ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা না করায় হতাশায় কেন্দ্রীয় নেতারা;###;গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ালেই কর্মসূচী

আন্দোলন পরিকল্পনার কৌশল নিয়েই ব্যস্ত বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৯ এপ্রিল ২০১৬

আন্দোলন পরিকল্পনার কৌশল নিয়েই ব্যস্ত বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ আগে জাতীয় কাউন্সিলের পর সরকারবিরোধী আন্দোলনের কথা বললেও এখন এ বিষয়ে কৌশল পরিবর্তন করেছে বিএনপি। তবে পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর আন্দোলন শুরু করতে চায় দলটি। প্রথমে ইস্যুভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ধীরে ধীরে আবার নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিলের আগে দলের সিনিয়র নেতারা কথায় কথায় কাউন্সিলের পর আন্দোলনের কথা বলতেন। কিন্তু জাঁকজমকভাবে জাতীয় কাউন্সিল করার পরও দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা না করায় অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতাই এখন হতাশায় ভুগছেন। তারা এখন নিজেদের পদ-পদবী পাওয়ার জন্য নানমুখী দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কথা ভাবতে পারছেন না তারা। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সবাইকে দলীয় কর্মকা-ে অধিক সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি প্রথমে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন ও পরে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করতে চান বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্রমতে, সরকার শীঘ্রই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলে এর প্রতিবাদে আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করবে বিএনপি। এ রকম আরও কোন ইস্যু পেলে তাৎক্ষণিকভাবে আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করবে তারা। আর চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শেষ হলে এ নির্বাচনের সার্বিক অনিয়মগুলো সামনে এনে আন্দোলন কর্মসূচী পালনেরও প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। এর পর ধীরে ধীরে দলের নেতাকর্মীদের আন্দোলনমুখী করে পরে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আবারও আন্দোলনে যাবে বিএনপি। তবে আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে এখনও দলীয় ফোরামে কোন আলোচনা হয়নি। এদিকে, ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের কথা সরাসরি না বললেও শুক্রবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, জনমতকে উপেক্ষা করে সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ালে বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এর বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবে। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশে বিরাজমান পরিস্থিতি উত্তরণে আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। দলের আরেক নেতা ড. ওসমান ফারুক বলেছেন, সামনে বজ্রকঠিন আন্দোলন আসছে। এবার হাইকমান্ড থেকে দল ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দিয়ে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল সম্পন্ন করা হয়। কাউন্সিলের আগে দলীয় হাইকমান্ড যোগ্য নেতাদের নিয়ে দ্রুত নতুন কমিটি দেয়ার কথা বলে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করেন। কিন্তু কাউন্সিলের দিন কর্মঅধিবেশনে খালেদা জিয়াকে চেয়ারপার্সন ও তাঁর লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমানকে পুনরায় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেয়া হলেও আর কোন পদের দায়িত্ব কাউকে দেয়া হয়নি। এ নিয়ে যখন চারদিকে নানান জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে তখন ৩০ মার্চ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব, রুহুল কবির রিজভীকে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব ও মিজানুর রহমান সিনহাকে দলের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এতে পদ না পাওয়া কেন্দ্রীয় নেতারা আশাহত হন। জানা যায়, বিগত দিনে বার বার আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ায় এবার বিএনপি হাইকমান্ড দলের কেন্দ্রীয় কমিটি করার ক্ষেত্রে এমন নেতাদের প্রাধান্য দিতে চান যারা আন্দোলনের মাঠ থেকে পিছপা হবেন না। এ নিয়ে ব্যাপক তথ্যানুসন্ধান করা হচ্ছে। তবে জাতীয় কাউন্সিলের তিন সপ্তাহ পরও কমিটিতে স্থান না পাওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা সুবিধাজনক পদ পেতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছেন। দেশে খালেদা জিয়ার সুনজরে থাকার পাশাপাশি বিদেশে তদবির করে তারেক রহমানের গুডবুকে থাকার চেষ্টা করছেন। সূত্র জানায়, অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আন্দোলনের ব্যাপারে এবার বুঝেশুনেই অগ্রসর হতে চায় বিএনপি। আর সম্প্রতি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার পর সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচী দিয়েও তা পালন করতে না পারার বিষয়টিও দলীয় হাইকমান্ড বিবেচনায় রাখছে। তাই জনসম্পৃক্ত কোন ভাল ইস্যু পেলে আন্দোলন কর্মসূচী পালন করার পাশাপাশি ভেবেচিন্তে ধীরলয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদারের দিকে যেতে চায় তারা। প্রসঙ্গত, গত বছর দেশব্যাপী টানা ৯২ দিন আন্দোলন চলাকালে গাড়ি পোড়ানো ও হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে বিএনপিকে বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে ফেলেছেন দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। বেশ ক’জন নেতা কারাগারেও রয়েছেন। শীঘ্রই এসব মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার কোন সম্ভাবনাও নেই। বরং আরও অনেক সিনিয়র নেতা এসব মামলায় গ্রেফতার হতে পারেন। মামলার কারণে কারাগারে গেলে আপাতত রাজনীতিও করতে পারবেন না তারা। তাই দলের নেতারা এখনও আন্দোলনের পরিবর্তে নিজেদের নিরাপদ রাখার বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সরকারবিরোধী বড় ধরনের আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি প্রথম ব্যর্থ হয় ২০১৩ সালে। ওই বছরের শেষদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দেশব্যাপী লাগাতার আন্দোলন করে বিএনপি। আন্দোলন চলাকালে সারাদেশে ব্যাপক নাশকতাও চালানো হয়। আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালায় বিএনপি। এতেও সফল না হওয়ায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু বিএনপি জোট বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে। বিএনপি হাইকমান্ড মনে করেছিলেন আওয়ামী লীগ হয়ত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সে আশার গুড়েবালি পড়ায় গত বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে টানা ৯২ দিন অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল পালন করে। এমনকি আন্দোলন চলাকালে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বাসা ছেড়ে দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করেন। এর আগে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চাঙ্গা করতে গত বছরের ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করার সিদ্ধান্ত নেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এজন্যই প্রস্তুতি জোরদার করতে ৩ জানুয়ারি রাতে বাসা ছেড়ে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করেন তিনি। তার সঙ্গে দলের আরও ক’জন নেতাকর্মীও গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করেন। খালেদা জিয়ার ডাকে ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ কর্মসূচী শুরু হয়। এ কর্মসূচী পালনকালে দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে তেমন সক্রিয় না থাকলেও তা সফল করতে চোরাগোপ্তা নাশকতা চালিয়ে সারাদেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়। বিশেষ করে পেট্রোলবোমার আঘাতে শতাধিক মানুষ মারা যাওয়া এবং আরও শতাধিক মানুষ আগুনে দ্বগ্ধ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার মতো নেতিবাচক দিকগুলো এখনও দেশের সাধারণ মানুষ ভুলতে পারেনি। গত বছরের নেতিবাচক কর্মসূচীর কারণেই আন্দোলনের কথা মনে হলে মানুষ বিএনপির বিরুদ্ধে এই ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের অভিযোগ উত্থাপন করে। বিদেশী কূটনীতিকরাও বার বার এ বিষয়টির প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এদিকে, আন্দোলনের নামে নাশকতামূলক কর্মকা-ে জড়ানোর অভিযোগ এনে সরকারও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধমে বিএনপি নেতাকর্মীদের কঠোর নজরদারির আওতায় আনে। বিভিন্ন মামলার আসামি হওয়ায় দলের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। আর পুলিশের চোখ এড়াতে দলের অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান। কেউ কেউ দলীয় কর্মকা-ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। এ কারণেই চলমান ইউপি নির্বাচনে কোন কোন এলাকায় প্রার্থী পাচ্ছে না বিএনপি। আর অধিকাংশ এলাকায় প্রার্থী দিলেও তেমন জোরালো প্রচার চালাতে পারছে না দলটি। এ সবকিছু বিবেচনায় রেখেই বিএনপি বাস্তবতার আলোকে ধীরগতিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে এগোতে চায়। বিএনপির আগের কমিটির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি আন্দোলনে যাবে। তবে দলের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর আবার ধীরে ধীরে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করা হবে। তার আগে সরকারের জনবিরোধী কোন ইস্যু এলে সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হবে। জাতীয় কাউন্সিলের পর নতুন উদ্যমে দলের নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক কর্মকা-ের পাশাপাশি আন্দোলন কর্মসূচীতে অংশ নেবে।
×