদের সাথে আমার শেষ দেখা হয়। এ সময় সে তার ফেসবুক এ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। সিলেট শহীদ মিনারে আমাকে বলেছিল- কিছুটা চাপে আছি, তাই এ্যাকাউন্ট ডিএক্টিভ করে রেখেছি। তবে ১৪/১৫ দিন পর সামাদ পুনরায় ফেসবুকে সক্রিয় হয়ে ওঠেন বলে জানান রাব্বি চৌধুরী। তিন ভাই ইউরোপে থাকেন। তিনি দেশে হুমকিতে আছেন। তবু কেন সামাদ দেশের বাইরে চলে গেলেন না এমন প্রশ্নের জবাবে বিয়ানীবাজারের গ্রামের বাড়িতে অবস্থানরত সামাদের চাচাত ভাই বলেন, সে পড়ালেখা করতে চেয়েছে। কিছুতেই পড়ালেখায় বিঘœ ঘটুক তা চাইত না। পরিবারের সব পুরুষ সদস্যরা দেশের বাইরে থাকায় দেশে থাকা বৃদ্ধ মাকেও সে দেখাশোনা করত। তাছাড়া লেখালেখি বা হুমকির বিষয়ে আমাদের কোন দিনই কিছু বলেনি। রাজাকার নিপাত যাক ॥ রাজাকার আর জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে সোচ্ছার ছিলেন সামাদ। এ ক্ষেত্রে তার লেখালেখি ও অবস্থান ছিল স্পষ্ট। অনলাইন এক্টিভিস্ট নাজিম উদ্দিন সামাদের একটি ছবি ফেসবুকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ছবিতে উদোম গায়ে সামাদের বুকে লাল হরফে লেখা রয়েছে- ‘রাজাকার নিপাত যাক’। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের শুরুর দিকে এভাবেই বুকে ‘রাজাকার নিপাত যাক’ লিখে সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচীতে অংশ নিতেন সামাদ। রাজপথের মতো ফেসবুকেও যুদ্ধাপরাধী এবং রাজাকারদের বিচারের দাবিতে তিনি ছিলেন সোচ্চার। জামায়াত শিবির নির্মূল না হলে এদেশে কেউ নিরাপদ নয় বলে ফেসবুকে লিখেছিলেন তিনি। নাজিম সিলেট জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারী দলের একটি অঙ্গ সংগঠনের দায়িত্বে থাকলেও তিনি যৌক্তিক বিষয়ে ফেসবুকে সরকারী দলের সমালোচনা করতেন। বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল সামাদের ॥ ‘অনেক বড় হওয়ার’ স্বপ্ন নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন নাজিম উদ্দিন সামাদ। লক্ষ্য ছিল আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী (এলএলএম) নিয়ে পেশাজীবন শুরু করবেন। সিলেটের একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি করা নাজিমকে ঢাকায় যেতে বারণ করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। তাদের ইচ্ছা ছিল সিলেটেই এলএলএম করুক নাজিম। কিন্তু ‘বড় হওয়ার’ স্বপ্ন নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল সে। এই বড় হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে তার। বিয়ানীবাজারের আছিরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর সে ভর্তি হয় সিলেট নগরীর স্কলার্সহোম কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করে সিলেটের একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি অনার্সে ভর্তি হয়। এলএলবি পাসের পর পরিবারের সদস্যরা চেয়েছিলেন নাজিম সিলেটেই এলএলএম সম্পন্ন করুক। নাজিমের বড় বোন পারুল বেগম জানান- ‘নাজিম বলত সে অনেক বড় হবে। বড় হতে হলে ঢাকায় যেতে হবে, ঢাকায় পড়ালেখা করতে হবে। বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সে ঢাকায় পড়তে গিয়েছিল। কিন্তু তার সেই বড় হওয়ার স্বপ্নই কাল হয়েছে।’ পারুল বেগম আরও জানান- ‘খুন হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে ফোনে তার সঙ্গে কথা হয় নাজিমের। সে বলেছিল বৃহস্পতিবার সিলেট আসবে। আসার সময় আমার ছোট ছেলের জন্য সাইকেল কিনে নিয়ে আসবে। ছেলে খুনের খবর পাওয়ার পর থেকে বাকশক্তি হারিয়েছেন নাজিমের ষাটোর্ধ মা তৈরুন্নেছা। ছেলের ছবি বুকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। কারও কণ্ঠ শুনলেই বিছানা ছেড়ে উঠে ছেলেকে খুঁজতে থাকেন। মাঝে মধ্যে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।
×