ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার নাজিম

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৯ এপ্রিল ২০১৬

জঙ্গীদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের  শিকার  নাজিম

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মুক্তমনা লেখক, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক, বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পরিষদের সিলেট জেলা শাখার তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিম উদ্দিন সামাদ হত্যায় বন্ধু সোহেলকে খুঁজে পেয়েছে পুলিশ। তবে তাকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। তাকেসহ তিনজনকে রাখা হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিতে। অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছেন। অন্যান্য ব্লগার ও প্রকাশককে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে নাজিমকেও একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। হত্যার ধরন বলছে, নাজিম জঙ্গীদের পরিকল্পিত হত্যাকা-ের শিকার। নাজিম হত্যায় দায়েরকৃত মামলাটি থানা পুলিশ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাব সম্মিলিতভাবে তদন্ত করে যাচ্ছে। নাজিমকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। গত ৬ এপ্রিল বুধবার রাত নয়টার দিকে রাজধানীর সূত্রাপুর থানাধীন একরামপুর মোড়ে ছুরিকাঘাতে ও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় নাজিমকে। নাজিমরা পাঁচ ভাই। সবার বড়জন মারা গেছেন। অপর তিন জন বিদেশ থাকেন। মামলার বাদী হওয়ার মতো কেউ না থাকায় সূত্রাপুর থানার উপ-পরিদর্শক নুরুল ইসলাম অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামি করে সূত্রাপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সূত্রাপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সমীর চন্দ্র সূত্রধর প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, একরামপুর মোড়ে পৌঁছলে ৪/৫ জন পেছন থেকে নাজিমের ওপর আক্রমণ করে। তাদের একজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে নাজিমের মাথায় আঘাত করে। নাজিমের মাথা কেটে মগজ বেরিয়ে যায়। নাজিম রাস্তায় পড়ে যান। এ সময় নাজিমের বন্ধু সোহেল পালিয়ে যায়। রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পর নাজিমকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। এরপর একজন মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে নাজিমের মৃত্যু নিশ্চিত করে। নাজিমের চিৎকার ও গুলির শব্দে আশপাশের মানুষ এগিয়ে গেলে হত্যাকারীরা জনতার ভিড়ে মিশে পালিয়ে যায়। হত্যাকারীদের পরনে প্যান্ট-শার্ট ছিল। সবার বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। মাত্র এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে নাজিম হত্যা মিশন সফল করে খুনীরা পালিয়ে যায়। নাজিমের বন্ধু সোহেলের সন্ধান মিলেছে। তবে তাকে আটক বা গ্রেফতার কোনটিই করা হয়নি। তবে কয়েক দফায় সোহেলকে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তাকেসহ আরও দুজনকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। সূত্রাপুর থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জানান, সোহেল নাজিমের সহপাঠী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নাজিমের সঙ্গেই এলএলএম পড়াশোনা করে। সোহেলের বাড়ি সুনামগঞ্জে। তারা দুজনের গে-ারিয়ার রজনীকান্ত চৌধুরী লেনের ২৯/ঘ নম্বর মেসে এক রুমে বসবাস করত। মেসটিতে দুটি কক্ষ। অপর কক্ষে দুজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ বসবাস করেন। মেসে তল্লাশি চালানো হয়েছে। মেস থেকে নাজিমের একটি পুরনো ডায়েরি উদ্ধার হয়েছে। যেটি ২০১০ সালের। জানা গেছে, ডায়েরিতে লেখা থেকে নাজিমের ভাবনা, শেষ ইচ্ছা, বান্ধবীর সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটানো, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মুফতি আমিনী, কৃষি ও শিক্ষায় দেশের এগিয়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে নকল রোধে চারদলীয় জোট সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের প্রতি কৃতজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল শুক্রবারের এক লেখায় প্রকাশ পেয়েছে কিছু বিষয়। এর মধ্যে রয়েছে তার বান্ধবী রুমির কথা। রুমি তার জন্য রান্না করে অপেক্ষা করছে। রুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। এক জায়গায় লেখা রয়েছে, নাস্তিকবাদে বিশ্বাসী জেনেও রুমি তাকে ঘৃণা করেনি। রুমি তাকে ছেড়ে যায়নি। এ জন্য সে রুমির কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। প্রতিদিন রুমি অন্তত ৬ থেকে ৭ বার নাজিমের খোঁজ নিত। রুমি আবেগী হলেও বন্ধু হিসেবে ভাল। শ্রীমঙ্গলে এক পিকনিকে ছবি তুলতে গিয়ে রুমির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, পরিকল্পিতভাবে পহেলা বৈশাখ ও যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকরের আগে নাজিমকে হত্যা করা হয়েছে। এবারই প্রথম কোন অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টকে হত্যার পর দায় স্বীকারের ঘটনা ঘটেনি। এটি হত্যাকারী বা হত্যাকারী সংগঠনের নতুন কৌশল কিনা সে বিষয়ে বিস্তর পর্যালোচনা চলছে। গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার থাকায় হামলার আশঙ্কা করেছিলেন নাজিম উদ্দিন সামাদ। শিক্ষক, বন্ধু ও প্রিয়জনদের কাছে আশঙ্কা কথা জানালেও নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি নাজিম। এমন আশঙ্কার সঙ্গে কোন কোন বিষয় জড়িত তা পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে জানার চেষ্টা চলছে। হত্যাকা-ের বিষয়ে ডিবির পূর্ব বিভাগের উপ-কমিশনার মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যক্তিগত শত্রুতা, ফেসবুকে ধর্মীয়সহ নানা বিষয়ে লেখালেখির কারণে উগ্র মৌলবাদী বা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত কিনা সে বিষয়টি মাথায় রেখে গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত চলছে। শুক্রবার নাজিমকে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার তিলপাড়া ইউনিয়নের টোকাভড়াউট গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
×